চীনের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার প্রসঙ্গ
2024-10-14 17:19:39

২০২১ সাল থেকে চীনের বিভিন্ন এলাকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে ‘দ্বৈত হ্রাস’ নীতি চালু হয়। তখন থেকে শিক্ষার্থীদের শরীরচর্চার ওপর আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি, হোমওয়ার্কের পরিমাণও আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। এদিকে, চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন অনেক বিষয় স্থান পেয়েছে এবং সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সাথে কারিগরি উচ্চশিক্ষার মানের সমতাবিধান করা হয়েছে। এমনি এক প্রেক্ষাপটে, সম্প্রতি চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের তথ্য-কার্যালয়ের প্রেস ব্রিফিংয়ে, চীনের গুণগত মানসম্পন্ন উন্নয়ন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে, শিক্ষা খাতের অগ্রগতি নিয়ে নাগরিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও এর সাফল্য নিয়ে আলোচনা করবো।

 

প্রেস ব্রিফিংয়ে চীনের শিক্ষামন্ত্রী হুয়াই চিন ফেং বাধ্যতামূলক শিক্ষা খাতের নতুন অগ্রগতির ওপর আলোকপাত করেন। তিনি জানান, বর্তমানে চীনের বাধ্যতামূলক শিক্ষার মান বিশ্বের উচ্চ আয়ের দেশগুলোর গড় মানের প্রায় সমান। বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে উপকৃত শিক্ষার্থীর মোট সংখ্যা ১৪০ কোটি পার্সনটাইমসে ছাঁড়িয়েছে। আর স্কুলগুলোর ‘পুষ্টিকর খাবার পরিকল্পনা’ মোট ৪২ কোটি পার্সনটাইমস শিক্ষার্থীর জন্য কল্যাণ বয়ে এনেছে।

 

বস্তুত, ২০২১ সালের জুলাই মাসে ‘দ্বৈত হ্রাস নীতি’ চালু হবার পর থেকেই, দেশের শিক্ষা খাতের পরিবর্তন ও সংস্কার সমাজের বিভিন্ন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করে। এ সম্পর্কে চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ওয়াং চিয়া ই বলেন, সংক্ষেপে বললে, এ খাতের সংস্কারকে ‘দুটি হ্রাস, দুটি বৃদ্ধি’ বলা যায়। এর মানে, বাধ্যতামূলক শিক্ষা পর্যায়ে স্কুলের বাইরে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্স ও শিক্ষার্থীদের হোমওয়ার্ক হ্রাস পেয়েছে এবং স্কুলের পর বিভিন্ন শিল্পকলা ও খেলাধুলার চর্চা আগের চেয়ে ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বাধ্যতামূলক শিক্ষা পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বহুমুখী দক্ষতার মানের উন্নয়ন ঘটেছে ও ঘটছে।

 

চীনের বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে প্রতি দুটি ক্লাসের মাঝখানের সময় বাড়ানো হয়েছে। এ সম্পর্কে উপমন্ত্রী ওয়াং বলেন, দুটি ক্লাসের মাঝখানের সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিদিন স্কুলে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার জন্য শিক্ষার্থীরা কমপক্ষে ২ ঘন্টা সময় পাচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

 

শিক্ষার মাধ্যমে দেশকে শক্তিশালী করা জনসংখ্যার গুণগত মান উন্নয়নের কার্যকর পদ্ধতি। চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ওয়াং কুয়াং ইয়ান বলেন, শহর ও গ্রামাঞ্চলের স্কুলের কাঠামো আরও উন্নত করা এবং শ্রেষ্ঠ স্কুলের প্রেসিডেন্ট ও দক্ষ শিক্ষকদের গ্রামাঞ্চলের স্কুলে বিনিময় বা পালাক্রমিকভাবে কাজ করার ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি।

 

দেশের জন্য দক্ষ কর্মী গড়ে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনার্স কোর্সের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। সম্প্রতি চীনের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনার্স কোর্সের মেজর সমন্বয় করেছে, যাতে চীনের সমাজের উন্নয়নের চাহিদা মেটানো যায়। গত ১২ বছরে চীনে নতুন করে ২১ হাজারটি অনার্স বিভাগ চালু হয়েছে এবং এর সাথে সাথে ১২ হাজারটি বিভাগ বাতিল করা হয়েছে। চলতি বছর চীনের জাতীয় কৌশলের চাহিদা মেটাতে, নতুন করে ১৬৭৩টি মেজর স্থাপন করা হয়েছে এবং সমাজ ও অর্থনীতির উন্নয়নের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ ১৬৭০টি মেজর বাতিল করা হয়েছে।

 

হাইটেক প্রযুক্তি প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী হুয়াই বলেন, মৌলিক বিষয় এবং আন্তঃবিভাগীয় বিষয় পরিকল্পনার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকর উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা হবে; যেমন, প্রযুক্তির হস্তান্তর ও গবেষণার সাফল্যের রূপান্তরে কার্যকর ব্যবস্থা স্থাপন করা জরুরি, যাতে অর্জিত জ্ঞান ও অনুশীলনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়। পাশাপাশি, উদ্ভাবনের ফলাফল ও শিল্প-উত্পাদনের চাহিদাকে সংযুক্ত করতে হবে; যুব-শিক্ষকদের দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা ও আন্তঃবিভাগীয় বিষয় নিয়ে গবেষণায় উত্সাহ দিতে হবে।

 

কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই, সাধারণ কারিগরি শিক্ষা এবং শ্রেষ্ঠ মানের কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা, চীনের বিভিন্ন মহলের জন্য দক্ষ কর্মীবাহিনী গড়ে তোলার জন্য জরুরি। এ সম্পর্কে শিক্ষা-বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁরা বলেন,

এক. সাধারণ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে শ্রমশিক্ষা ও কারিগরিসংশ্লিষ্ট শিক্ষাকোর্স চালু করা জরুরি, যাতে ছোটবেলা থেকে ছাত্রছাত্রীদের সংশ্লিষ্ট কাজের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে। মাধ্যমিক স্কুল ও সাধারণ উচ্চবিদ্যালয়ে কারিগরি শিক্ষায় অর্জিত ক্রেডিটকে পারস্পরিক স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা থাকাও জরুরি।

 

দুই. আঞ্চলিক অর্থনীতি ও শিল্পের উন্নয়নের চাহিদা বিবেচনা করে, উপযোগী প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করাও জরুরি। চীনের বিভিন্ন এলাকার অর্থনীতির কাঠামো ও প্রাধান্য শিল্প আলাদা; তাই, সংশ্লিষ্ট এলাকার চাহিদা বিবেচনা করে, দক্ষ ব্যক্তি গড়ে তোলা হলে তা স্থানীয় অর্থনীতি ও শিল্পের উন্নয়নের জন্য সহায়ক প্রমাণিত হবে।

 

তিন. দেশের বিভিন্ন এলাকার শিক্ষাদানের মান ও দক্ষ ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণের মান উন্নত করা জরুরি। প্রযুক্তির সংস্কার ও শিল্পের রূপান্তরের সুযোগ কাজে লাগিয়ে, সংশ্লিষ্ট মেজর, প্রশিক্ষণ কোর্স, পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক ও ইন্টার্নশিপের সংস্কারসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

চার. দক্ষ ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণে শ্রেষ্ঠ পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি। শ্রমের চেতনা আরও সম্প্রচারণ করতে হবে, যাতে আরও বেশি কর্মী নিজেদের কর্মদক্ষতা উন্নয়নে উত্সাহ পায়।

 

চমত্কার ও দক্ষ প্রকৌশলীরা দেশের অর্থনীতি ও সমাজের গুণগত মান উন্নয়নের চাবিকাঠি। শিক্ষামন্ত্রী হুয়াই বলেন, কম সময়ের মধ্যে চীনের বিভিন্ন এলাকায় চমত্কার ও দক্ষ প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ কর্মসম্মেলন আয়োজন করা হবে। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসারে, চীনের দক্ষ প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং আন্তর্জাতিক সমাজের সাথে সংশ্লিষ্ট সহযোগিতা জোরদার করা হবে।

 

বেইজিংয়ে নতুন সেমিস্টারে বাধ্যতামূলক শিক্ষায় ক্লাসে বিশ্রামের সময় বেড়েছে

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে, বেইজিংয়ের বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে, দুটি ক্লাসের মধ্যে বিশ্রামের সময় ১০ মিনিট থেকে বাড়িয়ে ১৫ মিনিট করা হয়েছে। ফলে, প্রাথমিক স্কুলে প্রতিদিন ক্লাসের মাঝখানে বিশ্রামের মোট সময় ৯০ মিনিট এবং মাধ্যমিক স্কুলে বিশ্রামের মোট সময় ১০৫ মিনিটে দাঁড়িয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা প্রতি দুটি ক্লাসের মাঝখানে বিশ্রামের সময় শরীরচর্চা করতে পারে এবং সহপাঠীদের সাথে খেলতে পারে। শিচিংশান এলাকায় বিভিন্ন পর্যায়ের স্কুলে সকাল ও বিকেলে দু’বার ৩০ মিনিটের বড় দুটি ব্রেকও দেওয়া হয়। নতুন সেমিস্টারে বিভিন্ন শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা নতুন ক্লাসের সময়সূচিও অনুসরণ করছে। প্রতিদিন ৬টি ক্লাস, সকালে দুটি ছোট ব্রেক আর একটি ৩০ মিনিটের ব্রেক; বিকেলে সাড়ে ৩টার দিকে স্কুলের সব ক্লাস শেষ। তবে, যদি ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মা অফিসের কাজের জন্য তাদের বাসায় নিয়ে যেতে না পারেন, তাহলে এমন শিক্ষার্থীরা স্কুলে হোমওয়ার্ক করতে বা বিভিন্ন শিল্পকলার প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নিতে পারে। তাঁরা স্কুলে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত অবস্থান করতে পারে।

নতুন ব্রেক সময় নিয়ে শিক্ষকরা বলছেন, আগের সময়সূচিতে সকাল ও বিকালে দুটি ৫ মিনিটের ছোট ব্রেকে ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে চোখের ব্যায়াম করানো হতো। তবে, এখন ৩০ মিনিটের দু’টি ব্রেক থাকায়, তারা সকালে খেলার মাঠে ব্যায়াম করতে পারে এবং বিকেলে শরীরচর্চা করতে পারে।

১৫ মিনিটের ক্লাস ব্রেকে আর কী কী খেলতে পারে শিক্ষার্থীরা? বেইজিং পেট্রোলিয়াম একাডেমির প্রাথমিক স্কুলে ক্যাম্পাসে নতুন করে লাইব্রেরি ও খামার নির্মাণ করা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা বিশ্রামের সময় বই পড়তে পারে বা কৃষিজাত দ্রব্যের পর্যবেক্ষণ করতে পারে। ছেলে-মেয়েরা নির্দিষ্ট এলাকায় শাটলকক বা ব্যাডমিন্টন খেলতে পারে। বর্তমানে তাদের স্কুলে নতুন করে খেলার মাঠ সাজানো হয়েছে, শিক্ষাভবনের শীর্ষ তলায় দুটি ছোট খেলার মাঠ নির্মিত হয়েছে। তা ছাড়া, ক্লাসরুমে জিগস পাজলসহ বিভিন্ন খেলনা ও কার্টুনের বই পাওয়া যায়।

বাচ্চারা ১৫ মিনিটের বিশ্রামের সময় বেশ পছন্দ করে। অনেকে বলে, আগে ১০ মিনিট যথেষ্ঠ ছিল না। যদিও মাত্র ৫ মিনিট বেড়েছে, তবে এ সময় অনেককিছু করা যায়। ব্রেকের সময় বাড়াতে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে অধিক মনোযোগও দিতে পারছে।

 (সুবর্ণা/আলিম/রুবি)