‘ঘুরে বেড়াই’ পর্ব- ৯০
2024-10-16 20:06:54

 

এবারের পর্ব সাজানো হয়েছে

১। প্রবীণদের আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্য এখন চীন

২। সি’আন শহরের বেল টাওয়ার

৩। কুইচৌ: মিয়াও সংস্কৃতির আকর্ষণ

 

 

বিশ্বব্যাপী অপরূপ সৌন্দর্যের চাদর বিছিয়ে রেখেছে বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি। কতো-শতো দেশ, কতো সংস্কৃতি, কতো ভাষা, কতো পেশা,.... কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতি কিংবা সময়ের টানাটানিতে দেখা হয় না, ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’

‘একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশির বিন্দু...’সেই অদেখাকে দেখাতেই আমাদের আয়োজন "ঘুরে বেড়াই"।

দেশ-বিদেশের দর্শনীয় স্থান, সেখানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, এবং সেই স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অর্থনীতি নিয়ে আমাদের অনুষ্ঠান ‘ঘুরে বেড়াই’।  

ঘুড়ে বেড়াই অনুষ্ঠানের ৯০ তম পর্ব আজ। আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি, আফরিন মিম।

 

১। প্রবীণদের আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্য এখন চীন

পর্যটনের জন্য আদর্শ গন্তব্য চীন। আর তাইতো দিন যত যাচ্ছে পর্যটনবান্ধব হয়ে উঠছে দেশটি। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশকে চীন ভ্রমণে দেওয়া হয়েছে ভিসামুক্ত সুবিধা। পাশাপাশি পর্যটন পরিষেবা উন্নত করতে প্রতিনিয়ত কাজ করছে দেশটি। আর এই সুবিধা চীন ভ্রমণে করছে আকৃষ্ট করছে বিদেশি প্রবীণ পর্যটকদের।

 

 

চীনের উত্তর-পশ্চিম শানসি প্রদেশের সিয়ান শহরে সম্রাট ছিন শিহুয়াংয়ের মাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ছয়জন ডাচ পর্যটক । যাদের সবার বয়সই ৬০ বছরের উপরে এবং তারা প্রথমবারের মতো এই দেশে ঘুরতে এসেছেন। তারা মূলত এই মাজারে টেরাকোটা আর্মির ভাস্কর্‍্ দেখতে এই দেশে এসেছেন। এদের অনেকেই দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পর এসেছেন এই দেশে। আর এই আসার সুযোগ হয়েছে চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর।

 

 

বিদেশি পর্যটক উইলকো পপপেলিয়ার্স বলেন, "চীন ভ্রমণ আমার ভ্রমণ তালিকায় শুরুতে ছিল। এখন আমি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি, তাই ঘুরে বেড়ানোর জন্য আমি অনেক সময় পেয়েছি”।

মঙ্গোলিয়ার প্রবীণ দম্পতিদের জন্যও চীনের গন্তব্যগুলো এখন প্রধান আকর্ষণ। এই দেশ থেকে ১২ জনের একটি ট্যুরিস্ট দল ঘুরতে এসেছেন চীনে। যাদের বেশিভাগের গড় বয়স ৬০। তবে এদের মধ্যে সর্বোচ্চ বয়সী প্রবীণ পর্যটকের বয়স ৮৮ বছর।

 

একজন পর্যটক বলেন, "চীন মঙ্গোলিয়ার পাশেই। আমি চীনের অনেক স্থান যেমন উথাইশান, চাংচিয়াচিয়ে,, হো হোট এবং বেইজিং পরিদর্শন করেছি। চীন খুব দ্রুত উন্নতি করছে,"।

এদিকে লিচিয়াং নদীর ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ৩০ জন বিদেশী পর্যটক। কুইলিন শহরের লিচিয়াং নদীর সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি বিভিন্ন শহর ঘুরেছেন তারা।

 

বিদেশি পর্যটক মার্সিয়া আকেমি ফুজিনামি বলেন, "আমরা দেশটির বিভিন্ন শহর ঘুরে দেখেছি। ভ্রমণগুলো খুব সহজ ও সুবিধাজনক ছিল,"।

 

 

ইতালীয় পর্যটক ফাব্রিজিও। চীনের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দেখতে চীন এসেছেন তিনি। ইউরোপ এবং চীনের মধ্যে অনেক ফ্লাইট সুবিধা থাকায় দেশটিতে ভ্রমণ অনেক সহজ হয়েছে। এই আর সুযোগ হাতছাড়া করেননি ইতালির এই পর্যটক।

 

বিদেশি পর্যটক ফাব্রিজিও বলেন, চীনে ভ্রমণ এখন অনেক সহজ। ইউরোপ থেকে প্রচুর ফ্লাইট আসছে। চীনে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া পর্যটন গন্তব্য রয়েছে। তাই এই দেশে ভ্রমণ করতে পেরে আমি খুশি।

 

গেল কয়েক বছর ধরেই চীন বিদেশী পর্যটকদের জন্য ফ্লাইট বাড়ানো ও পর্যটন পরিষেবা আরও উন্নত করছে। দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান আন্তর্জাতিক পর্যটকদের সফরকে সহজ করতে দিচ্ছে বিভিন্ন সুবিধাও। উন্নত ভিসা নীতি, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স নীতি এবং নগদ অর্থ প্রদান, কিউআর কোড এবং ব্যাংক কার্ডের মতো আরও পেমেন্ট সুবিধা বিদেশি পর্যটকদের আরও আকৃষ্ট করেছে চীন ভ্রমণে।

 

চীনের সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বিদেশ থেকে বেশি প্রবীণ পর্যটক আসার ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন বাজার আরও চাঙ্গা হয়েছে। এই বছরের প্রথম সাত মাসে দেশটিতে বিদেশি পর্যটক এসেছে প্রায় ছয় মিলিয়ন, যা গেল বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪০০ শতাংশেরও বেশি।

প্রতিবেদন- আফরিন মিম

সম্পাদনা- ফয়সল আব্দল্লাহ

 

২। সি’আন শহরের বেল টাওয়ার

চীনের শায়ানসি প্রদেশের রাজধানী সি’আন শহর পর্যটন গন্তব্য হিসেবে বিখ্যাত। এই শহরের রয়েছে দীর্ঘ কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস। থাং রাজবংশের সময়কার বিখ্যাত রাজধানী ছাংআন বর্তমানের সি’আন শহরের একটি অংশে অবস্থিত ছিল।

সি’আন সিটির একটি ল্যান্ডমার্ক হলো বেল টাওয়ার। শহরের প্রাণকেন্দ্রে এর অবস্থান। বেল টাওয়ার এবং ড্রাম টাওয়ার কাছাকাছি অবস্থিত।

বেলটাওয়ার মিং রাজবংশের শাসনামলে ১৩৮৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। তবে এখানে শুধু মিং আমলের ঘন্টাই নয়, থাং রাজবংশের সময়কার ঘন্টাও রয়েছে।

১৬৯৯, ১৭৪০ এবং ১৮৪০ সালে বিশাল পরিসরে ঘন্টাভবনের সংস্কার হয়েছিল।

১৯৩৯ সালে জাপানি আগ্রাসনের সময় বোমাবর্ষণে এই ঘন্টাভবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরে আবার সংস্কার ও মেরামতের মাধ্যমে বেল টাওয়ারকে গড়ে তোলে নগর কর্তৃপক্ষ।

ঘন্টাঘর বা বেল টাওয়ারটি ৩৬ মিটার(১১৮ ফুট) দীর্ঘ। ইট ও কাঠের সমন্বয়ে তৈরি ভবনটির স্থাপত্য দৃষ্টিনন্দন।

বেল টাওয়ারে এখন রয়েছে বিশাল একটি ঘন্টা যার নাম চিংইয়ুন বেল। এটি থাং রাজবংশের সময়কার ঘন্টার হুবহু কপি। আসল ঘন্টাটি রয়েছে জাদুঘরে।

ঘন্টাটির উচ্চতা ২.৪৫ মিটার। ওজন ৬.৫ টন।বাইরের পরিধি ১.৬৫ মিটার। ঘন্টটি অত্যন্ত কারুকার্য সমৃদ্ধ। ঘন্টাটির আওয়াজ গম্ভীর ও রাজকীয়।

ভবনের উপরে ঐতিহ্যবাহী চীনা রীতির ছাদ রয়েছে। এই ছাদকে গোল্ডেন টপ বলা হয়। কারণ ছাদে কাঠের কারুকার্যের সঙ্গে গোল্ড প্লেটেড কারুকার্য রয়েছে। ছাদ গাঢ় সবুজ চকচকে টাইলসে তৈরি। ভিতরে গোল্ড পেইন্টিং রয়েছে।

 ভবনের নিচের ভিত্তিভূমি ইটের তৈরি। ভিত্তি ৮.৬ মিটার উঁচু। ভবনের ভিতরে সিঁড়ি রয়েছে। আগে ভবনের নিচ দিয়ে যান চলাচলের ব্যবস্থা ছিল। তবে এখন শুধুমাত্র পথচারীরা যেতে পারেন।

বেল টাওয়ারের ভবনের কাঠের কারুকার্য অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। সি’আন বেল টাওয়ারের দোতলায় রয়েছে কবিতা লেখা কপলেট। চীনা ভাষায় একে বলা হয় ইংলিয়ান। দরজার দুই পাশে এই কপলেট ঝুলানো রয়েছে।

