হাজার বছর আগের কাগজ, চা এবং নুডলস থেকে শুরু করে আজকের প্যাসেঞ্জার ড্রোন, কিংবা নতুন জ্বালানির গাড়ি। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে চলেছে চীনের শক্তিশালী আবিষ্কারের হাত ধরে। নানা সময়ে দারুণ সব আবিষ্কার করে আধুনিক সভ্যতার ভিত গড়ে দিয়েছে চীন। আর সেই সব আবিষ্কার নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন মেড ইন চায়না।
মেড ইন চায়নার ২২তম পর্বে সাথে আছি আমি ফয়সল আবদুল্লাহ...আজকের পর্বে থাকছে চীনের আবিষ্কার হাইব্রিড ধানের কথা।
পৃথিবীর জনসংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ৮০০ কোটি। এর মধ্যে সাড়ে তিনশ কোটি মানুষের প্রধান খাবার হলো ভাত। সাধারণ ধান চাষ করে কিন্তু এই পরিমাণ মানুষের চালের চাহিদা পূরণ করা একেবারেই সম্ভব নয়। কারণ সাধারণ জাতের ধানের ফলন কম, বাড়েও ধীরগতিতে। তখন কী দাঁড়াতো পরিস্থিতি? নিঃসন্দেহে অভুক্ত থাকতে হতো অনেক অনেক মানুষকে। আর সেই মানুষগুলোর প্রতিদিনকার ক্ষুধা দূর করতেই পৃথিবীতে আবিষ্কার হয়েছে হাইব্রিড তথা উচ্চফলনশীল জাতের ধান। হাইব্র্রিড প্রক্রিয়ায় ধানের ফলন বাড়ানো না গেলে অন্তত ১৩ থেকে ১৫ কোটি মানুষকে পড়তে হতো দারুণ বিপদে। কারণ তাদের প্রতিদিনকার খাদ্যতালিকায় আছে হাইব্রিড ধান। কোটি কোটি মানুষকে ক্ষুধার করাল থাবা থেকে বাঁচানো ওই হাইব্রিড ধানটা কিন্তু পুরোপুরি মেড ইন চায়না।
শুধু চীনেই প্রতিদিন হাইব্রিড ধানের চাল খাচ্ছেন ৮ কোটি মানুষ। এর বাইরে ৫-৬ কোটি মানুষও প্রতিদিন এই জাতের চাল খাচ্ছে। বাংলাদেশেও কিন্তু এ সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়। ধান উৎপাদনে বিশ্বের তৃতীয় স্থানে থাকা দেশটিতে গতবছর প্রায় চার কোটি টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশই হলো হাইব্রিড ধান।
হাইব্রিড ধানের জন্ম হলো কী করে, এবার আসা যাক সেই প্রসঙ্গে।
হাইব্রিড ধান আবিষ্কারের একক কৃতিত্ব প্রয়াত চীনা গবেষক ইউয়ান লংপিংয়ের। তাকেই বলা হয় হাইব্রিড ধানের জনক।
১৯৩০ সালে জন্ম নেন ইউয়ান। ওই সময় চীনের অনেক অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তা দেখেই ধানের ফলন কীভাবে বাড়ানো যায় তা নিয়ে উঠেপড়ে লাগেন ইউয়ান লংপিং।
গবেষণা শেষে ওই বছরেই প্রথমে ধানের জিনগত উন্নয়নের বিষয়ে ধারণা দেন ইউয়ান। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় হেটেরোসিস। এ প্রক্রিয়ায় দুটো ভিন্ন জাতকে একীভূত করার ফলে একটি জাতের কোনো একটি বা একাধিক বৈশিষ্ট্য ফুলেফেঁপে ওঠে।
ওই সময় ইউয়ানের ধারণাকে উড়িয়ে দেন অনেকে। কারণ যেসব উদ্ভিদের ভেতর স্বপরাগায়ন ঘটে, সেসব উদ্ভিদে দুই জাতের সংমিশ্রণের নতুন ক্ষমতাসম্পন্ন জাত তৈরি হবে, এমনটা তখন তারা বিশ্বাসই করতে চাননি। কিন্তু থেমে থাকেননি ইউয়ান লংপিং।
ধানের ফলন বাড়াতে পারে এমন বৈশিষ্ট্য সনাক্ত করতে বুনোজাতসহ ঐতিহ্যবাহী ধানের জাতগুলোর ভেতর বৈচিত্র্য খুঁজতে শুরু করেন ইউয়ান লংপিং। ওই সময় তিনি এমন কিছু জাত খুঁজে বের করতে চেয়েছিলেন যা সেই হেটেরোসিস বা হাইব্রিড গুণ সমৃদ্ধ। এতে করে দুটি জিনগত ভিন্ন জাতের মধ্যে ক্রসব্রিডিং ঘটিয়ে তৈরি করা হলে তা হবে একটি প্রাকৃতিক প্রকৌশলবিদ্যা।
ইউয়ানের পরবর্তী ধাপের গবেষণায় বড় অগ্রগতি হলো প্রাকৃতিকভাবে পুরুষ-জীবাণুমুক্ত ধানের উদ্ভিদ আবিষ্কার করা। এই আবিষ্কারটিই ইউয়ানের গবেষণার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি এই জাতটিকে প্যারেন্টস জাত হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন। পরে এ জাতের সঙ্গেই অন্যান্য জাতের সংকর ঘটিয়ে তৈরি করেন হাইব্রিড ধানের বীজ।
সহজ করে বলতে গেলে ইউয়ান লংপিং প্রথমে একটি স্থিতিশীল পুরুষ জাত তৈরি করেন যা নিজে থেকে পরাগায়ন করতে পারে না। পরাগায়নের জন্য এর চাই অন্য গাছের পরাগরেণু।
পরে বি লাইন নামের আরেকটি জাত, যেটা কিনা পরাগায়ন করতে পারে, সেটা দিয়ে প্রথম পুরুষ জাতটির ভেতর পরাগায়ন ঘটান ইউয়ান।
এখন যখন পরবর্তী জাত দিয়ে প্রথম জাতের পরাগায়ন করা হলো, তখন প্রথম গাছটি দীর্ঘদিন তার আগের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে পারে। এক্ষেত্রে প্রথম পুরুষ জাতটিকে বলা হয় এ লাইন, দ্বিতীয়টি হলো বি লাইন। আর এর পরই আছে আর লাইন নামের আরেকটি জাতের কাজ। এটি এমন এক জাত, যা এ লাইনের উর্বরতা ফিরিয়ে আনতে পারে। অর্থাৎ যখন আর লাইনের সঙ্গে এ লাইনের সংকর করা হবে, তখন সেখানে উৎপাদিত বীজটি হবে উর্বর এবং ওটা তার নিজের বীজ নিজেই তৈরি করতে পারবে। আর এ বীজটিই এফ১ হাইব্রিড নামে পরিচিত। কৃষকরা এ বীজটিই সংগ্রহ করে রোপণ করে থাকে।
ঠিক কোন কোন দিক দিয়ে এগিয়ে আছে হাইব্রিড ধান? শোনা যাক শান্তা মারিয়ার কাছ থেকে
· অনেক দেশকে খাদ্যের চরম সংকট থেকে বাঁচিয়েছে চীনের আবিষ্কার হাইব্রিড ধান।
· এ জাতের ধানে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয় কম। এ গাছ বাড়েও দ্রুত।
· হাইব্রিড ধানে জৈবিক প্রক্রিয়ায় কিছু পুষ্টিকর উপাদান তৈরি হয়। এ ধানে বেশি আয়রন, জিংক ও ভিটামিন রয়েছে। গোল্ডেন রাইস নামের একটি হাইব্রিড ধানে আছে বিটা ক্যারোটিন, যা কিনা সচরাচর শাক-সবজি ও ফলমূলে পাওয়া যায়।
· ২০১৮ সালে ইউয়ান লংপিংয়ের নেতৃত্বাধীন গবেষণা দলকে দুবাই সরকার আমন্ত্রণ জানায় তাদের লবণাক্ত ভূমিতে হাইব্রিড ধানের পরীক্ষামূলক রোপণের জন্য। এতে ব্যাপক সাফল্য পান ইউয়ান ও তার দল। দুবাই সরকার তখন এ হাইব্রিড ধানটিকে জাতীয় উপহার হিসেবে সম্মাননা দেয়।
গবেষণাগার থেকে বের হয়ে ১৯৭৩ সালে বিশ্বের প্রথম উচ্চ-ফলনশীল হাইব্রিড ধানের স্ট্রেন চাষে সফল হন ইউয়ান লংপিং। আগে যেখানে ৩০০ কেজি পাওয়া যেত, সেখানে প্রতি মিউ জমিতে ৫০০ কেজি ফলন দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন তিনি।
পরবর্তী চার দশক ধরে হাইব্রিড ধানের গবেষণা ও উন্নয়নে কাজ চালিয়ে যান ইউয়ান। বাড়তে থাকে ফলনের মাত্রা। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে ধানের আরও কিছু গুণ ও প্রতিকূল পরিবেশের প্রতি সহনশীলতা।
১৯৯৬ সালে, চীনা কৃষি মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে একটি সুপার রাইস ব্রিডিং প্রোগ্রাম চালু করে। চার বছর পর প্রথম ধাপে প্রতি হেক্টরে সাড়ে ১০ টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়। ২০০৪ সালে ১২ টন, ২০১১ সালে সাড়ে ১৩ টন এবং ২০১৪ সালে ১৫ টন উৎপাদন করে তৈরি হয় রেকর্ড।
২০২০ সালে, ইউয়ানের গবেষণা দলের উদ্ভাবিত হাইব্রিড চাল প্রতি মু জমিতে দেড় হাজার কেজি ফলনের মাইলফলক অর্জন করেছিল, যা কিনা একটি বিশ্ব রেকর্ড।
মহান এ বিজ্ঞানীকে সম্মাননা জানাতে কার্পণ্য করেনি বিশ্ব। তার নামে চীনে শুধু একটি কলেজই নয়, চারটি গ্রহাণুর নামও রাখা হয়েছে তার নামে। ২০১১ সালে তিনি পেয়েছেন মাহাথির বিজ্ঞান পুরস্কার।
তার আগে ২০০০ সালে চীনের রাষ্ট্রীয় প্রধান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পুরস্কার ও কৃষিতে উলফ পুরস্কার এবং ২০০৪ সালে বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার।
২০২১ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি চায়না ন্যাশনাল হাইব্রিড রাইস সেন্টারের মহাপরিচালক ছিলেন।
গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
অডিও সম্পাদনা: নাজমুল হক রাইয়ান
কণ্ঠ: শান্তা/ফয়সল
সার্বিক তত্ত্বাবধান: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী