পারিবারিক শিক্ষা মানুষের বড় হওয়ার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে। বাচ্চা যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন কথা বলতে পারে না, হাঁটতে পারে না, জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় গুণই তার থাকে না। তাদেরকে ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে হয় এবং এক্ষেত্রে পিতামাতা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা অতি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকেন। অধিকাংশ বাবা-মা আশা করেন, বাচ্চা দ্রুত সবকিছু শিখে ফেলবে, নিজের কাজগুলো নিজে করা শিখবে। তবে, আসলে বিষয়টা অতো সহজ নয়। বাচ্চারা ধীরে ধীরে সবকিছু শেখে। আর এ জন্য পিতামাতাকে ধৈর্য ধরতে হবে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা বাচ্চাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনী প্রশিক্ষণ ও এর কার্যকর প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করবো।
সম্প্রতি বেইজিং মহানগরের সিনিয়র পারিবারিক শিক্ষা-বিশেষজ্ঞদের সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা বলেন সংবাদদাতারা। অনেক পিতামাতার প্রশ্ন: বাচ্চারা বড় হবার পরও কেন বড়দের ওপর নির্ভরশীল থাকবে? কোনো কোনো বাবা-মার অভিযোগ, বাচ্চাকে কাজের সঠিক পদ্ধতি বুঝিয়ে দেওয়ার পরও তারা সেটা শিখতে চায় না। আধুনিক সমাজে বাচ্চাদের নিয়ে এমন সমস্যায় অনেক পিতামাতাকেই পড়তে দেখা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে: এর মূল কারণ কী?
এ সম্পর্কে বেইজিং তংছেং এলাকার পারিবারিক শিক্ষাবিষয়ক শীর্ষ পরামর্শক ছেন ইউয়ে বলেন, যখন বাচ্চারা সমস্যা বা চ্যালেঞ্জের মুখে কষ্ট পায়, তখন পিতামাতার উচিত তাদের সঠিক নির্দেশনা ও পরামর্শ দেওয়া। যথাযথ উত্সাহব্যঞ্জক কথা দিয়ে তাদের সাহায্য করতে হবে, যা খুবই কার্যকর। যদি ভুল পদ্ধতি শেখানো হয়, তাদের অতিরিক্ত সমালোচনা করা হয়, বা শাস্তি দেওয়া হয়, তখন বাচ্চাদের জন্য বিষয়টা আরও কঠিন হয়ে যায়; তারা তখন আরও বেশি ভয় পেয়ে যায়।
একটি বিষয় বাবা-মাকে খেয়াল রাখতে হবে যে, ছোটবেলায় বাচ্চাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা দুর্বল থাকে এবং চোখ ও হাতের সমন্বয়ের ক্ষেত্রেও তারা বেশ দক্ষ থাকে না। তাই বিভিন্ন কাজ বা জীবনযাপনের দক্ষতা শেখার সময় তাকে বেশি চর্চা করতে হয়। এ সময় তাদের পক্ষে ভুল করা স্বাভাবিক। তখন তাদেরকে বকাবকি করা বা শাস্তি দেওয়া ঠিক নয়। তাদেরকে বরং উত্সাহ দিতে হবে, নিজের খাবার নিজে খেতে উত্সাহিত করতে হবে, নিজের খেলনা ঠিক জায়গায় রাখার পদ্ধতি শেখাতে হবে, নিজে নিজে কাপড় পরাকে উত্সাহিত করতে হবে। এভাবে বাচ্চারা একসময় নিজেদের কাজ নিজেরা করতে এক ধরনের দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হবে।
পরিবারে দাদা-দাদী বা নানা-নানীরা বাচ্চাকে ‘অতিরিক্ত সাহায্য’ দিতে আগ্রহী থাকে। তাঁদের দৃষ্টিতে বাচ্চারা নিজেরা কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট করে, বড়দের সাহায্য তাদের দরকার। খাওয়ার পর নিজে হাত ধুতে গেলে বাচ্চা নিজের কাপড়চোপড়ও ভিজিয়ে ফেলতে পারে, তখন হাত ধোয়ার পাশাপাশি কাপড়ও ধুতে হয়। আবার কাপড় পরতে গিয়ে বাচ্চা উল্টো করে পরতে পারে, তাদের দৃষ্টিতে তা সময়ের অপচয় বৈ আর কিছু নয়। বিশেষ করে, সকালে কিন্ডারগার্টেন বা স্কুলে যাওয়ার আগে ব্যস্ততা বেশি থাকে। তখন বড়রা, বিশেষ করে দাদা-দাদি ও নানা-নানিরা সময় বাঁচাতে বাচ্চাদের অতিরিক্ত সাহায্য দিয়ে থাকেন বা দিতে চান। এতে ধাপে ধাপে বাচ্চারা নিজেদের কাজ নিজেরা করার আগ্রহ হারাতে থাকে এবং তাদের স্বাবলম্বী হবার পথে না-হক বাধার সৃষ্টি হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সর্বপ্রথমে পিতামাতার উচিত বাচ্চাদের বয়সভেদে স্বাধীনভাবে কাজ করা সুযোগ দেওয়া। যেমন, ৩ থেকে ৪ বছর বয়সী বাচ্চাকে নিজের খাবার নিকে খেতে দিতে, কাপড়চোপড় পরতে দিতে হবে। ৪ থেকে ৫ বছর বয়সে বাচ্চাদের বাসার টেবিল পরিস্কার করতে ও নিজেদের গুছিয়ে রাখার কাজ করতে পারে। ৫ থেকে ৬ বছর বয়সের বাচ্চাকে নিজের স্কুলের ব্যাগ গুছানোর মতো কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। এ সব কাজ করতে গিয়ে তারা কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। তখন তাদেরকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করে সমস্যা সমাধানের সুযোগ দিতে হবে।
কাজ যদি কঠিন হয়, তবে পিতামাতা বাচ্চাকে সাহায্য দিতে পারেন। যদি কাজের সময় বাচ্চা বাবা-মাকে সাহায্য করতে অনুরোধ করে, তখন সাহায্য করা বা উত্সাহ দেওয়া ভালো। কাজটা একেবারেই না পারলে, পিতামাতা সেটি করে দিতে পারেন, তবে তাকে পরবর্তীতে নিজেই কাজটা করতে হবে বলে জানিয়ে দিতে হবে। আর এ কারণে বাচ্চাকে কাজটা করার পদ্ধতি শিখতে উত্সাহিত করতে হবে। এভাবে দেখা যাবে, বাচ্চা একসময় কাজটা ঠিকঠাক করা শিখে যাবে।
আর বাবা-মার উত্সাহে বাচ্চা যখন নিজেই কোনো কাজ সম্পন্ন করে ফেল, তখন অবশ্যই তাদের প্রশংসা করতে হবে, উত্সাহ দিতে হবে। এ ধরনের প্রশংসা ও উত্সাহ বাচ্চাদের মানসিক উন্নয়নেও ইতিবাচক ভুমিকা পালন করে থাকে।
অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের ধীর গতিতে কাজ করার অভ্যাস নিয়ে উদ্বিগ্ন। অনেকে বলেন, প্রাথমিক স্কুলে কয়েক বছর ধরে পড়াশোনা করেছে বাচ্চারা, অথচ এখনও কাজে অনেক স্লো; কাজ করার সময় বা হোমওয়ার্ক করার সময় খেলে, মনোযোগ দিয়ে কোনো কাজ করে না। এটা একটা সমস্যা বটে। প্রশ্ন হচ্ছে: কিভাবে এমন সমস্যা মোকাবিলা করা যায়?
বেইজিং মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের পারিবারিক শিক্ষার পরামর্শক চু ইয়া মেই বলেন, ‘ধীর গতিতে কাজ করা’র বিষয়টি নিয়ে বাবা-মায়ের উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। বস্তুত, প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা যখন কাজ বা হোমওয়ার্ক করার সময় অলসতা দেখায় বা ধীর গতিতে করে, তখন বুঝতে হবে তাদের সময়জ্ঞান কম। বড়দের তুলনায় সময় তাদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারা মনে করে, একদিনে অনেক সময়, কাজ আস্তে আস্তে করলে সমস্যা নাই। এ ক্ষেত্রে পিতামাতার উচিত বাচ্চার সঙ্গে কথা বলা, তাদের সময়ের গুরুত্ব যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া। একবার বললেই বাচ্চা বুঝে যাবে, এমন নয়। বার বার বলতে হবে এবং এক্ষেত্রে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। বাচ্চাকে বোঝাতে নিজেদের জীবন থেকে উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে না-হক বাচ্চাকে বকাঝকা করা উচিত নয়। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
বেইজিংয়ে ক্রীড়া পর্যালোচনা-ব্যবস্থার সংস্কার প্রসঙ্গ
আগের অনুষ্ঠানে আমরা বলেছি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের শরীরস্বাস্থ্য এবং ক্রীড়া ও শিল্পকলাসহ বহুমুখী দক্ষতার উন্নয়নে ব্যাপক মনোযোগ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে ক্রীড়া পর্যালোচনা-ব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে চীনের বাধ্যতামূলক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। নতুন যুগে বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যময় ক্রীড়া প্রকল্প বা খেলাধুলার বিষয় প্রশিক্ষণ দিতে উত্সাহ দেওয়া হয়। এখন বেইজিংয়ের বিভিন্ন এলাকার স্কুলে আনন্দময় ও আরামদায়ক ক্রীড়ার পরিবেশ অনুভব করা যায়।
ক্রীড়া পর্যালোচনা-ব্যবস্থার সংস্কারের ফলে এখন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মোটা বাচ্চার সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং তাদের মায়োপিয়ার পরিমাণও তুলনামূলক কমে গেছে।
বেইজিং মহানগরের শিক্ষা কমিটির জনৈক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের সংস্কারের লক্ষ্য বাচ্চাদের আনন্দের সাথে খেলাধুলা করার সুযোগ দেওয়া এবং নতুন প্রজন্মের চীনাদের জন্য স্বাস্থ্যকর ও আনন্দময় পরিবেশ গড়ে তোলা।’ ২০২১ সাল থেকে বেইজিং মহানগর শিক্ষা কমিটি ‘বাধ্যতামূলক শিক্ষায় ক্রীড়া ও স্বাস্থ্য পর্যালোচনা প্রস্তাব’ প্রকাশ করে। এতে ক্রীড়া পরীক্ষার স্কোর ৪০ থেকে বাড়িয়ে ৭০ করা হয় এবং এ স্কোর মাধ্যমিক স্কুলের স্নাতক পরীক্ষার মোট স্কোরের সাথে যোগ করার নিয়ম করা হয়। বিভিন্ন সেমিস্টারে ক্রীড়ার স্কোর মোট ৪০ এবং মাধ্যমিক স্কুল থেকে স্নাতক হওয়ার আগে ফাইনাল ক্রীড়া পরীক্ষার স্কোর ৩০। তা ছাড়া, পরীক্ষায় খেলাধুলার ধরণ ৮ থেকে ২২তে উন্নীত করা হয়েছে।
চূড়ান্ত পরীক্ষার ক্রীড়ার স্কোরের সাথে ৪০ স্কোর যুক্ত করা এ সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সংশ্লিষ্ট ক্রীড়ায় পাস করলে একজন শিক্ষার্থী পুরো ৪০ স্কোর পেতে পারে। এ নিয়ম বিভিন্ন বয়সের ছাত্রছাত্রীদের ক্রীড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়াচ্ছে এবং তাদেরকে শরীরচর্চায় আগ্রহী করে তুলছে।
গত ৩ বছরে নতুন পর্যালোচনা-ব্যবস্থার কারণে, বিভিন্ন স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের শরীরের অবস্থা উন্নত হয়েছে এবং শরীরচর্চার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। ২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে চীনের বিভিন্ন এলাকায় মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের ক্রীড়া পরীক্ষায় শ্রেষ্ঠ স্কোর অর্জনকারীর সংখ্যাও দ্রুত বেড়েছে। বেইজিং মহানগরের স্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্য কমিটির পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০২৩ সালে বেইজিংয়ে মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মায়োপিয়ায় আক্রান্তদের সংখ্যা ১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বলা যায়, নতুন ক্রীড়া পর্যালোচনা-ব্যবস্থা বাচ্চাদের সময়মতো শরীরচর্চা এবং পিতামাতাদের বাচ্চাদের স্বাস্থ্য ও শরীরের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক ভুমিকা পালন করেছে।
এখন বেইজিংয়ের বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলে সাড়ে ৩টায় সব ক্লাস শেষ হয়। ক্লাসের পর স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা খেলার মাঠে শরীরচর্চা শুরু করেন। ক্রীড়া ক্লাস দৈনিক ক্লাস হিসেবে নেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলে বহুমুখী শরীরচর্চাকে উত্সাহ দিতে স্কুলে এক ঘন্টা, স্কুলের বাইরে এক ঘন্টার খেলাধুলার উদ্যোগ নিয়েছে বেইজিং শিক্ষা কমিটি। সকালের দৌড়, ক্লাসের মাঝখানে শরীরচর্চা, ক্লাসের ব্রেকে ব্যায়াম, ক্লাস শেষ করার পর শারীরিক শক্তির প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন ধরনের মজার কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
তা ছাড়া, পরিবারের সদস্যদের সাথে শরীরচর্চা বাড়াতে এই ব্যবস্থা উত্সাহিত করছে। এখন বেইজিং মহানগরের বিভিন্ন এলাকার স্কুলে বৈশিষ্ট্যময় খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে। যেমন, সিছেং এলাকায় বাচ্চারা স্কিপিং প্রতিযোগিতায় নিয়মিতভাবে অংশ নেয়। সবাই ভালো স্কিপিং করতে পারে। হাইতিয়ান এলাকায় প্রতিবছর স্কুলে ফুটবল প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়। শিচিংশান এলাকার স্কুলে ক্লাসের বড় ব্রেকে বিভিন্ন ধরনের মজাদার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। মিইয়ুন এলাকায় টানা ১৫ বছর ধরে ছাত্রছাত্রীদের দৌড়ের দক্ষতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এখন একসাথে দৌড়াদৌড়ি স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন ক্লাসে পরিণত হয়েছে।
বিভিন্ন খেলাধুলার প্রতিযোগিতা ক্রীড়াচর্চার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রতিযোগিতা স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের শরীরচর্চা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেতনা উন্নয়নে সহায়ক। তারা পরিশ্রম ও সংগ্রামে ক্লাসের ক্রীড়াসাফল্য অর্জনে আরো বেশি চেষ্টা করতে চায়, একসাথে মর্যাদা পেতে চায়। এটি বাচ্চাদের চরিত্র গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
(সুবর্ণা/আলিম/রুবি)