অতীতে এই ঘন্টা প্রহরে প্রহরে বাজিয়ে নগরবাসীকে সময় জানিয়ে দেয়া হতো। কোন জরুরি ঘোষণার আগেও ঘন্টা বাজানো হতো।

বর্তমানে সি’আন শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় পর্যটন স্থান এই বেল টাওয়ার।

পর্যটকদের জন্য দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘন্টা বাজানো হয়। ছয়শ বছর ধরে সি’আন নগরীর সুখ, দুঃখ, আনন্দ বেদনার সাক্ষী এই বেল টাওয়ার। এখানকার প্রাচীন ঘন্টাধ্বনি যেন অতীতের জীবনধারা তুলে ধরে।

প্রতিবেদন- শান্তা মারিয়া

সম্পাদনা- আফরিন মিম

 

৩। কুইচৌ: মিয়াও সংস্কৃতির আকর্ষণ

 

জাতিগত সংস্কৃতি সমৃদ্ধ করেছে দক্ষিণ পশ্চিম চীনের কুইচৌ প্রদেশের পর্যটনকে। ৪০ লাখ জনসংখ্যার প্রদেশেটি বসবাসকারী লোকদের বেশিরভাগই মিয়াও জাতিগোষ্ঠীর। পুরো চীনের মিয়াও জাতির অর্ধেকই বাস করেন এখানে। ঐতিহ্যবাহী মিয়াও গ্রাম হিসেবে তাদের অনন্য সংস্কৃতির জন্য অঞ্চলটি প্রতিদিন আকর্ষণ করছে হাজারেরও বেশি পর্যটককে।

 
কুইচৌর লাংতা গ্রাম। জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য এটি। মিয়াও সংস্কৃতির আস্বাদ উপভোগ করতে প্রতিদিন এখানে আসেন তিন থেকে চার হাজার দর্শনার্থী। এই গ্রামের অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দারুণ নকশা করা কাঠের ঘর। দর্শনার্থীরা মিয়াও ঐতিহ্যবাহী প্রথার পাশাপাশি উপভোগ করেন এখানকার ওয়াক্স প্রিন্টিং। 

 

 

এখানকার স্থাপত্য এবং মিয়াও জনগণের সংস্কৃতি বয়ে চলেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে। বর্তমানে স্থানীয় গ্রামবাসীরা ভাড়া দিচ্ছেন তাদের ঐতিহ্যবাহী মিয়াও পোশাকগুলো। পাশাপাশি নানা উপহার বিক্রি করেও আয় করছেন তারা। 

 

স্থানীয় উপহার সামগ্রী বিক্রেতা লিউ শিয়াওলং বলেন, ‘সচরাচর একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি কিন্তু পুরো চীন জুড়ে পরিচিত নয়। পর্যটকরা এখানে আসেন মূলত একটি অনন্য অভিজ্ঞতা নিতে।’


শুধু পর্যটকনের কারণেই এলাকাটি সমৃদ্ধ হচ্ছে না, এখানে বিনিয়োগেরও সুযোগ তৈরি হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে থাং হুও হুওর কথা। বেইজিং থেকে এখানে এসে তিনি চালু করেছেন হোম স্টে ব্যবসা। এখানকার ঐতিহ্যবাহী কাঠের ঘরগুলো ভাড়া নিয়ে তৈরি করেছেন হোম স্টে বা সরাইখানার বিজনেস।

 
 

 

হোম স্টে ব্যবসায়ী  থাং হুও হুও বলেন, ‘মানুষ আমাকে বলে এখানে বৃষ্টি ছাড়া তিনটা দিনও দেখা যায় না। আপনি কীভাবে থাকছেন। আমি তাদের বলি, আমি এখানে বাস করছি এক বছর ধরে। এখনকার রাতের বৃষ্টি এবং দিনের সূর্যাস্ত উপভোগ করতেই বলা যায় আমি পড়ে আছি। তারপর মানুষ আমাকে জিজ্ঞাসা করে, এখানকার রাস্তা কর্দমাক্ত ও পাথুরে, আমরা কীভাবে চলাফেরা করি? আমি বলি এখানকার রাস্তা ধীরে ধীরে মসৃণ ও পাকা হচ্ছে।’


জাতিগত পর্যটন বাড়ার সঙ্গে কুইচৌতেও বেড়েছে পর্যটকদের সংখ্যাও। চলতি বসন্তে চীনের শীর্ষ ১০ পর্যটকদের পছন্দের গন্তব্যের তালিকায় সেরা দশে স্থান পেয়েছে প্রদেশটি।

 

 

প্রতিবেদন- হোসনে মোবারক সৌরভ

সম্পাদনা-  আফরিন মিম

 

 

ঘুরে বেড়াই অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও প্রযোজনা - আফরিন মিম

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী