বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য সামরিক শিক্ষা
2024-11-18 15:30:07

প্রতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে চীনের বিভিন্ন পর্যায়ের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হয়। কিছু কিছু মাধ্যমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ে সেমিস্টারের শুরুতে কয়েক সপ্তাহের জন্য হালকা ধরনের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। তবে, দেশজুড়ে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রথম বর্ষের শুরুতে এ ধরনের হালকা সামরিক প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সাধারণত এ কার্যক্রম দুই সপ্তাহ স্থায়ী হয়। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বাইরে ক্যাম্পে অবস্থান করে ও সাধারণ সৈনিকদের মতো দৈনন্দিন শরীরচর্চা ও প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণ করে। তবে, কোনো শিক্ষার্থী যদি এ ধরনের প্রশিক্ষণের জন্য শারীরিকভাবে উপযুক্ত না হয়, তবে চিকিত্সকের সনদ জমা দিয়ে রেহাই পেতে পারে। এ ধরনের প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা জাগ্রত করা। আজকের অনুষ্ঠানে শাংহাই চিয়াওথং বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন শিক্ষার্থীদের সামরিক প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা ও তাদের অনুভূতি তুলে ধরবো।

যেমনটা আগেই বলেছি, চীনের বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন পর্যায়ের স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের হালকা ধরনের সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করতে হয়। সাধারণত মাধ্যমিক স্কুল ও উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর, ছাত্রছাত্রীরা সপ্তাহব্যাপী সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করে। তবে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ ধরনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ সারা দেশেই বাধ্যতামূলক।

শাংহাই চিয়াওথং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিক তথ্য ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমির অনার্স শিক্ষার্থী চাং ইয়ু সিউয়ান তাঁর তৃতীয় বারের সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। মাধ্যমিক স্কুল ও উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তির পরও তাকে দু’বার সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্স তাঁর মনে বিশেষ দাগ কেটেছে।

শিক্ষার্থী চাং মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্সের সময় তুলনামূলকভাবে বেশি এবং প্রশিক্ষণের কার্যক্রম আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং। শিক্ষার্থীরা বয়স বাড়ার সাথে সাথে দেশ প্রতিরক্ষার ব্যাপারে আরও সঠিক ও স্পষ্ট ধারণা পায়। সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে তাদের দেশপ্রেমের চেতনা বৃদ্ধি পায়। তাঁরা তখন এ ধরনের প্রশিক্ষণের গুরুত্ব আরও ভালোভাবে বুঝতে পারে।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ‘প্রতিরক্ষা শিক্ষা আইন’ আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়। তখন থেকে প্রতিরক্ষাসংশ্লিষ্ট শিক্ষা চীনের বিভিন্ন স্কুলের একটি গুরত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের প্রতিরক্ষার তত্ত্ব, জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে নির্দিষ্ট মানদন্ড প্রণয়ন করা হয়েছে।

চলতি বছরের নতুন সেমিস্টারে চীনের বিভিন্ন এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য  সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্স চালু হয়েছে। এমন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা কেবল শরীরচর্চা করে না, বরং একসাথে কাজ করার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়।

এবার শাংহাই চিয়াওথং বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্সের মূল বিষয় লাল ফৌজের ‘লংমার্চ চেতনা’ স্মরণ ও উত্তরাধিকার করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০০০ জনেরও বেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এবার সামরিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা রাত ৮টা থেকে যাত্রা শুরু করে প্রায় ৪ ঘন্টার বেশি সময় হাঁটেন এবং অতিক্রম করেন মোট ২০ কিলোমিটার পথ। ভোররাত ১টা পর্যন্ত এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের শরীরের অবস্থা বিবেচনা করে, ১৫ কিলোমিটার আর ২০ কিলোমিটারের যাত্রা নির্ধারণ করা হয়। শিক্ষার্থী চাং বলেন, শুরুতে ১৫ কিলোমিটার হাঁটতে চেয়েছিলেন। পরে দেখলেন, অনেক ছাত্রছাত্রী ২০ কিলোমিটার পথ হাঁটার অপশন বেছে নিয়েছে। দেখাদেখি তিনি নিজেও আরও ৫ কিলোমিটার বেশি হাঁটেন।

এ অভিজ্ঞতা স্মরণ করে চাং বলেন, “অতীতে লাল ফৌজের সৈন্যরা শত্রুদের আর্টিলারি আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে, কঠোর পরিস্থিতিতে, তুষারের পাহাড় ও তৃণভূমি অতিক্রম করেছেন। তাঁরা ২৫ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছিলেন। আমাদের এ সামরিক প্রশিক্ষণের ২০ কিলোমিটার সে তুলনায় কিছুই নয়।”

শাংহাই চিয়াওথং বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম ও যোগাযোগ একাডেমির মাস্টার্স শিক্ষার্থী এবং সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্সের সহকারী পরামর্শক চাং সিয়াও আই বলেন, “অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ২০ কিলোমিটারের যাত্রা বেছে নিয়েছেন এবং অনেকে কষ্ট হলেও যাত্রা সম্পন্ন করেছেন। এ যাত্রায় কেউ ক্লান্তি বা কষ্টের কথা বলেননি।”

