এবারের পর্ব
১. থিয়ানলিন ইয়াও নকশী ঐতিহ্যের ধারক
২. লুও মিনছিন: ম্যারাথনে জীবন্ত কিংবদন্তি
৩. হালকা খাবারে ক্রেতার মন জয়
নারী ও শিশু বিষয়ক অনুষ্ঠান আকাশ ছুঁতে চাই থেকে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। কেমন আছেন আপনারা? আশাকরি ভালো আছেন।
আমাদের অনুষ্ঠানে আমরা কথা বলি নারী ও শিশুর সাফল্য, সমস্যা, সম্ভাবনা ও এগিয়ে যাওয়া নিয়ে।
আজকের অনুষ্ঠানে রয়েছে চীনের থিয়ানলিন ইয়াও নকশী ঐতিহ্যের ধারক কারুশিল্পী নারী পান হাইইয়ানের কথা। আরও রয়েছে চীনের ম্যারাথনে জীবন্ত কিংবদন্তি নারী লুও মিনছিনের গল্প। এবং হালকা খাবার দিয়ে ক্রেতাদের মন জয় করা নারী কেং সুয়ের কথা।
থিয়ানলিন ইয়াও নকশী ঐতিহ্যের ধারক
চীনের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে সমৃদ্ধ অবৈষয়িক ঐতিহ্য। বিভিন্ন রকম অবৈষয়িক ঐতিহ্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে যাচ্ছে নারীদের হাত ধরে। এমনি একটি অবৈষয়িক ঐতিহ্য হলো থিয়ানলিন ইয়াও এথনিক এমব্রয়ডারি । এই নকশীকাজের একজন ধারক বা ইনহেরিটর হলেন পান হাইইয়ান। শুনবো তার গল্প।
দক্ষিণ চীনের কুয়াংসি চুয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের বাইস্য সিটির থিয়ানলিন কাউন্টি।এখানে ইয়াও জাতির অনেক মানুষ বাস করেন।
ইয়াওদের এমব্রয়ডারি বা নকশী কাজ বিখ্যাত। থিয়ানলিন কাউন্টির ইয়াওদের নকশীকাজের আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই নকশীকাজকে থিয়ানলিন ইয়াও এথনিক এমব্রয়ডারি বলা হয়। এই বিশেষ ধরনের ইয়াও এমব্রয়ডারির একজন ধারক হলেন পান হাইইয়ান।
থিয়ানলিন ইয়াও এমব্রয়ডারিতে মূলত ইয়াও জাতির মানুষের জীবনকে ফুটিয়ে তোলা হয়।
পান হাইইয়ানের জন্ম ১৯৭০ সালে। তিনি শৈশব থেকে এই বিশেষ এমব্রয়ডারির প্রতি আগ্রহী। নিজের মা ও নানীর কাছ থেকে তিনি সুইসুতার কাজে প্রথম পাঠ নেন।
তিনি থিয়ানলিন ইয়াও এমব্রয়ডারিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন। অনেকগুলো স্টিচে তিনি রীতিমতো ওস্তাদ হয়ে ওঠেন। তিনি এক ডজনের বেশি বিশেষ নকশা তৈরি করেছেন এবং বিশেষ ধরনের কিছু নকশা নিজে উদ্ভাবন করেছেন।
এই বিশেষ কারুশিল্প যেন হারিয়ে না যায় সেজন্য তিনি নিজস্ব কারখানা স্থাপন করেছেন। সেখানে তিনি নতুন নতুন নকশাশিল্পী তৈরি করছেন। তিনি নতুন প্রজন্মের নারীদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালনা করেন।
থিয়ানলিন ইয়াও এমব্রয়ডারিতে কুয়াংসি চুয়াংয়ে বাসরত ইয়াও জাতির মানুষের ইতিহাস, তাদের জীবনধারা তুলে ধরা হয়। একজন শিল্পী প্রথমে জাতির ইতিহাস কিভাবে নকশায় ধরে রাখতে হয় সেটি শেখেন। তার নিজস্ব সুখদুঃখের কথাও বিশেষ কিছু রঙ ও নকশার মাধ্যমে তুলে ধরেন।
পান হাইইয়ান তার সুঁই সুতায় কাপড়ের বুকে ধরে রাখছেন থিয়ানলিনের ইয়াও জাতির আনন্দ বেদনার কাব্য।
প্রতিবেদন : শান্তা মারিয়া
সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
