সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এবং সংরক্ষণের কথা সি চিন পিং যেভাবে বলেছেন
2024-11-01 18:46:44

 

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বহুবার চীনা সংস্কৃতির প্রতি আস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর জোর দিয়েছেন, তিনি বিশ্ব সভ্যতা উদ্যোগ উত্থাপন করেছেন, এবং এর মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিনিময় বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছেন।

 

গত ২৭শে জুলাই, নয়াদিল্লিতে ইউনেস্কোর বিশ্ব উত্তরাধিকার কমিশনের ৪৬তম অধিবেশনে, চীনের রাজধানীর আদর্শ শৃঙ্খলার প্রতীক বেইজিং সেন্ট্রাল এক্সিস (Beijing Central Axis) আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব উত্তরাধিকার তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে।

 

এই স্বীকৃতি শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় এক্সিসের স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের বহিঃপ্রকাশই নয়, বরং চীনের সাংস্কৃতিক সম্পদ ও সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় বিশ্বের উপলব্ধিও তুলে ধরে। চীনে এখন ৫৯টি বিশ্ব উত্তরাধিকার আছে, যা বিশ্বের দ্বিতীয় স্থান এবং বেইজিং বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক বিশ্ব উত্তরাধিকার স্থানের শহর হিসেবে স্বীকৃত।

 

ইউনেস্কোর পূর্ব এশিয়া কার্যালয়ের মহাপরিচালক শাহবাজ খান বলেন, "চীন প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণে তার প্রতিশ্রুতি দেখিয়েছে। বিশেষ করে, ১৯৮৫ সালে বিশ্ব উত্তরাধিকার কনভেনশনে যোগদানের পর থেকে চীনের বিভিন্ন স্থানে ৫৯টি আশ্চর্যজনক উত্তরাধিকার দেখা গেছে। এটি চীন ও বিশ্বের জন্য একটি বিস্ময়কর অর্জন।"

২০২৪ সালের নববর্ষের শুভেচ্ছাবাণীতে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছেন, "চীন একটি মহান সভ্যতার দেশ। চীনের সুদীর্ঘ ইতিহাস এবং দুর্দান্ত সভ্যতা হলো আমাদের আত্মবিশ্বাস ও শক্তির উত্স।"

 

চীনের সভ্যতার একটি প্রমাণ হলো, পূর্ব চীনের ইয়াংজি নদীর ডেল্টায় অবস্থিত লিয়াংচুর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। এই ধ্বংসাবশেষগুলো শেষ নিওলিথিক সময়পর্বে চীনে ধান চাষের উপর ভিত্তি করে একটি ঐক্যবদ্ধ বিশ্বাস ব্যবস্থার একটি প্রাথমিক অবস্থা প্রকাশ করে।

 

চাল, চীনের একটি প্রধান ফসল, ১০ হাজার বছর আগে থেকে চাষ করা হচ্ছে। লিয়াংচুর কাছাকাছি শাংশান উত্তরাধিকার স্থানে, প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিশ্বের প্রাচীনতম পরিচিত ধানের দানা খুঁজে পেয়েছেন, যা চীন ও তার বাইরেও ধান চাষের বিস্তার চিহ্নিত করেছে।

 

লিয়াংচুতে ৫ হাজার বছর আগের পুড়িয়ে যাওয়া শস্য উন্মোচিত হয়েছিল। যার ওজন প্রায় ২০০ টন- এটি সমৃদ্ধ, টেকসই সম্প্রদায়ের প্রমাণ।

 

চ্য চিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ট অ্যান্ড আর্কিওলজি ইন্সটিটিউটের লিউ বিন বলেন, ‘৫ হাজার বছরেরও আগে, প্রাচীন মিশর ও ভারতে নদীর তীরে সমাজের উদ্ভব হয়েছিল এবং তাদের মতো লিয়াংচুতে একই রকম একটি রাষ্ট্রীয় স্তরের সমাজ ছিল।’

 

হেডপিস, নেকলেস, ব্রেসলেট সহ হাজার হাজার জেড নিদর্শনও এই সমাধি থেকে পাওয়া গেছে। নিছক অলঙ্কার ছাড়া, এই বস্তুগুলো আচার-অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করত, যা লিয়াংচু সমাজের বিশ্বাস ব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক পরিশীলতাকে প্রতিফলিত করে।

 

এই প্রারম্ভিক নগর সভ্যতার উন্নত প্রকৃতি চিত্তাকর্ষক মাটির স্মৃতিস্তম্ভ, পাথরের হাতিয়ার এবং মৃৎপাত্রের দ্বারা আরও প্রমাণিত হয়, এর সাথে এর অত্যন্ত সংগঠিত নগর পরিকল্পনা, অত্যাধুনিক জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং একটি সুস্পষ্ট সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস ছিল, যেমনটি কবরস্থানের মধ্যে পৃথক সমাধিতে দেখা যায়।

 

২০১৯ সালে, লিয়াংচুর প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা লাভ করে, যাকে "প্রাগৈতিহাসিক প্রাথমিক রাজ্য এবং নগর সভ্যতার একটি শ্রেষ্ঠ উপস্থাপনা" হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এই স্বীকৃতি ৫ হাজার বছর আগ শুরু হওয়া চীনা সভ্যতাকে জানার একটি জানালার মতো।

যাই হোক, এই বৈশ্বিক স্বীকৃতির আগেই, লিয়াংচু বিশ্বব্যাপী শীর্ষ প্রত্নতাত্ত্বিকদের মনোযোগ কেড়েছিল, যার মধ্যে কলিন রেনফ্রু, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রখ্যাত অধ্যাপক এমেরিটাস ছিলেন।

 

তিনি বলেন, ‘লিয়াংচু একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান, কারণ এটি আমাদের প্রায় এক হাজার বছর আগে নিয়ে যায়, যা চীনের প্রথম সভ্যতা হতে পারে।’

 

দুই দশক আগে চ্য চিয়াং প্রাদেশিক সরকারের প্রচেষ্টা ছাড়া লিয়াংচুর ধ্বংসাবশেষ হয়তো বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেত না।

২১ শতাব্দীর শুরুতে, লিয়াংচু উত্তরাধিকার স্থানের কাছে প্রায় ৩০টি খনন কার্যক্রম ছিল, যা ভারী শিল্পের দূষণ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ২০০৩ সালের গ্রীষ্মে পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে শুরু করে, যখন চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) এর চ্য চিয়াং প্রাদেশিক কমিটির তত্কালীন সম্পাদক সি চিন পিং স্থানটি পরিদর্শন করেন। তিনি এর তাৎপর্য স্বীকার করেছেন, উল্লেখ করেছেন যে লিয়াংচু ছিল ৫ হাজার বছরের পুরনো চীনা সভ্যতার স্পষ্ট প্রমাণ।

 

কয়েক বছর পর ২০১৬ সালে, সি চিন পিং বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে একটি চিঠিতে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ রক্ষার গুরুত্বের উপর জোর দেন। তিনি জোর দিয়েছিলেন যে কীভাবে এই স্থানগুলো চীনের দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং চীনা সভ্যতার মূল্য সম্পর্কে আমাদের বোঝার গভীরতা তৈরি করে।

 

লিয়াংচু ধ্বংসাবশেষের সংরক্ষণ সভ্যতার উৎপত্তি খুঁজে বের করার জন্য চীনের বৃহত্তর প্রচেষ্টার মাত্র একটি দিক। ২০২২ সালে, সি চিন পিং বলেছিলেন যে, এই ধরনের প্রচেষ্টা চীনা সভ্যতার বিবর্তন এবং এর বহুত্ববাদী ও সমন্বিত প্যাটার্নের কাঠামোকে স্পষ্ট করে দিয়েছে।

 

চীনের প্রাচীন ও গভীর ইতিহাস সম্পর্কে এই ক্রমবর্ধমান সচেতনতা চীনা সংস্কৃতির প্রতি আরও বেশি আস্থা বাড়াচ্ছে।

 

সি চিন পিং বারবার অটুট সাংস্কৃতিক আস্থা বজায় রাখার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন, এটিকে জাতীয় গর্ব এবং পরিচয়ের জন্য অপরিহার্য হিসেবে দেখেছেন।

 

একবার তিনি বলেছিলেন যে, "সংস্কৃতি একটি দেশ ও জাতির চেতনা। সংস্কৃতির বিকাশ ঘটলে তবেই দেশ এগিয়ে যায়, সংস্কৃতি শক্তিশালী হলেই জাতি শক্তিশালী হবে। সংস্কৃতির প্রতি পূর্ণ আস্থা না থাকলে, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি থাকবে না,  চীনা জাতি নিজেকে নতুন করে তুলতে পারবে না।”

 

২০২৩ সালে, প্রথম লিয়াংচু ফোরামে অভিনন্দন বাণী পাঠিয়ে সি চিন পিং বিভিন্ন পক্ষকে ভালোভাবে লিয়াংচু ফোরামের ভূমিকা কাজে লাগানো, বিশ্ব সভ্যতা উদ্যোগ বাস্তবায়ন, এবং সভ্যতার পারস্পরিক  বিনিময় ও শেখা জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছেন।

 

সি চিন পিং বিশ্ব সভ্যতা উদ্যোগ ২০২৩ সালের মার্চ মাসে উত্থাপন করেছেন, সভ্যতার বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও উদ্ভাবন, মানবতার সাধারণ মূল্যবোধ এবং জনগণের মধ্যে বিনিময়ের মাধ্যমে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়েছে।

 

ইউনেস্কোর পূর্ব এশিয়া কার্যালয়ের মহাপরিচালক শাহবাজ খান বলেন, "এই উদ্যোগটি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। বৈশ্বিক সভ্যতা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং-এর চিন্তাভাবনার ভিত্তি হল, যদি একটি বাগানে একটি ফুল থাকে, তাহলে বসন্ত হবে না। আমাদের সব ফুল থাকতে হবে। তা সত্যিকারের বাস্তব বসন্ত।"

 

সাংস্কৃতিক বিনিময়ে চীনের প্রতিশ্রুতি  নতুন নয়। এর একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যা প্রাচীন যুগ থেকে এসেছে। পশ্চিম বিশ্বে চাং ছিয়ানের কূটনৈতিক মিশন থেকে শুরু করে, বৌদ্ধ শিক্ষার জন্য জুয়ানজাং-এর অনুসন্ধান, মার্কো পোলোর চীন ভ্রমণ থেকে শুরু করে পশ্চিমে চেংহ্য-এর সাতটি যাত্রা পর্যন্ত, চীন সর্বদা বিশ্বের সাথে সংযোগ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে, বিশ্বব্যাপী তার ভূমিকা রয়েছে।

 

বিশ্বব্যাপী জাদুঘরগুলোর মধ্যে চলমান সাংস্কৃতিক বিনিময় একটি ভালো উদাহরণ। চীনের শাংহাই শহরে, প্রাচীন মিশরের বিভিন্ন সময়ের প্রায় ৮০০টি নিদর্শন নিয়ে একটি প্রদর্শনী চীন ও মিশরের মধ্যে ঐতিহাসিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করেছে।

 

শাংহাই জাদুঘরে, "অন টপ অফ দ্য পিরামিড: দ্য সিভিলাইজেশন অফ অ্যানসিয়েন্ট ইজিপ্ট" শিরোনামের প্রদর্শনীটি সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটি অসাধারণ প্রদর্শন।

 

৭৮৮টি শিল্পকর্মের ৯৫ শতাংশেরও বেশি অংশ প্রথমবারের মতো এশিয়ায় দেখানো হচ্ছে, যা ফারাওদের বিশ্ব অন্বেষণ করার একটি বিরল সুযোগ প্রদান করে।

 

১৯ জুলাইয়ের সর্বজনীন উদ্বোধনের প্রথম মাসের মধ্যে, প্রদর্শনীটি প্রায় ৩.২ লাখ দর্শক আকর্ষণ করেছিল।

 

প্রদর্শনীর সাংগঠনিক সদস্যের অন্যতম একজন, ইয়ান হাই ইং বলেন, ‘এই প্রদর্শনীটি প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার একটি ব্যাপক পরিচিতি প্রদান করে। এটি একটি চীনা দৃষ্টিকোণ এবং স্থানীয় মিশরীয় গবেষকদের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাচীন মিশরকেও উপস্থাপন করে। চীনা দৃষ্টিকোণের মাধ্যমে নিদর্শনগুলো শেয়ার করে নেওয়া সভ্যতার মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার জন্য বিশেষ তাত্পর্য রাখে।"

 

রামসেস দুই-এর মতো বিখ্যাত ফারাওদের মূর্তি, মমি এবং জটিলভাবে ডিজাইন করা গয়না-সহ শিল্পকর্মগুলো কেবল প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতিই নয়, মিশর ও চীনের মধ্যে গভীরতর সাংস্কৃতিক সম্পর্ককেও উপস্থাপন করে। দুটি সভ্যতা প্রথম রেশম পথ ধরে একে অপরের মুখোমুখি হয়েছিল এবং এই প্রদর্শনীটি সেই ঐতিহাসিক সংলাপের আধুনিক দিনের সম্প্রসারণ হিসেবে কাজ করে।

 

প্রত্নতাত্ত্বিক পরিষদের মহাসচিব মোহাম্মদ ইসমাইল খালেদ বলেন, ‘প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার প্রতিটি অংশ চীনা জনগণকে দেখানো সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার। তাদের মধ্যে কয়েকটি সম্প্রতি ২০২০ সালে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এটি প্রথমবার জনসাধারণের কাছে প্রদর্শিত হয়েছে। এটি চীনের সাথে আমাদের গভীর সম্পর্ক তুলে ধরে। শাংহাই একটি সূচনা,  চীনের বিভিন্ন জাদুঘর থেকে আরও বেশি নিদর্শন এবং আরও প্রদর্শনীর জন্য আমরা আমন্ত্রণ পেয়েছি।’

 

প্রদর্শনীটি ১৩ মাস ধরে চলবে, যেখানে এই দুটি সভ্যতার মধ্যে বিনিময় গভীর করার লক্ষ্যে বিস্তৃত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। চীন ও মিশরের মধ্যে গভীর বোঝাপড়া এবং সংযোগ বৃদ্ধি করে বিশ্বজুড়ে দর্শকরা এই ঐতিহাসিক বিনিময়ের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবেন।

 

এই ধরনের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান সভ্যতার মধ্যে গভীর বোঝাপড়া এবং সংযোগ বৃদ্ধি করে, একটি উন্নত সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করবে।

 

সি চিন পিং ২০২৩ সালের ২ জুন, চীনের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার উন্নয়ন আলোচনা সভায় বলেছিলেন, "এখন একটি নতুন সূচনা বিন্দুতে, আমাদের অবশ্যই একটি সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির পাশাপাশি একটি আধুনিক চীনা সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে। এগুলো নতুন যুগে আমাদের নতুন সাংস্কৃতিক কর্তব্য।"

 

(শুয়েই/তৌহিদ/জিনিয়া)