৯১তম পর্বে যা থাকছে:
১। নতুন ধরনের প্লুটোনিয়াম আইসোটোপ তৈরি
২। নিউট্রিনো সনাক্তে বিশ্বের বৃহত্তম যন্ত্র তৈরি করলো চীনে
নতুন ধরনের প্লুটোনিয়াম আইসোটোপ তৈরি
নতুন এক ধরনের প্লুটোনিয়াম আইসোটোপ তৈরি করেছেন চীনের বিজ্ঞান একাডেমির একদল বিজ্ঞানী। তারা এর নাম দিয়েছেন প্লুটোনিয়াম-২২৭। বর্তমানে এই নতুন আইসোটোপ সম্পর্কে আরও জানতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তারা। সম্প্রতি এ গবেষণার ফলাফল বিজ্ঞানের একটি জার্নালে প্রকাশ করা হয়।
চীনের বিজ্ঞান একাডেমির আধুনিক পদার্থবিদ্যা ইনস্টিটিউটের গবেষকদের নেতৃত্বে একটি গবেষণা দল নতুন প্লুটোনিয়াম আইসোটোপটি তৈরি করেছেন। প্রোটন এবং নিউট্রনের জাদু সংখ্যা, যেমন ২, ৮, ২০, ২৮, ৫০, ৮২ বা ১২৬ শেল বন্ধনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
গবেষণায় দেখা গেছে, ইউরেনিয়াম পর্যন্ত নিউট্রনের জাদু সংখ্যা ১২৬ এর এই শেল বন্ধনের প্রভাব কম হতে থাকে। অর্থাৎ, ইউরেনিয়ামের পরের ভারী মৌলগুলোতে এই জাদু সংখ্যার প্রভাব কম হতে পারে। বিজ্ঞানীরা এখন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন যে, আরও ভারী মৌলগুলোতে এই শেল বন্ধনের প্রভাব পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে কিনা।
আধুনিক পদার্থবিদ্যা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক কান চাইকুও জানান, একটি বিশেষ ধরনের পরমাণু, নেপটুনিয়ামের বিভিন্ন রূপে (আইসোটোপ) একটি নির্দিষ্ট ধরনের শক্তিশালী সংযোগ (শেল বন্ধন) পেয়েছেন। কিন্তু, তাদের কাছে পর্যাপ্ত পরীক্ষার ফলাফল নেই বলে তারারা নিশ্চিত হতে পারছেন না যে এই একই ধরনের সংযোগ আরেকটি পরমাণু, প্লুটোনিয়ামের বিভিন্ন রূপে কতটা শক্তিশালী বা স্থায়ী হবে।
প্লুটোনিয়ামের নতুন ধরনের পরমাণু খুঁজতে বিজ্ঞানীরা চীনে একটি বিশেষ যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করেছেন। এই যন্ত্রটি ভারী পরমাণুকে আলাদা করে এবং তাদের গঠন সম্পর্কে তথ্য দেয়।
বিজ্ঞানীরা একটি অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তি, ফিউশন বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্লুটোনিয়াম-২২৭ নামক একটি নতুন ধরনের প্লুটোনিয়াম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। এই প্লুটোনিয়াম আইসোটোপটি অত্যন্ত নিউট্রন-দুর্বল, অর্থাৎ এর নিউক্লিয়াসে অন্যান্য প্লুটোনিয়াম আইসোটোপের তুলনায় অনেক কম নিউট্রন রয়েছে।
আইসোটোপ মাস স্পেকট্রোমিটার নামক একটি যন্ত্রের সাহায্যে আবিষ্কৃত ৩৯তম নতুন আইসোটোপ। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এটিই প্রথম প্লুটোনিয়াম আইসোটোপ যা চীনা বিজ্ঞানীদের দ্বারা আবিষ্কৃত হয়েছে।
চীনের বিজ্ঞানীদের এই অসাধারণ অর্জন পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্লুটোনিয়াম-২২৭ এর আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের জন্য একটি নতুন গবেষণার ক্ষেত্র খুলে দিয়েছে এবং পারমাণবিক শক্তি ও প্রযুক্তির ভবিষ্যৎকে আরও উজ্জ্বল করে তুলতে পারে।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
নিউট্রিনো সনাক্তে বিশ্বের বৃহত্তম যন্ত্র তৈরি করলো চীনে