লুও মিনছিন: ম্যারাথনে জীবন্ত কিংবদন্তি
চীনের নারীরা ক্রীড়াক্ষেত্রে অনেক অগ্রসর। তবে আজ থেকে চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর আগে এমনটি ছিল না। সেসময় যে নারীরা সাহস করে এগিয়ে এসেছিলেন তাদের অন্যতম লুও মিনছিন। এই সাহসী নারীর কথা শুনবো প্রতিবেদনে।
লুও মিনছিন চীনের ম্যারাথন দৌড়ের ক্ষেত্রে এক জীবন্ত কিংবদন্তি। চীনের ম্যারাথন দৌড়ে প্রথম দিকে অংশ নেয়া সাহসী নারীদের অন্যতম লুও মিনছিন। ১৯৮১ সালে থিয়ানচিন ম্যারাথনের উদ্বোধনীতে অংশ নেন লুও। তখন তার বয়স ২৫ বছর। তিনি সে সময় থিয়ানচিনের একটি মিডল স্কুলে ফিজিকাল এডুকেশন টিচার ছিলেন। তিনি ৫০০০ মিটার রেসে অংশ নিয়েছিলেন। তবে তার তেমন কোন ধারণাই ছিল না যে ৪০ কিলোমিটার ম্যারাথন দৌড় কিভাবে দৌড়াতে হয়।
কৌতুহল থেকেই মূলত তিনি থিয়েনচিনের উদ্বোধনী ম্যারাথনে নাম লেখান। প্রথম ২০ কিলোমিটার তিনি একদল পুরুষের সঙ্গে বেশ ভালোই দৌড়াচ্ছিলেন। পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পেরে তার বেশ ভালোই লাগছিল। তবে ৩০ কিলোমিটার পার হওয়ার পর তার শরীর ভীষণ খারাপ লাগতে থাকে। বমি হতে থাকে, পা মনে হয় সীসার মতো ভারী হয়ে গেছে।
তাকে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানোর জন্য চিকিৎসকরা এগিয়ে আসেন। কিন্তু তিনি রাজি হন না। ভীষণ কষ্ট করে, মনের জোর ধরে রেখে তিনি ফিনিশ লাইনের দিকে এগিয়ে যান এবং শেষ পর্যন্ত ফিনিশ লাইন স্পর্শ করেন। তিনি ওই ম্যারাথনের প্রথম নারী যিনি ফিনিশ লাইন টাচ করেন।
৪৩ বছর আগে চীনের খুব কম নারীই ম্যারাথনে অংশ নিতেন। তবে ম্যারাথন দৌড়কে ভালোবেসে ফেলেন লুও। তিনি ম্যারাথন দৌড়ের একজন বিখ্যাত রানার হয়ে ওঠেন।
তবে ম্যারাথন দৌড় বিষয়ে বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ, পুষ্টি, যত্ন এগুলো বিষয়ে তার তেমন কোন আইডিয়া ছিল না। ফলে তার শরীরে অনেক ক্ষতি হয়েছে। অনেক ইনজুরিও হয়েছে। পড়ে গিয়ে অনেকবার ব্যথা পেয়েছেন। স্কুলের পুল আপ বার থেকে পড়ে গিয়ে তার হাঁটুর জয়েন্ট ফ্রাকচার হয়। ফলে আগের মতো আর ম্যারাথন দৌড়াতে পারেন না। এখন তিনি ১০ কিলোমিটার ও ৫ কিলোমিটার ম্যারাথন রেসে অংশ নেন। তার বয়স এখন ৬৮ বছর। তবে পরিকল্পনা রয়েছে ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আবার পূর্ণ দূরত্ব ম্যারাথনে দৌড়াবেন তিনি।
লুও মিনছিন এখন ম্যারাথনে নারীদের জন্য এক অনুপ্রেরণার নাম। তিনি নিজের জীবনকেও একটি ম্যারাথন দৌড়ের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি মনে করেন প্রত্যেকের জীবনই একটি ম্যারাথন দৌড়। সেখানে অনেক কষ্ট ও বাধাবিঘ্ন থাকে। তবে ধৈর্য ধরে কষ্টের সঙ্গে লক্ষ্যের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে হয়।
প্রতিবেদন: শান্তা মারিয়া
সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
হালকা খাবারে ক্রেতার মন জয়
ফুচিয়ানের সিয়ামেন সিটি। এখানে একটি রেস্টুরেন্ট খুলেছেন কেং সুয়ে নামের এক নারী। তার রেস্টুরেন্টের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। কি বিশেষত্ব রয়েছে কেং সুয়ের? চলুন শোনা যাক সেই গল্প।
সমুদ্র সৈকতে চমৎকার একটি রেস্টুরেন্ট। গাছের ছায়ায় এখানে বসে উপভোগ করা যায় সাগরের দৃশ্য। পূর্ব চীনের ফুচিয়ান প্রদেশের সিয়ামেন সিটির সমুদ্র উপকূলে সাড়ে তিনতলা একটি দৃষ্টিনন্দন ভিলা। ভবনের সামনে একটি সাইনবোর্ড। লেখা আছে এখানে গরম গরম চাইনিজ হালকা খাবার পরিবেশন করা হয়। এই রেস্টুরেন্ট চালান একজন নারী। কেং শুয়ের বয়স ৫৫ বছর। তার রেস্টুরেন্টের বৈশিষ্ট্য হলো এখানে হালকা স্বাস্থ্যসম্মত মুখরোচক খাবার পরিবেশন করা হয়।
কেং এর মেন্যুতে রয়েছে সয়া সস চিকেন এবং মংক-ফ্রুট-ব্রেইজড বিফের মতো জনপ্রিয় খাদ্য। কেং স্থানীয় জনপ্রিয় কুইজিনগুলোকে স্বাস্থ্যসম্মত এবং হালকাভাবে পরিবেশন করেন। তিনি এমন সব উপাদান ব্যবহার করেন যা কম ক্যালোরির। পুষ্টিমান বেশি হবে, খাবারটি হালকা হবে আবার মুখরোচকও হবে। এটাই তার রেস্টুরেন্টের মূল বৈশিষ্ট্য।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা অনেক বেড়েছে। তারা এখন হালকা অথচ পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খোঁজেন। এই বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন কেং। তিনি জিরো ফ্যাট খাবার তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি ওয়েস্টার্ন খাবারের পরিবর্তে ঐতিহ্যবাহী চীনা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার বেছে নিচ্ছেন। কেং এর রেস্টুরেন্টে খাবারের দামও কম।
তিনি ২০২৩ সালে কুনমিংয়ে একটি হালকা নুডুলস শপ খুলেছেন। আবার পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে সিয়ামেনে রেস্টুরেন্ট বা লাইট ইটারি দিয়েছেন।
সিয়ামেনে তার চালিত ইটারির সাতমাস চলছে। এখানে তিনি ৪০ থেকে ৬০ পদের খাবার দিনে পরিবেশ করেন। ৩০ ইউয়ানে একজন মানুষ মোটামুটি পেট ভরে হালকা খাবার খেতে পারে। আগামি ১০ বছরের মধ্যে তার ব্যবসা সারা চীনে ছড়িয়ে দেয়ার আশা রাখেন কেং। তার দোকানে খাবার তুলনামূলকভাবে সস্তা হওয়ায় মানুষ বেশি আসে। তিনি এজন্য করপোরেট এলাকায় নয় বরং কমিউনিটির মধ্যে দোকান খুলেছেন যেখানে সাধারণ মানুষ কাজের ফাঁকে লাঞ্চ করতে আসবে।
প্রতিবেদন: শান্তা মারিয়া
সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠান শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছি আমরা। আগামি অনুষ্ঠানে শোনার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় নিচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন চাই চিয়েন।
সার্বিক সম্পাদনা : ইয়ু কুয়াং ইউয়ে আনন্দী
লেখা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: শান্তা মারিয়া
অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