তিনি আরও বলেন, এবার সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্সে, চীনা লাল ফৌজের ‘লংমার্চ’ যাত্রায় অর্জিত অভিজ্ঞতার কথা নতুন করে স্মরণ করেন শিক্ষার্থীরা। লাল ফৌজের সৈনিকরা ক্ষুধা, বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ, কুওমিনতাং পার্টির বাহিনীর আক্রমণ সহ্য করেছিলেন। সামরিক কোর্সের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পূর্বপুরুষদের সেই কষ্ঠ, আত্মত্যাগ, ও সাহসী সংগ্রামের চেতনা বুঝতে সক্ষম হন।

চলতি বছর চীনের নিজের তৈরি পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ৬০তম বার্ষিকী। এ উপলক্ষ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্সের শেষ দিকে, চীনের সুবিখ্যাত কয়েকজন বিজ্ঞানীর বোর্ডও প্রদর্শন করা হয়। এসব প্রদর্শনী বোর্ডের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার সময় চীনের দুর্বলতা, চীনা বিজ্ঞানীদের দেশ-উন্নয়নের নিরলস প্রচেষ্টা ও দেশপ্রেমের চেতনা ছাত্রছাত্রীরা ভালো করে জানতে পারে।

সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্সের সহকারী পরামর্শক হিসেবে চাং সিয়াও আই নতুন ছাত্রছাত্রীদের সাথে থাকতে বেশ পছন্দ করেন। কারণ, নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর দেশের প্রতিরক্ষার ধারণা ও গুরুত্ব ভালো করে বুঝতে পারে। তাই, এমন উদ্যোগ তাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ।

শানতুং চীনা চিকিত্সা ও মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স শিক্ষার্থী লিউ থিয়ান ইউ বলেন, সামরিক প্রশিক্ষণে ক্রল করা বা হাঁটার মতো শরীরচর্চা দেখা সহজ, তবে সবাইকে একসাথে সুশৃঙ্খলভাবে হাঁটানো আসলে সহজ ব্যাপার নয়। কারণ, হাঁটার সময় সবার হাত ও পা একভাবে চলে না। এটা ঠিক রাখা আসলে কঠিন। এই মিল ঠিক রাখার জন্য বার বার চর্চা করতে হয়। লিউ নিজের অপারগতার জন্য লজ্জিত হন।

শিক্ষার্থী লিউ মনোযোগ দিয়ে আরও বেশি সময় দিয়ে চর্চা করেন। যখন অন্য শিক্ষার্থীরা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, তখনও মেয়ে লিউ চর্চা চালিয়ে যান। ক্লান্ত লাগলেও, তিনি দমেননি। পরে তিনি সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটা শিখে ফেলেন।

শুরুতে তিনি মনে করেছিলেন, ক্রল করা তুলনামূলকভাবে সহজ। তবে পরে খেয়াল করেন যে, এটাও আসলে সহজ নয়। এখানেও দলীয় শৃঙ্খলা জরুরি। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে কাজ করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। চাকরি নেওয়ার পর অন্যদের সাথে কাজ করার সময়ও একই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়।

সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্স গ্রহণের পর অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন, তাঁদের দেশপ্রেমের চেতনা আগের তুলনায় বেড়েছে। যখন জাতীয় পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে যোগ দেন, তখন সবাই গর্বিত হন, দায়িত্ব অনুভব করেন। শিক্ষার্থীরা পরিশ্রম করে পড়াশোনা করার এবং দেশের উন্নয়নে নিজের অবদান রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করে।

শানতুং চীনা চিকিত্সা ও মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্স গ্রহণের সময় ইচ্ছাশক্তি চর্চার সুযোগ পেয়েছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চু চিন স্যু বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শুধু পেশাদার জ্ঞান শেখা নয়, বরং প্রতিরক্ষার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। কারণ, দেশপ্রেমের চেতনা না থাকলে, দেশের উন্নয়নে সঠিক অবদান রাখা সম্ভব নয়।

সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্স চলাকালে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘আত্মচর্চা প্রশিক্ষণ দল’ গঠন করেন। তাঁরা সৈনিকের কঠোর পরীক্ষা পাস করে, সামরিক প্রশিক্ষণ দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি, চীনা চিকিত্সাবিদ্যার জ্ঞান অর্জন করেন। তাই, জরুরি অবস্থায় সংশ্লিষ্ট উদ্ধারকাজেও অংশ নিতে পারেন। তা ছাড়া, দেশপ্রেমের শিক্ষাদান ক্লাসে শিক্ষার্থীরা সিরিয়ার বিজ্ঞানীদের মুগ্ধকর গল্প জানতে পেরেছেন এবং অনেকে মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, দেশপ্রেম বিস্তারিত পদক্ষেপ ও জীবিত বীরদের মাধ্যমে প্রতিফলিত হতে পারে। সবাই মনে করেন, শান্তিপূর্ণ ও সুখী জীবন কাটানো বেশ সৌভাগ্যের ব্যাপার। কারণ, বর্তমানে বিশ্বের অনেক জায়গায় যুদ্ধ চলছে, অনেকে যুদ্ধের কারণে গৃহহারা হয়েছেন, যা বেশ দুঃখজনক ব্যাপার।

যদিও গরম আবহাওয়ায় সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণ আরামদায়ক ব্যাপার নয়, তবে সবাই শরীরের ঘামের সাথে ইচ্ছাশক্তির চর্চা করেছেন। এটিও বেশ শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা। এ থেকে শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারেন যে, চীনা গণমুক্তি ফৌজের সৈন্যদের দৈনিক জীবন কতো পরিশ্রমের ও সাধনার।

(সুবর্ণা/আলিম/রুবি)