৬ থেকে ৮ নভেম্বর প্রথম বিশ্ব ক্লাসিক সম্মেলন বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বের ৩০টি দেশের সুপরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়, থিঙ্ক-ট্যাংক এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন মহলের ৪০০ জনেরও বেশি চীনা এবং বিদেশী অতিথি এই সম্মেলনে অংশ নেন। তারা ‘ক্লাসিক সভ্যতা এবং আধুনিক বিশ্ব’— এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে আলোচনা করেন এবং মত বিনিময় করেন।
সম্মেলনের মূল আলোচ্যসূচি ৭ থেকে ৮ নভেম্বর বেইজিং ইয়ানছি লেক ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অ্যান্ড এক্সিবিশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়। ৭ নভেম্বর সকালে সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং মূল ফোরাম অনুষ্ঠিত হয়।
শ্রীলঙ্কার জাতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মহাপরিচালক থুসিথা মেন্ডিস ডালাথ বলেছেন: “প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব ক্লাসিক সংস্কৃতি রয়েছে এবং এশীয় ক্লাসিক সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ সংযোগ রয়েছে, বিশেষ করে চীন এবং শ্রীলঙ্কা। আমাদের অনেক ক্লাসিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। এই সম্মেলনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এবং আমরা আমাদের নিজেদের দেশের ক্লাসিক সংস্কৃতি সম্পর্কে শেয়ার করতে এবং বিনিময় করতে পারি।”
এবারের সম্মেলনের প্রধান লক্ষ্য হল ক্লাসিক সভ্যতার গবেষণার দৃষ্টিকোণ থেকে শুরু করে, মানুষের চিন্তাধারার উৎসের দিকে ফিরে আসা, মানব ইতিহাসের জ্ঞানের সংক্ষিপ্তসার, মানব সভ্যতার ঐতিহ্য অন্বেষণ করা, সভ্যতার মধ্যে আদান-প্রদান এবং পারস্পরিক শিক্ষাকে শক্তিশালী করার জন্য একটি দৃঢ় একাডেমিক ভিত্তি স্থাপন করা, আধুনিক বিশ্ব সমস্যা সমাধানের জন্য প্রজ্ঞা ও অনুপ্রেরণা প্রদান করা, মানব উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রচারে মতাদর্শগত গতি প্রদান করা এবং মানবজাতির অভিন্ন কল্যাণের কমিউনিটি নির্মাণ আরও ভালোভাবে প্রচার করা।
চীনের সমাজবিজ্ঞান একাডেমির ক্লাসিক্যাল সিভিলাইজেশন রিসার্চ সেন্টারের মহাসচিব অধ্যাপক হ্য ফাং ইং বলেছেন: “ক্লাসিক আধুনিক বিশ্বে একটি ‘অন্য দৃষ্টিকোণ’-এর সমতুল্য, একটি আয়নার ভূমিকা পালন করে। ক্লাসিক সভ্যতা আমাদের নতুন অনুপ্রেরণা ও দৃষ্টিভঙ্গি দিতে পারে। একটি শুধুমাত্র একাডেমিক টাওয়ারের মধ্যে সীমাবদ্ধ জ্ঞান নয়, এটি আধুনিক বিশ্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া দরকার।”
ইতালির তুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগের ল্যাটিন ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক আন্দ্রেয়া বালবো বলেছেন: “আমাদের আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি, ক্লাসিক সভ্যতা নিয়ে আরও ভাবতে হবে। কারণ সভ্যতার উত্স নিয়ে ভাবলে তা একটি আরো শান্তিপূর্ণ ও সহনশীল বিশ্বকে গড়ে তোলার জন্য সহায়ক হবে। এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য হল বিভিন্ন ক্লাসিক সভ্যতার ভিত্তি থেকে এমন কিছু খুঁজে বের করা যা অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎকে সংযুক্ত করতে পারে।”
সম্মেলনে পাশাপাশি ৮টি সমান্তরাল সাব-ফোরামও অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে অতিথিরা ‘ক্লাসিক সভ্যতার নীতি ও চেতনা’, ‘ক্লাসিক ভাষা এবং ক্লাসিক অধ্যয়নের ঐতিহ্য’, ‘ক্লাসিক অধ্যয়ন এবং সভ্যতার মধ্যে পারস্পরিক শিক্ষা’, ‘ক্লাসিক অধ্যয়ন এবং শাস্ত্রীয় ঐতিহ্য’, ‘কনফুসিয়ানিজম এবং প্রাচীন গ্রিক দর্শনের নীতিশাস্ত্র সংলাপ’, ‘ক্লাসিক প্রজ্ঞা এবং ডিজিটাল বুদ্ধিমত্তার যুগ’, ‘ক্লাসিক অধ্যয়ন এবং মানব জাতির ভবিষ্যতের মতো বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত করে আলোচনা এবং মতবিনিম করেন।
পিকিং ইউনিভার্সিটির দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছেন সি ই বলেছেন: “ভবিষ্যত যে ধরনেরই হোক না কেন, এর মূল থাকে ক্লাসিক উত্তরাধিকারে। অনেক জনপ্রিয় সংস্কৃতির মধ্যে ক্লাসিক সাংস্কৃতিক মোটিফ বা উপাদান রয়েছে। যেমন মানুষের অবস্থা, প্রকৃতির উপর মানবজাতির প্রভাব, মানুষের নৈতিক দ্বিধা, মানুষের আত্ম-উপলব্ধি এবং অন্বেষণ, এই সমস্ত বিষয়গুলোর ওপরে প্রাচীন গ্রিকদের অনুসন্ধান এবং প্রাচীন চীনাদের অনুসন্ধানের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এমন আদানপ্রদান করলে আরও রঙিন সাহিত্য ও শৈল্পিক কাজ এবং একাডেমিক জ্ঞান অর্জন করা যায়। এটিই মানবজাতির ভবিষ্যত নির্মাণে ক্লাসিক সভ্যতার তাত্পর্য।”
প্রথম বিশ্ব ক্লাসিক সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে, ক্লাসিক গবেষণা অগ্রগতি প্রদর্শনী ৭ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণকারীদের জন্য বেইজিংয়ের ইয়ানসি লেক আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও প্রদর্শনী সেন্টারে শুরু হয়। এই প্রদর্শনীটি বিশ্ব ক্লাসিক গবেষণা ফলাফলের সংশ্লিষ্ট বই প্রদর্শন, ইন্টারেক্টিভ অভিজ্ঞতা এবং মুক্ত যোগাযোগ করা হয়। এতে চীনা এবং বিদেশী ক্লাসিক্যাল গ্রন্থ এবং গবেষণা ফলাফলের ৮ হাজারেরও বেশি বই প্রদর্শিত হয়। প্রদর্শনীটি বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উপাদানগুলোকে সম্পূর্ণরূপে একত্রিত করেছে। এতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডিজিটাল প্রকাশনা প্রযুক্তি প্রাচীন বই, বই প্রকাশ, ইত্যাদি প্রযুক্তির প্রয়োগের ফলাফল প্রদর্শিত হয়।
এই সম্মেলনটি সমৃদ্ধ বিষয়বস্তুসহ একাধিক সহায়ক কার্যক্রমেরও আয়োজন করে। ৩রা থেকে ৫ই নভেম্বর পর্যন্ত, সম্মেলনটি বিদেশী অতিথিদের শানতুং, হ্যনান এবং সিচুয়ানে ‘বিশ্ব ক্লাসিক অধ্যয়ন সম্মেলন: ভ্রমণ ও পড়াশোনা’ কার্যক্রম পরিচালনা করে। বিশেষজ্ঞদের ঘটনাস্থলে চীনা সভ্যতার উন্মুক্ত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সভ্যতাগত বৈশিষ্ট্য এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো অনুভব করতে এবং সৃজনশীল রূপান্তর ও সংস্কৃতির উদ্ভাবনী বিকাশে নিজেদের একাত্ম হতে সহায়ক হয়।
সম্মেলনটি ৬ নভেম্বর বিকেলে চীনের জাতীয় জাদুঘর থিয়েটারে একটি বিশেষ পরিবেশনাও করে। চীনের অপেরা ও নৃত্যনাট্য থিয়েটারের শিল্পীরা নৃত্যনাট্য ‘কনফুসিয়াস’ উপস্থাপন করে, কুছিন সংগীত ‘ফ্লোইং ওয়াটার’ পরিবেশন করে এবং জাতীয় বাদ্যযন্ত্র দিয়ে গ্রিসের ক্লাসিক অপেরা ‘ওদিউপাস রেক্স’, ‘বিসাইড দ্য ওলেন্ডার বাড’ এবং ‘সামহোয়ার টু গো’ পরিবেশন করে। এসব পরিবেশনার মাধ্যমে প্রাচ্য ও পশ্চিমা শিল্পরূপ মিলেমিশে একাকার।
এথেন্সের ক্লাসিক্যাল গ্রিক, হিস্ট্রি এবং ফিলোসফির এলিনিকি অ্যাগোগি-স্কুলের পরিচালক ইউজেনিয়া মানোলিডো বলেছেন: “সংগঠনটি খুবই পেশাদার, এবং অনেক অতিথীপরায়ন, এতে এতো বেশি তথ্যের বিনিময় হয়, যা আমার খুব ভাল লেগেছে। আশা করি যে গ্রিস পরের বছর এমন একটি ভাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারে, যাতে আমাদের আধ্যাত্মিক আদান-প্রদান চলতে থাকবে!”
(স্বর্ণা/হাশিম/লিলি)