মহাবিশ্ব যেসব বস্তুকণা দিয়ে গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে উদ্ভট কণাটির নাম নিউট্রিনো। প্রতি মুহূর্তে এগুলো আপনার দেহ কিংবা পৃথিবী ভেদ করে চলে যাচ্ছে, কোনোরকম বাধা ছাড়াই। একটা-দুটো নয়, মাছের পোনার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে। কিন্তু কারও সঙ্গে কোনোরকম মিথস্ক্রিয়া করছে না। ঘন কুয়াশা ভেদ করে একটা বুলেট যেভাবে চলে যায়, পৃথিবীর এক প্রান্ত দিয়ে ঢুকে আরেক প্রান্ত দিয়ে নিউট্রিনোর বেরিয়ে আসাকেও তুলনা করা যায় অনেকটা সেরকম। এদের আচার-আচরণ অনেকটাই ভূতের মতো। এ কারণেই নিউট্রিনোকে বলা হয় ভুতুড়ে কণা। ঘোস্ট পার্টিকেল।
এই ভুতুড়ে কণাকে সনাক্ত করতে মাটির ৭০০ মিটার গভীরে বৃহৎ স্বচ্ছ গোলাকার সনাক্তকারী একটি বিশেষ যন্ত্র তৈরি করেছে চীনের বিজ্ঞানীরা। এই যন্ত্রের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের অনেক রহস্য সম্পর্কেও জানতে পারবেন। নিউট্রিনো কণা তিন ধরনের। ইলেকট্রন নিউট্রিনো, মিউয়ন নিউট্রিনো এবং টাউ নিউট্রিনো। নিউট্রিনোর একটা বিশেষ ধর্ম হলো, এদের এক ধরন থেকে আরেকটি ধরনে রূপান্তর করা যায়। অন্যান্য মৌলিক কণার সঙ্গে তুলনা করলে নিউট্রিনো আবিষ্কার সাম্প্রতিক। ইলেকট্রন নিউট্রিনো আবিষ্কৃত হয় ১৯৫৬ সালে এবং টাউ নিউট্রিনো ২০০০ সালে।
মহাবিশ্বে নিউট্রিনোর সংখ্যা প্রচুর। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, ফোটনের পর মহাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি তৈরি হয় এ কণা। পৃথিবীর প্রতি বর্গ সেন্টিমিটার ভেদ করে প্রতি সেকেন্ডে যে পরিমাণ নিউট্রিনো চলে যাচ্ছে, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। আমাদের সৌরজগৎ ছাড়াও এসব নিউট্রিনো আসছে মহাবিশ্বের অন্য কোনো জায়গা থেকে। কোনো নিউট্রিনো কণার জন্ম কোথায়, তার ওপর ভিত্তি করে এর শক্তির পরিমাণও ভিন্ন হয়।
এই শক্তির পরিমাণ মেপেই বিজ্ঞানীরা ওই নিউট্রিনো কণার উৎপত্তি কোথায়, তা বলতে পারেন। সেভাবেই নিউট্রিনোর উৎস সম্পর্কে জানা গেছে অনেক কিছু। যেমন: এদের কিছু আসছে আপনার পায়ের নিচের মাটির গভীর থেকে। এদের উৎস পাথরের প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তা। কিছুর উৎস আপনার নিজের দেহ। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, আপনার দেহের তেজস্ক্রিয়তার ফলস্বরূপ নিউট্রিনো বেরিয়ে আসছে। হিসেব মতে, আমাদের দেহ থেকেও প্রতি সেকেন্ডে বেশ কয়েক হাজার নিউট্রিনো নিঃসৃত হচ্ছে। আমাদের দেহে এগুলো তৈরি হওয়ার কারণ হাড় ও দাঁতের ভেতরে থাকা পটাশিয়াম মৌলের ক্ষয়।
দক্ষিণ চীনের কুয়াংতোং প্রদেশের চিয়াংমেন শহরের খাইফিংয়ের একটি পাহাড়ের গ্রানাইট স্তরে নিচে স্থাপিত এই ১২ তলা উচ্চতার অ্যাক্রিলিক গোলকটির ব্যাস ৩৫ দশমিক ৪ মিটার। একে চিয়াংমেন আন্ডারগ্রাউন্ড নিউট্রিনো অবজারভেটরি বলা হয়। চীনের বিজ্ঞান একাডেমি এবং কুয়াংতোং সরকারের উদ্যোগে ২০১৫ সালে শুরু হয় এই চ্যালেঞ্জিং প্রকল্পের নির্মাণ কাজ। বর্তমানে এই প্রকল্পের প্রায় শেষ পর্যায়ে। বিজ্ঞান একাডেমির হাই এনার্জি ফিজিক্স ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, পুরো ডিভাইসটির ইনস্টলেশন নভেম্বরের শেষের দিকে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর পূর্ণ কার্যক্রম ২০২৫ সালের আগস্ট মাসের শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
নিউট্রিনো কণার কাছে পুরো বিশ্বের প্রায় সবকিছু বাধাহীন। কোনো চেষ্টা ছাড়াই কণাটি দেয়াল, গ্রহ এবং গোটা নক্ষত্র ভেদ করে চলে যেতে পারে। যেমন একটা নিউট্রিনো কণা গড়ে ২৭০ ট্রিলিয়ন কিলোমিটারের পুরু লোহার দেয়াল ভেদ করে চলে যেতে পারে, প্রায় কোনো মিথস্ক্রিয়া ছাড়াই। অন্য কণার সঙ্গে কোনো রকম মিথস্ক্রিয়া না করা বা কম করার অন্যতম কারণ, কণাটি বৈদ্যুতিকভাবে চার্জ নিরপেক্ষ। এদের ভরও খুব কম। অতি হালকা কণা। একসময় এদের ভর নেই বলে ধারণা করা হতো। কিন্তু তা আসলে ঠিক নয়। নিউট্রিনো কণার ভর প্রায় শূন্য, তবে একেবারে শূন্য নয়। তবে তা এত ছোট যে এখনও সঠিকভাবে পরিমাপ করা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, একটি দাড়িপাল্লার একপাশে যদি একটা ইলেকট্রন রাখা হয়, তাহলে অন্য পাল্লাকে ভারসাম্যে আনতে প্রায় এক লাখ নিউট্রিনো লাগবে। এত অল্প ভরের কারণেই এরা আলোর প্রায় কাছাকাছি গতি চলতে পারে।
প্রশ্ন আসতে পারে, নিউট্রিনো শনাক্ত করে কী লাভ? মহাবিশ্ব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্যের যোগান দেয় নিউট্রিনো। অন্য কণার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে এ কণা মোটেও আগ্রহী নয়। তাদের এই অনাগ্রহই বিজ্ঞানীদের কাছে বেশি দরকারি। বিদ্যুৎচুম্বকীয় বিকিরণ এবং অন্যান্য কণারা মহাবিশ্বের অন্য কণাতে শোষিত হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নিউট্রিনো আলাদা। এই কণা মহাবিশ্বের দূরবর্তী এলাকা থেকে অন্য কারও সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া না করেই পৃথিবীতে অবিকৃত অবস্থায় চলে আসতে পারে।
নিউট্রিনো শনাক্ত করে বোঝা সম্ভব, কোনো পরমাণু চুল্লিতে কী পরিমাণ প্লুটোনিয়াম তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার কাছে এটি বেশ কার্যকরী তদন্তের হাতিয়ার। কারণ এর মাধ্যমে সংস্থাটি বুঝতে পারে, কেউ বা কোনো দেশ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে কি না। আবার যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিউট্রিনো ব্যবহার করা যায় কি না, তা নিয়ে গবেষণা চলছে। নিউট্রিনো দৃঢ় বস্তু ভেদ করে চলে যেতে পারে। তাই এর মাধ্যমে বাধাহীনভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এবং অন্য গ্রহে থাকা রোভার বা দূর মহাকাশের নভোযানে মেসেজ পাঠানো বা যোগাযোগ করা সম্ভব হবে। এসব চিন্তা করে এখন নিউট্রিনোভিত্তিক মোবাইল ফোন তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। আবার নিউট্রিনো বিকিরণ থেকে মোবাইল ফোন চার্জ করার চেষ্টাও করা হচ্ছে।
নিউট্রিনো রহস্য উন্মোচনের জন্য বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী যন্ত্র হিসেবে একটি হিসেবে জুনো কমপক্ষে ৩০ বছর ধরে কার্যক্রম পরিচালনা করবে বরে ধরণা করা হচ্ছে। অবজারভেটরিটি বিজ্ঞানীদেরকে নিকটবর্তী ইয়াংচিয়াং এবং থাইশান পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আসা নিউট্রিনোকে সনাক্ত এবং এর ভর সম্পর্কে ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করবে বলে জানান চিয়াংমেন আন্ডারগ্রাউন্ড নিউট্রিনো অবজারভেটরির প্রধান বিজ্ঞানী এবং হাই-এনার্জি ফিজিক্স ইনস্টিটিউটের প্রধান ওয়াং ইফাং।
নিউট্রিনো ভর স্তর বুঝতে পারলে মহাবিশ্বের ভৌত মডেল এবং মহাজাগতিক বিবর্তনের গবেষণায় ব্যপক সাফল্য অর্জন সম্ভব বলে জানান ওয়াং। এছাড়া এটি সুপারনোভা, বায়ুমণ্ডলীয় এবং সৌর নিউট্রিনো পর্যবেক্ষণের মতো অন্যান্য অত্যাধুনিক গবেষণা পরিচালনা করতেও সাহায্য করবে।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।
প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার
অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল
স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- ফয়সল আবদুল্লাহ
সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী