বিজ্ঞানবিশ্ব ৯২তম পর্ব
2024-10-21 20:13:39

১। মাইক্রোপ্লাস্টিকে হুমকির মুখে মৌমাছি থেকে শুরু করে বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা

২। খড় থেকে বায়ো-ইথিলিন গ্লাইকোল উৎপাদনে চীনের সাফল্য

 

মাইক্রোপ্লাস্টিকে হুমকির মুখে মৌমাছি থেকে শুরু করে বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা

ন্যানো এবং মাইক্রোপ্লাস্টিক কণিকা (এনএমপি) শুধু যে শহর ও গ্রামীণ অঞ্চলকে দূষিত করছে এমন নয়। মৌমাছি এবং অন্যান্য উপকারী পোকামাকড় যখন এসব মাইক্রোপ্লাস্টিকের সংস্পর্শে আসে কিংবা খাবার গ্রহণ করে তখন ক্ষুদ্র এসব প্লাস্টিক কণা তাদের শরীরে প্রবেশ করে। এমনকি বাতাস থেকেও প্লাস্টিক কণিকা কীটপতঙ্গের শরীরের প্রবেশ করে। যা তাদের অঙ্গগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং আচরণে পরিবর্তন ঘটাতে পারে। বিশেষ করে মৌমাছি এবং পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণের মতো ইকোসিস্টেমকেও বাধাগ্রস্ত করে। প্লাস্টিক দূষণ এইভাবে জীববৈচিত্র্য, কৃষি উৎপাদন এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকির সৃষ্টি করছে।

 

এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে। চীনের হাংচৌয়ের ওয়েস্টলেক, চেচিয়াং এবং শাংহাইয়ের ফুতান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সঙ্গে যৌথভাবে জার্মানির ফ্রেইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এ গবেষণাটি করেছেন।

প্লাস্টিক কণা এক মাইক্রোমিটার থেকে পাঁচ মিলিমিটার আকারের কিংবা এর চেয়েও ছোট কণাকে ন্যানোপ্লাস্টিক বলা হয়। পানিতে এবং বিভিন্ন প্রজাতির উপর এনএমপি (ন্যানো এবং মাইক্রো প্লাস্টিক) কণার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জানলেও কৃষি জমিতে এই কণাগুলো কীভাবে প্রভাব ফেলে, সে সম্পর্কে এখনও আমাদের জানা তথ্য খুব সীমিত।

 

এ তথ্য ঘাটতি দূর করার জন্য গবেষকরা প্রথমবারের মতো পূর্বের ২১টি গবেষণা নিয়ে নতুন করে একটা পরীক্ষা করেছেন। তারা জানতে চেষ্টা করেছেন যে, পরাগায়নের সঙ্গে যুক্ত পোকামাকড় এবং অন্য উপকারী পোকামাকড় কীভাবে ন্যানো এবং মাইক্রো প্লাস্টিকের সংস্পর্শে আসে এবং এটি গ্রহণের ফলে তাদের উপর নির্ভরশীল পরিবেশের আর ফসলের উপর কী প্রভাব পড়ে।

 

গবেষকরা কৃষি জমিতে ব্যবহৃত প্লাস্টিক, সার, দূষিত পানি এবং এমনকি বাতাসেও ছোট ছোট প্লাস্টিকের কণার উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছেন। এই কণাগুলো মাটিতে জমে থাকে। পরে কীটপতঙ্গ যখন খাবার খায় বা বাসা বানায়, তখন এই প্লাস্টিকের কণাগুলো তাদের শরীরে চলে যায়। এটা খুবই খারাপ কারণ এই কীটপতঙ্গগুলো অনেক ফুলকে পরাগায়ণ করে এবং অনেক ক্ষতিকর পোকামাকড়কেও খেয়ে ফেলে। কিন্তু এই প্লাস্টিকের কণাগুলো তাদের শরীরে ঢুকে গেলে তারা অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে বা মরে যেতে পারে। ফলে ফসলের পরিমাণ কমতে পারে এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক পোকামাকড় বাড়তে পারে।

 

 

গবেষণায় উঠেছে এসেছে, মৌমাছি এনএমপি গ্রহণের পর তাদের পাচনতন্ত্রের ক্ষতি, প্রতিরোধ ক্ষমতার দুর্বলতা এবং তাদের আচরণে পরিবর্তনসহ বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে। এটি মৌমাছিকে রোগের প্রতি আরও সংবেদনশীল করে তোলে, তাদের উদ্ভিদ পরাগায়ন কার্যকারিতা হ্রাস করে।

ফ্রেইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি সংরক্ষণ এবং ল্যান্ডস্কেপ ইকোলজির অধ্যাপক এবং গবেষণাপত্রের লেখক অধ্যাপক ড. আলেকজান্দ্রা-মারিয়া ক্লেইন জানান, গবেষণায় তারা মৌমাছির অন্ত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিক পেয়েছেন। এছাড়া কিভাবে বন্য মৌমাছিরা বাসা তৈরি করতে প্লাস্টিক ব্যবহার করে সেটিও খুঁজে পেয়েছেন।

তিনি সতর্ক করে বলেছেন পরাগায়ন কমে যাওয়ার ফলে ফসলের উৎপাদন হ্রাস পাবে। প্লাস্টিক দূষণ বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহের ইতোমধ্যেই বিদ্যমান অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে তুলবে।

 

নানোপ্লাস্টিক অন্যান্য পরিবেশগত চাপ, যেমন কীটনাশক, রাসায়নিক দূষণ, ছত্রাক এবং রোগজীবাণু সৃষ্ট হুমকি আরও বাড়িয়ে তোলে।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা:  ফয়সল আবদুল্লাহ

 

খড় থেকে বায়ো-ইথিলিন গ্লাইকোল উৎপাদনে চীনের সাফল্য

খড়ের মধ্যে থাকা শর্করাকে ব্যবহার করে বায়ো-ইথিলিন গ্লাইকোল নামে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ উৎপাদনের সফল হয়েছে চীনের বিজ্ঞানীরা। রাসায়নিক এ পদার্থটি পেট্রোলিয়াম বা কয়লার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যাবে এবং এটি পরিবেশবান্ধব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রাসায়নিকটি কারখানায় বছরে ১ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন সম্ভব। বায়ো-ইথিলিন গ্লাইকোল একটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক কাঁচামাল। এর বৈশ্বিক বার্ষিক চাহিদা ৩০ মিলিয়ন টনেরও বেশি।

 

পেট্রোলিয়াম ও কয়লা শিল্প ও পরিবহন ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু এই জীবাশ্ম জ্বালানি পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। এর দহনের ফলে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়, যা গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রা বাড়িয়ে গ্রহের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

 

এই পরিস্থিতিতে খড়ের মধ্যে থাকা শর্করাকে ব্যবহার করে বায়ো-ইথিলিন গ্লাইকোলের আবিষ্কার নতুন আশার আলো দেখিয়েছে। এর উৎপাদনে কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা হয় না। বরং, খড়ের মতো নবায়নযোগ্য সম্পদ ব্যবহার করা হয়। ফলে কার্বন নিঃসরণ কমে যাবে এবং পরিবেশের উপর চাপ কমবে।

চীনের বিজ্ঞান একাডেমির তালিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কেমিক্যাল ফিজিক্সের গবেষক চেং মিংইয়ুয়ান জানান, চীন প্রচুর পরিমাণে বায়ো-ইথিলিন গ্লাইকোল তৈরি করে এবং ব্যবহার করে। প্রতি বছর দেশটি ২০ মিলিয়ন টন বায়ো-ইথিলিন গ্লাইকোল ব্যবহার করে। বায়ো-ইথিলিন গ্লাইকোল পোশাকের ফাইবার, পানীয়ের বোতলের মতো প্লাস্টিক পণ্য এবং আরও অনেক কিছু তৈরির জন্য প্রাথমিক কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

 

চীনের বিজ্ঞানী বলছেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্পদ হল বায়োমাস। বায়োমাস হল গাছপালা, জ্বালানি কাঠ, এবং অন্যান্য জৈব পদার্থ থেকে পাওয়া জ্বালানি। এই জ্বালানি ব্যবহার করে কয়লা, তেল, এবং গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমানো সম্ভব হবে। নতুন নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে শক্তি উৎপাদনের পদ্ধতি পুরোপুরি বদলে দেওয়া যাবে। চারপাশের পরিবেশ ভালো রাখতে এবং ভবিষ্যতের জন্যও ভালো কিছু রেখে যেতে হলে জৈব জিনিসগুলোকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে।

 

মানুষ যখন পেট্রোল ব্যবহার করে, তখন মূলত মৃত জীবদের শক্তি ব্যবহার করি। কিন্তু যদি কাঠ বা গবাদি পশুর গোবর থেকে শক্তি উৎপন্ন করে ব্যবহার করি তাহলে আমরা সরাসরি জীবিত জিনিসের শক্তি ব্যবহার করি। এতে আমাদের কম শক্তি খরচ হয় এবং আমরা আবারও এই জিনিসগুলো উৎপাদন করতে পারি।

 

২০০৮ সালের প্রথম দিকে, তালিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কেমিক্যাল ফিজিক্সের চাং থাওয়ের নেতৃত্বে একদল গবেষক সেলুলোজ ব্যবহার করে নতুন পদ্ধতিতে ইথিলিন গ্লাইকোল তৈরি করেন।  তারা এই আবিষ্কারের উপর ৪০টিরও বেশি পেটেন্ট করেছিল। এই নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন চীনের ইথিলিন গ্লাইকোল শিল্পকে উন্নত করবে এবং সবুজ রাসায়নিক শিল্পের বিকাশকে গতিশীল করবে। এই প্রযুক্তিটি পরিবেশ সংরক্ষণ, চীনের দ্বৈত কার্বন লক্ষ্য অর্জন এবং স্থায়ী অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

১৬ বছর ধরে গবেষক দলটি ক্যাটালিস্টের দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্ব বাড়ানো, কাঁচামালের পরিসর বিস্তৃত করা এবং উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য কাজ করেছ। অবশেষে তারা এই প্রযুক্তিকে ল্যাবরেটরির বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার থেকে শিল্প উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তিতে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছেন।

 

যদিও বায়ো-ভিত্তিক কাঁচামাল থেকে ক্যাটালিসিসের মাধ্যমে উৎপাদিত বায়ো-ইজি-এর খরচ প্রচলিত কয়লা-ভিত্তিক উৎপাদনের তুলনায় প্রায় একগুণ বেশি। তবে এর শুদ্ধতা এবং গুণমান উচ্চতর। পণ্যের শুদ্ধতা ৯৯.৯ শতাংশ পর্যন্ত।

 

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা:  ফয়সল আবদুল্লাহ

 

নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।

 

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার

 

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

 

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- ফয়সল আবদুল্লাহ

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী