চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব
2024-10-28 16:27:52

চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব

৯৩তম পর্বে যা থাকছে:

 ১। চাঁদে ঘাঁটি নির্মাণের জন্য ‘চন্দ্র ইট’ তৈরি করল চীন

২। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন নতুন সৌরকোষ তৈরি করেছে চীন

৩। টার্ডিগ্রেড: পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণী

চাঁদে ঘাঁটি নির্মাণের জন্য ‘চন্দ্র ইট’ তৈরি করল চীন

মহাকাশ জয়ের সূচনা লগ্ন থেকে শুরু করে চাঁদে মানুষ পাঠানো এবং বর্তমানে নতুন করে শুরু হওয়া প্রতিযোগিতা, চাঁদ সবসময়ই ছিল মানব সভ্যতার কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে। এই প্রতিযোগিতা শুধুমাত্র একটি দেশের গৌরবের প্রশ্ন নয়, বরং এটি মানব সভ্যতার ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

প্রথমবারে মতো চাঁদে যাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয় ১৯৫৭ সালে রাশিয়ার মহাকাশযান স্পুটনিক উৎক্ষেপণের মাধ্যমে। এরপর ১৯৬৯ সালে অ্যাপলো-১১ অভিযানের মাধ্যমে চাঁদে মানুষ পাঠায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই প্রতিযোগিতা নতুন করে শুরু হয়েছে এই দশকে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার ভবিষ্যতে চাঁদে ঘাঁটি নির্মাণের জন্য ‘লুনার ব্রিকস বা চন্দ্র ইট’ তৈরি করলেন চীনা গবেষকরা। এটি এমন এক বিশেষ উপাদান থেকে তৈরি, যার গঠন চাঁদের মাটির মতোই বলে দাবি তাদের।

এই ইট পরীক্ষার জন্য দেশটির থিয়ানকং স্পেস স্টেশনে পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন। সম্প্রতি চীনের সেন্ট্রাল টেলিভিশন জানিয়েছে এসব তথ্য।

চাঁদে ঘাঁটি নির্মাণ করতে হলে পৃথিবী থেকে প্রচুর পরিমাণে নির্মাণ সামগ্রী সেখানে পাঠানো অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং জটিল একটি প্রক্রিয়া। তাই চাঁদেই প্রাপ্ত উপকরণ ব্যবহার করে সেখানে অবকাঠামো তৈরি করা অনেক বেশি কার্যকরী এবং টেকসই হবে। তাই চাঁদেই উপকরণ তৈরি করে খরচ কমানো যাবে এবং ভবিষ্যতে চাঁদে বসতি স্থাপনের পথ সুগম হবে। এই প্রক্রিয়াকে ইন সিটু রিসোর্স ইউটিলাইজেশন বলা হয়।

দেশটির হুয়াচোং ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বা এইচইউএসটি অধ্যাপক চৌ ছেং জানান, ‘চন্দ্র ইট’ তৈরিতে চাঁদের মাটির সিমুলেশন ব্যবহার করা হয়েছে। একটি বিশেষ চুলায় ইটগুলো তৈরি করা হয়, যা প্রচলিত লাল ইট বা কংক্রিটের ইটের চেয়েও তিনগুণ মজবুত। যার অর্থ প্রতি বর্গ সেন্টিমিটার ১ মেট্রিক টনেরও বেশি ওজন সহ্য করতে সক্ষম। এই ‘চন্দ্র ইট’ বা চাঁদের মাটির গঠন তৈরিতে পাঁচটি আলাদা ধরনের ‘সিমুলেটেড’ ও তিনটি ভিন্ন ‘সিন্টারিং’ প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছে গবেষণা দলটি, যা ভবিষ্যতে চাঁদে ঘাঁটি নির্মাণের জন্য উপযুক্ত উপাদান নির্বাচন করতে আরও বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য দেবে। সিন্টারিং হচ্ছে, পাউডারজাতীয় কোনও পদার্থকে এমনভাবে চাপ বা তাপ প্রয়োগ করা যাতে এটি গলে না গিয়ে আরও শক্ত কঠিন রূপ ধারণ করে।

বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন রকম হয়ে থাকে চাঁদের মাটির গঠন। চাঁদের যে স্থানে ছ্যাং’এ-৫ মহাকাশযান অবতরণ করেছে “ঠিক সেই স্থানের মাটিকে অনুকরণ করেই বানানো হয়েছে আমাদের এই চন্দ্র ইট”, যা মূলত আগ্নেয়গিরিজাত শিলা বা ব্যাসল্ট।

এক্ষেত্রে কিছু মাটির গঠন তৈরি হয়েছে চাঁদের অন্যান্য স্থানে পাওয়া মাটির অনুকরণ করেও, যা আদতে অ্যানথোসাইট। ক্রমাগত তাপ ও চাপ বেড়ে যাওয়ার ফলে সাধারণত বিটুমিনাস বা লিগনাইট কয়লার পরিবর্তিত রূপ থেকে অ্যানথোসাইট তৈরি হয়।

তবে চাঁদের পরিবেশে টিকে থাকতে পারবে কি না তা দেখার জন্য নানা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে গবেষকদের তৈরি এসব ইটকে।

মহাজাগতিক বিকিরণ’সহ চাঁদে রয়েছে এক অদ্ভুত রকমের বায়ুশূন্য পরিবেশ। চাঁদে দিনের তাপমাত্রা ১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায় ও রাতে মাইনাস ১৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। তাই তাদের বানানো এসব ইট ভালভাবে তাপ নিরোধক ও চাঁদের বিকিরণ সহ্য করতে পারে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে গবেষণা দলটিকে।

‘থিয়ানচৌ-৮’ নামের কার্গো মহাকাশযানে করে গবেষকদের বানানো চাঁদের এসব ইট পাঠানো হবে চীনের মহাকাশ স্টেশনে, যাতে এগুলোর যান্ত্রিক ও তাপ সহ্যক্ষমতা এবং চাঁদের মহাজাগতিক বিকিরণ সহ্য করার ক্ষমতা রয়েছে কি না তা দেখতে হবে।

গবেষকদের অনুমান, প্রথমবারের মতো পৃথিবীতে তৈরি এসব ইটকে চাঁদের মাটিতে পাঠানো সম্ভব হবে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ।

মঙ্গলবার মহাকাশ বিজ্ঞানের জন্য জাতীয় পর্যায় থেকে এক দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন কর্মসূচি প্রকাশ করেছে চীন, যেখানে ২০৫০ সালের মধ্যে মহাকাশ বিজ্ঞানে উন্নয়নের একটি রূপরেখাও দিয়েছে দেশটি।

এদিকে, চীনের উদ্যোগে শুরু করা আন্তর্জাতিক চাঁদ গবেষণা কেন্দ্রটির দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রোগ্রামিং কাজ শুরু হবে ২০২৮ থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে।

‘অ্যাডিটিভ ম্যানুফ্যাকচারিং’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরেকটি নির্মাণ বিকল্পও তৈরি করেছে গবেষণা দলটি, যেখানে চাঁদের মাটি ব্যবহার করে ঘর প্রিন্ট করার জন্য একটি থ্রিডি প্রিন্টিং রোবট বানিয়েছেন তারা।

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা:  ফয়সল আবদুল্লাহ

উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন নতুন সৌরকোষ তৈরি করেছে চীন

চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সেসের অধিভুক্ত রসায়ন ইনস্টিটিউটের নেতৃত্বে একদল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী একটি নতুন শক্তিশালী সৌরকোষ তৈরি করেছেন। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল নেচার জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে।

পেরোভস্কাইট-জৈব ট্যান্ডেম উপাদানে তৈরি সোলার সেলটির সক্ষমতা ২৬ দশমিক ৪ শতাংশে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের শিক্ষাবিদ ও গবেষক লি ইয়ংফাং। তার মতে, এই ধরনের সৌরকোষগুলোর এটাই সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা।

সোলার সেলের পরবর্তী প্রজন্ম হলো পেরোভস্কাইট জৈব কোষ। বর্তমানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত স্ফটিক সিলিকন সেলের তুলনায় এগুলোর উৎপাদন আরও সহজ, ওজনেও হালকা। ফলে এগুলোকে বিভিন্ন আকারে তৈরি করা যাবে এবং যেকোনো জায়গায় সহজে ব্যবহার করা যাবে। বিশেষ করে, নমনীয় যন্ত্রপাতিতেও এটি সহজে প্রতিস্থাপন করা যায়। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে বহনযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপানকারী যন্ত্র, ভবনে যুক্ত ফটোভোলটাইক প্রযুক্তি ও ইনডোর সোলার প্যানেলের মতো ক্ষেত্রে এটি প্রয়োগ করা যেতে পারে।

লি আরও জানান, নতুন সেলটি পেরোভস্কাইট বস্তুতে থাকা চওড়া ব্যান্ড-গ্যাপ ব্যবহার করে সহজে স্বল্প-তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সূর্যালোক শোষণ করতে পারে। সোলার কোষটি বিদ্যুৎ তৈরিতে সৌর বর্ণালীকে আরও বেশি মাত্রায় ব্যবহার করতে পারবে।

বর্তামানে বিজ্ঞানীরা এই নতুন সৌরকোষকে আরও উন্নত করার জন্য কাজ করছেন।

|| প্রতিবেদন: ফয়সল আবদুল্লাহ

|| সম্পাদনা: শুভ আনোয়ার

টার্ডিগ্রেড: পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণী

চীনের বিজ্ঞানীরা অতি ক্ষুদ্র এক ধরনের অমেরুদণ্ডী প্রাণীক নিয়ে গবেষণা করেছেন। এই প্রাণীটির নাম টার্ডিগ্রেড। গবেষণায় দেখা গেছে, এই প্রাণীগুলো এতোটাই শক্তিশালী যে এটি কঠিন পরিস্থিতিতেও বেঁচে থাকতে পারে। বিশেষ করে রেডিয়েশনও প্রতিরোধে সক্ষম। এছাড়া খুব বেশি গরম বা খুব বেশি ঠান্ডা জায়গায়, এমনকি মহাকাশেও বেঁচে থাকতে পারে এরা! সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল সায়েন্স জার্নালে প্রকাশ করা হয়।

টার্ডিগ্রেড বা ওয়াটার বিয়ার নামে খুব ছোট এই প্রাণীটি এতটাই শক্তিশালী যে বিজ্ঞানীরা এদেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণীদের মধ্যে একটি বলে মনে করেন। বিজ্ঞানীরা জানতে চেষ্টা করেছেন এই প্রাণীটি এত শক্তিশালী কেন। তাই তারা টার্ডিগ্রেডের দেহের কাঠামো খুব ভালো করে পরীক্ষা করেছেন। তারা দেখেছেন যে এই প্রাণীর দেহে এমন কিছু বিশেষ ধরনের পদার্থ আছে যা একে অনেক ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।

এই গবেষণার ফলে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন যে ভবিষ্যতে মানুষকেও এই ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা করার উপায় বের করা যাবে। যেমন, যদি কেউ খুব বেশি রেডিয়েশন (এক ধরনের ক্ষতিকর আলো) এর সংস্পর্শে আসে তাহলে এই গবেষণার ফলাফল ব্যবহার করে তাকে রক্ষা করা যেতে পারে।

বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে কঠোর পরিশ্রমের পর এক অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছেন! তারা টার্ডিগ্রেডকে ল্যাবেই জন্ম দেওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। এই সাফল্যের ফলে টার্ডিগ্রেডের জিনোমের বিস্তারিত মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, যা এই জীবের অসাধারণ সহনশীলতার পেছনের জৈবিক প্রক্রিয়াগুলোকে আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। বিশেষ করে, টার্ডিগ্রেড কীভাবে অতিরিক্ত শক্তিশালী বিকিরণের মতো ক্ষতিকর পরিবেশ সহ্য করতে পারে, সেই রহস্যের উন্মোচন সম্ভব হয়েছে।

নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- ফয়সল আবদুল্লাহ

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী