৯৪তম পর্বে যা থাকছে:
১। প্লাস্টিক খেয়ে ফেলবে মিলওয়ার্ম, পৃথিবী হবে দূষণমুক্ত
২। নিজে নিজে পরিষ্কার হতে সক্ষম ইলেক্ট্রোড
৩। চীন প্রণয়ন করল স্টেম সেল গবেষণার আন্তর্জাতিক মান
প্লাস্টিক খেয়ে ফেলবে মিলওয়ার্ম, পৃথিবী হবে দূষণমুক্ত
কেনিয়ার নাইরোবিভিত্তিক আন্তর্জাতিক কীটবিজ্ঞান ও ইকোলজি কেন্দ্রের (আইসিআইপিই) একদল বিজ্ঞানী খুবই ছোট এক ধরনের কীট বা মিলওয়ার্ম নিয়ে গবেষণা করেছেন। গবেষণায় এই বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, এই কীটগুলো প্লাস্টিক খেয়ে ফেলতে পারে! অর্থাৎ, আমাদের চারপাশে পড়ে থাকা প্লাস্টিকগুলো এই পোকাগুলোর খাবার হতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই আবিষ্কারের ফলে পৃথিবী থেকে প্লাস্টিকের দূষণ কমাতে সাহায্য করবে।
ডার্কলিং বিটল নামে এক ধরনের কীট লার্ভা রয়েছে, যার বৈজ্ঞানিক নাম আলফিটোবিয়াস। মূলত এই লার্ভাগুলো প্লাস্টিক খেয়ে ফেলতে পারে! এই আবিষ্কারের ফলে হয়তো একদিন আমরা প্লাস্টিকের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারি।
আন্তর্জাতিক কীটবিজ্ঞান ও ইকোলজি কেন্দ্রের জেষ্ঠ্য বিজ্ঞানী এবং প্রধান গবেষক ফাথিয়া খামিস জানান, তারা মিলওয়ার্মের অন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাকটেরিয়ার একটি কনসোর্টিয়াম চিহ্নিত করেছেন যা প্লাস্টিক হজম করতে সহায়তা করে। যদিও প্রায়শই সাধারণ কৃমির সঙ্গে ভুল করে এদের তুলনা করা হয়, মিলওয়ার্মগুলো ডার্কলিং বিটলের লার্ভা। প্রথমবারের মতো আফ্রিকান এ ছোট মিলওয়ার্মের প্লাস্টিক খেয়ে ফেলার সক্ষমতা রেকর্ড করা হয়েছে।
যদিও আফ্রিকা বিশ্বের মাত্র ৫ শতাংশ প্লাস্টিক উৎপন্ন করে এবং এর মাত্র ৪ শতাংশ ব্যবহার করে, তবে মহাদেশটিতে একক ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে মহাদেশটি দ্বিতীয় সর্বাধিক দূষিত হয়ে পড়েছে।
বিজ্ঞানীরা ছোট মিলওয়ার্মের পলিস্টাইরিন খাওয়ার ক্ষমতা পরীক্ষা করেছেন, পলিস্টাইরিন হল এক ধরনের প্লাস্টিক যা খুব ছোট ছোট টুকরো হয়ে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।
আইসিআইপির পরিচালক জেনারেল আব্দৌ টেনকোয়ানো জানান, নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে বৃত্তাকার অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, প্লাস্টিকের সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি একে গবাদিপশুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আইসিআইপি গবেষণা আরও ভালো জৈবপ্রতিকার পদ্ধতি তৈরি করতে সাহায্য করছে। ফলে দূষিত পরিবেশকে আরও দ্রুত এবং কার্যকরভাবে পরিষ্কার করতে পারবো।
বর্তমানে এই গবেষকরা মিলওয়ার্মগুলোর পলিস্টাইরিন গ্রহণের প্রক্রিয়া এবং এর থেকে কোনও পুষ্টিগত সুবিধা অর্জন করে কিনা তা বুঝতে অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালনা করছে।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
নিজে নিজে পরিষ্কার হতে সক্ষম ইলেক্ট্রোড
চীনের বিজ্ঞানীরা একটি বিশেষ ধরনের ইলেক্ট্রোড তৈরি করেছেন, যা নিজে থেকে পরিষ্কার হতে সক্ষম। এই ইলেক্ট্রোডটি তৈরি করতে তারা একটি খুব ছোট কিন্তু শক্তিশালী অনুঘটক ব্যবহার করেছেন। এই অনুঘটকটি একটি বিশেষ ধরনের উপাদান অর্থাৎ ক্ষারীয়-আর্থ মেটাল পারক্সাইড তৈরি করতে সাহায্য করে, যা খুব স্থিতিশীল। এই নতুন ইলেক্ট্রোডটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক দিন ধরে কাজ করতে পারবে। বিশেষ করে ব্যাটারি, সেন্সর ইত্যাদি, ব্যবহার করা যেতে পারে।
সম্প্রতি নেচার ন্যানোটেকনোলজিতে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
ক্ষারীয়-আর্থ মেটাল পারক্সাইড হলো হাইড্রোজেন পারক্সাইডের বিকল্প। চাইনিজ একাডেমি অফ সায়েন্সেস এবং শাংহাই চিয়াওথোং ইউনিভার্সিটির নিংবো ইনস্টিটিউট অফ মেটেরিয়ালস টেকনোলজি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এর গবেষকদের মতে আর্থ মেটাল পারক্সাইডের চমৎকার অক্সিডেটিভ বৈশিষ্ট্য, উচ্চতর রাসায়নিক স্থিতিশীলতা এবং উচ্চ বিশুদ্ধতা রয়েছে। পাশাপাশি এটি সংরক্ষণ এবং পরিবহন করা সহজ। এই জাতীয় উপাদান বর্জ্য পানি পরিশোধন এবং জীবাণুমুক্তকরণে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
বর্তমানে হাইড্রোজেন পারক্সাইড তৈরির প্রক্রিয়ায় একটি বড় সমস্যা হলো এই রাসায়নিকটি খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। এই দ্রুত পচনের ফলে অনেক হাইড্রোজেন পারক্সাইড নষ্ট হয়ে যায় এবং এর ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। এছাড়াও, এই রাসায়নিকটি পরিবহন ও সংরক্ষণের সময় বিস্ফোরণের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। এই সমস্যার সমাধানে গবেষকরা একটি নতুন পদ্ধতির প্রস্তাব করেছেন। এই পদ্ধতিকে বলা হয় "ইন-সিটু ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল সংশ্লেষণ"। এই পদ্ধতিতে হাইড্রোজেন পারক্সাইডকে তৈরি করা হয় এবং একই সাথে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ, হাইড্রোজেন পারক্সাইডকে তৈরি করার পর তা সংরক্ষণ করে রাখতে হয় না, বরং তা তৈরি হওয়ার সাথে সাথে ব্যবহার করা হয়।
এই নতুন ইলেক্ট্রোডে টেফলন আবরণ দেওয়া হয়েছে এবং এর পৃষ্ঠতলকে খুব ছোট ছোট গর্ত ও ছিদ্র দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। এছাড়াও, এই ইলেক্ট্রোডে নিকেল-ডোপড অক্সিজেনযুক্ত কার্বন ব্যবহার করা হয়েছে যা এই পদার্থের আঠালো ভাব কমিয়েছে। বিজ্ঞানীরা ইলেক্ট্রোডকে এমনভাবে তৈরি করার চেষ্টা করছেন যাতে করে ইলেক্ট্রোডের উপর কোনো আবরণ জমতে না পারে অথবা খুব সহজেই পরিষ্কার হয়ে যায়। এতে করে ইলেক্ট্রোডের কার্যক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে।
এই নতুন ইলেক্ট্রোডের আবিষ্কার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এই ইলেক্ট্রোডটি ব্যবহার করে আরও দক্ষ এবং পরিবেশবান্ধব ব্যাটারি তৈরি করা সম্ভব হবে। এছাড়াও, এই ইলেক্ট্রোডটি ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের সেন্সর তৈরি করা যাবে। চীনের বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কার বিশ্বকে একটি নতুন দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
|| প্রতিবেদন: ফয়সল আবদুল্লাহ
|| সম্পাদনা: শুভ আনোয়ার
চীন প্রণয়ন করল স্টেম সেল গবেষণার আন্তর্জাতিক মান
চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে দেখা হয় স্টেম সেল সংক্রান্ত গবেষণা। তবে, এই ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরী ছিল। সম্প্রতি চীনের বিজ্ঞানীরা স্টেম সেল সম্পর্কিত তথ্যগুলোকে আরও সঠিক এবং সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করার জন্য বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক মান ‘আইএসও৮৪৭২-১’ প্রকাশ করেছেন। চীনের বিজ্ঞান একাডেমির প্রাণীবিদ্যা ইন্সটিটিউট এ তথ্য জানিয়েছে।
স্টেম সেল হলো এমন এক কোষ, যেটা থেকে তৈরি হতে পারে একাধিক ও নানারকম কোষ। গাছের কাণ্ড থেকে যেমন বেড়ে ওঠে শাখা প্রশাখা, যারা নিজস্ব স্বকীয়তায় বিস্তৃত হয়, এই কোষও ঠিক সেরকম। স্টেম সেলের মূল কাজ হলো শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামত করা। যখন কোন অঙ্গ বা টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন স্টেম সেল সেখানে গিয়ে নতুন কোষ তৈরি করে এবং ক্ষতিগ্রস্ত অংশকে পুনরুদ্ধার করে।
স্টেম সেল মূলত দুই ধরনের হয়, ভ্রূণ স্টেম সেল: এটি একটি নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে উৎপন্ন হয় এবং শরীরের যে কোনও ধরনের কোষে পরিণত হতে পারে। অন্যটি হলো প্রাপ্তবয়স্ক স্টেম সেল: এটি শরীরের বিভিন্ন অংশে পাওয়া যায় এবং নির্দিষ্ট ধরনের কোষে পরিণত হতে পারে।
ইন্সটিটিউটের মতে, স্ট্যান্ডার্ডটি বিশ্বব্যাপী স্টেম সেল ডেটা ম্যানেজমেন্টকে আরও উন্নত করবে এবং স্টেম সেল গবেষণা এবং এর ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জৈবপ্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি এবং স্টেম সেল গবেষণার বৃদ্ধির সাথে সাথে স্টেম সেল ডেটা এক বিশাল সম্পদে পরিণত হয়েছে। এই ডেটা মানব স্বাস্থ্যের উন্নতি, নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার এবং বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় বিপ্লব ঘটাতে পারে। কিন্তু এই বিশাল সম্ভাবনার পাশাপাশি একটি বড় চ্যালেঞ্জও দেখা দিয়েছে, তা হল স্টেম সেল ডেটার জন্য আন্তর্জাতিক মানের অভাব।
স্টেম সেলের বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক মান ‘আইএসও৮৪৭২-১’ টি চীনের নেতৃত্বে জাপান, কোরিয়া প্রজাতন্ত্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং অন্যান্য দেশের বিশেষজ্ঞরা যৌথভাবে প্রণয়ন করেছে। স্টেম সেল গবেষণা সম্পর্কিত ডাটাবেস, ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, ওয়েব ইন্টারফেস এবং আরও অনেক কিছুর জন্য প্রযোজ্য হবে এই মান।
প্রাণীবিদ্যা ইন্সটিটিউটের পরিচালক ছিয়াও কেসিয়া জানান, আইএসও৮৪৭২-১ মানটি স্টেম সেল গবেষণায় ব্যবহৃত ডেটাকে কীভাবে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশাবলী দেবে। সহজ কথায়, এটি একটি নির্দিষ্ট নিয়মকানুন যা সারা বিশ্বের সব স্টেম সেল গবেষণার ক্ষেত্রে অনুসরণ করতে হবে।
চীনের বিজ্ঞানীদের এই অবদান স্টেম সেল গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। ভবিষ্যতে স্টেম সেল চিকিৎসা অনেক রোগের জন্য একটি কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়।
নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।
প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার
অডিও সম্পাদনা- নাসরুল্লাহ রাসু
স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- ফয়সল আবদুল্লাহ
সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী