৮৯তম পর্বে যা থাকছে:
১। অ্যালপাকা প্রাণী থেকে এইচআইভি প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি পৃথক
২। মাছের আচরণ ও স্বাস্থ্যের উপর আলোর দূষণ
অ্যালপাকা প্রাণী থেকে এইচআইভি প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি পৃথক
এইচআইভি ভাইরাস মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেয় এবং এইডস রোগের জন্ম দেয়। বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা এই ভয়াবহ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছেন। নানা ধরনের ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে, তবে এখনও পর্যন্ত এইচআইভিকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার কোনো নিশ্চিত উপায় পাওয়া যায়নি।
এই পরিস্থিতিতে অ্যালপাকার দেহ থেকে পাওয়া এই বিশেষ পদার্থ আবিষ্কার, এইচআইভি নিরাময়ের লক্ষ্যে একটি বড় ধাপ। এই পদার্থটি এইচআইভি ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরীভাবে কাজ করতে সক্ষম বলে প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে। এর ফলে এইচআইভির নতুন ওষুধ তৈরি করা আরও সহজ হয়ে যাবে এবং এইডস রোগ নিরাময়ের সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক একাডেমিক জার্নাল নেচার কমিউনিকেশন্সে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। আর এই গবেষণাটি করেছেন চীনের বিজ্ঞানীরা।
নানচিং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনের অধ্যাপক উ চিওয়ে জানান, এন্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি বর্তমানে এইচআইভি প্রতিরোধের প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতি। এই চিকিৎসার মাধ্যমে এইচআইভি ভাইরাসটি শরীরে আরো বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পেতে বাধা দেওয়া হয়। তবে এইচআইভিকে সম্পূর্ণ নির্মূল করে না। নতুন এ অ্যান্টিবডিটি ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে এবং রোগীর আয়ুষ্কাল বাড়াতে সক্ষম।
এইচআইভি ভাইরাস আমাদের শরীরের কোষে প্রবেশ করার জন্য সিডি৪ রিসেপ্টর নামক একটি প্রবেশদ্বার ব্যবহার করে। নতুন পদ্ধতিটি এই প্রক্রিয়াকে বাধা দিয়ে এইচআইভি সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে। যাতে ভাইরাস কোষে ঢুকে বসতে না পারে।
গবেষক দলটি অ্যালপাকা থেকে হাজার হাজার সিডি৪ ন্যানোবডি (একটি ছোট, আরও স্থিতিশীল ধরনের অ্যান্টিবডি) আলাদা করেছেন। এই ন্যানোবডির মধ্যে একটি, যার নাম এনবি৪৫৭, এইচআইভি ভাইরাসকে আটকাতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা এইচআইভি ভাইরাসের ১১৭ ধরনের কৃত্রিম ভাইরাস তৈরি করেছিল। তারপর তারা এই কৃত্রিম ভাইরাসগুলোকে একটা বিশেষ ওষুধের সাথে মিশিয়ে দেখেছিল ওষুধটা কতটা কার্যকরী। এই ধরনের পরীক্ষা সাধারণত নতুন ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করার জন্য করা হয়। এখানে, বিজ্ঞানীরা হয়তো Nb457 নামক এই পদার্থটি এইচআইভির বিরুদ্ধে কতটা কার্যকরী তা পরীক্ষা করছিলেন।
গবেষণায় দেখা গেছে এনবি৪৫৭ নামক এই ওষুধটি ১১৬ ধরনের ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করতে সক্ষম। তাই একে ‘ব্রড-স্পেকট্রাম’ অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ বলা হয়।" গবেষক উ চিওয়ে আরও জানান, এনবি৪৫৭ থেকে তৈরি ট্রাইমেরিক ন্যানোবডিগুলো এইচআইভি খুবই কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করতে পারে।
বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করেছেন। এই পরীক্ষায় তারা দেখেছেন যে, যেসব ইঁদুরকে ওষুধ দিয়ে চিকিত্সা করা হয়েছিল, তাদের শরীরে সেই ভাইরাসটি খুব কমই পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি, ভাইরাসটি ওষুধের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারে এমন কোনো পরিবর্তনও দেখা যায়নি।
তবে এইচআইভি ভাইরাসটি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে। এই পরিবর্তনের কারণে ভাইরাসটি ওষুধের প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও সক্ষম। ফলে, এইচআইভি চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধগুলো আর আগের মতো কার্যকরী নাও হতে পারে। সহজ কথায়, এইচআইভি ভাইরাসটি ওষুধের প্রতিরোধী হয়ে ওঠে এবং ওষুধের কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
সাধারণত, ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে অ্যান্টিবডি সরাসরি ভাইরাসটিকে আক্রমণ করে। কিন্তু এই নতুন আবিষ্কৃত অ্যান্টিবডি একটু আলাদা কাজ করে। এটি ভাইরাসকে কোষে প্রবেশে বাধা দেয়। এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ভাইরাসের ওষুধ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অনেক কমে যায়। কারণ ভাইরাস যতই পরিবর্তিত হোক না কেন এ প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্ত করতে পারে না।
এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানীরা আরও একবার প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, প্রকৃতিই হলো আমাদের সবচেয়ে বড় ওষুধের ভান্ডার। অ্যালপাকা যেমন আমাদের এই অসাধারণ উপহার দিয়েছে, তেমনি ভবিষ্যতে আরও অনেক প্রাণী বা উদ্ভিদের দেহ থেকে নানা ধরনের রোগের চিকিৎসায় কার্যকরী পদার্থ আবিষ্কার করা সম্ভব।
তবে এর থেকে ওষুধ তৈরি ও সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছাতে আরও অনেক গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে, তাদের এই আবিষ্কার খুব শীঘ্রই এইডস রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিপ্লব ঘটাবে।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
মাছের আচরণ ও স্বাস্থ্যের উপর আলোর দূষণ
আলো দূষণ বিশেষ করে নীল আলো মাছের জীবনচক্রকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। চীনা বিজ্ঞানীদের গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য। এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল সায়েন্স অফ দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র কয়েক রাতে কৃত্রিম আলোর ফলে মাছের সাঁতার কাটার ক্ষমতা কমে যায়, তারা এক জায়গায় জড়ো হয়ে থাকে এবং অ্যাকুরিয়ামের দেয়ালের কাছে আশ্রয় নেয়। এমনকি, এই আলোতে জন্ম নেওয়া পোনা মাছগুলোও স্বাভাবিকের চেয়ে কম সক্রিয় থাকে।
মূলত নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম হওয়ায় এটি অন্যান্য রঙের আলোর তুলনায় বেশি শক্তিশালী এবং মাছের শরীরে আরও গভীরে প্রবেশ করতে পারে। ফলে এটি মাছের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর দ্রুত এবং গভীর প্রভাব ফেলে।
বর্তমানে মানুষের প্রযুক্তি নির্ভর এই ইট পাথরের জীবনে চারপাশে সড়ক বাতি, বিল্ডিংয়ের আলো, এবং বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের আলো সারারাত জ্বলজ্বল করে। এই অতিরিক্ত আলোই পরিবেশকে দূষিত করে এবং প্রাকৃতিক আলো-অন্ধকারের চক্রকে ব্যাহত করে। আলো এবং অন্ধকারের চক্র প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অনেক প্রাণীই এই চক্রের উপর নির্ভর করে তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিচালনা করে। আলো দূষণ এই চক্রকে ব্যাহত করে প্রাণীদের জীবনযাত্রাকে বিপন্ন করে
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অফ এনিম্যাল বিহেভিয়ারের পিএইচডি শিক্ষার্থী হিসেবে এ গবেষণাটি করেছে গবেষক ওয়েই ওয়েই লি। তিনি জানান, রাতে মানুষ যে আলো জ্বালায়, তা প্রাণীদের জন্য খুব ক্ষতিকর। এই আলো তাদের ঘুমকে বাধা দেয় এবং তাদের আচরণকে খারাপ করে দেয়। বিশেষ করে, তারা মাছের উপর পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, কয়েক রাত ধরে এই আলো জ্বালিয়ে রাখলে মাছ এবং তাদের বাচ্চাদের খাওয়া, সাতার ইত্যাদিতে সমস্যা হয়।
এই পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা দেখতে চেয়েছিলেন, বিভিন্ন রঙের আলো মাছের উপর কেমন প্রভাব ফেলে। তারা জেব্রাফিশ নামে একটি মাছকে রাতভর বিভিন্ন রঙের আলোতে রেখে পরীক্ষা করেছেন। পরীক্ষায় দেখা গেছে সব রঙের আলোই মাছের আচরণকে প্রভাবিত করেছে। আলোতে রাখার পর মাছ কম সাঁতার কাটতে শুরু করেছে এবং এক জায়গায় জমে থাকতে পছন্দ করেছে। বিশেষ করে নীল রঙের আলোর প্রভাব অন্য রঙের আলোর তুলনায় অনেক বেশি দ্রুত দেখা গেছে। নীল আলোতে রাখার মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যেই মাছের আচরণে বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে।
গবেষণা পত্রের অপর একজন লেখক জানান, এ বিষয়টি অনেকটা মানুষের সঙ্গেও মিল রয়েছে। যে মানুষ যখন মোবাইল, কম্পিউটার বা ট্যাবলেটের মতো ইলেকট্রনিক যন্ত্র ব্যবহার করে, তখন সেখান থেকে নির্গত নীল আলো ঘুমকে খুব খারাপভাবে প্রভাবিত করে। এছাড়াও, শরীরের অন্যান্য কাজকর্মও এই আলোর কারণে ব্যাহত হতে পারে।
এই গবেষণা থেকে আরও জানান গেছে, আলো দূষণের প্রভাব শুধুমাত্র এক প্রজন্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং পরবর্তী প্রজন্মের উপরও এর প্রভাব পড়ে।
বিজ্ঞানীরা রাতে আলো জ্বালানোর ক্ষেত্রে সচেতন হওয়ার কথা বলেছেন। বিশেষ করে, নীল রঙের আলো প্রাণীদের জন্য খুব খারাপ। তাই যেখানে প্রাণীরা ঘুমায়, সেখানে নীল রঙের আলো কম ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।
প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার
অডিও সম্পাদনা- নাসরুল্লাহ রাসু
স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- ফয়সল আবদুল্লাহ
সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী