মেড ইন চায়না : পর্ব-১৯ : ফাস্ট টেলিস্কোপ
2024-10-07 17:30:45


হাজার বছর আগের কাগজ, চা এবং নুডলস থেকে শুরু করে আজকের প্যাসেঞ্জার ড্রোন, কিংবা নতুন জ্বালানির গাড়ি। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে চলেছে চীনের শক্তিশালী আবিষ্কারের হাত ধরে। নানা সময়ে দারুণ সব আবিষ্কার করে আধুনিক সভ্যতার ভিত গড়ে দিয়েছে চীন। আর সেই সব আবিষ্কার নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন মেড ইন চায়না। 

মেড ইন চায়নার ১৯তম পর্বে সাথে আছি আমি ফয়সল আবদুল্লাহ...আজকের পর্বে থাকছে চীনের আবিষ্কার বিশ্বের সবচেয়ে বড় রেডিও টেলিস্কোপ ফাস্ট-এর কথা।

 

সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মহাকাশ এক অপার রহস্যের ডালি। দূর দূরান্তের গ্রহ নক্ষত্রের রহস্য উন্মোচনে মরিয়া হয়ে আকাশপানে চেয়ে আছে একরাশ চোখ। মানুষের চোখ তো আর বেশিদূর দেখতে পায় না, তাই চারশ বছর আগে তৈরি করা হলো যান্ত্রিক চোখ তথা টেলিস্কোপ। যে টেলিস্কোপের কল্যাণে একে একে খুলতে শুরু করে মহাকাশের রহস্য-বাকশোগুলো। দিনে দিনে বিশ্ব যত আধুনিক হয়েছে, ততই বেড়েছে পৃথিবীর চোখ ওরফে সেই টেলিস্কোপের ক্ষমতা। এর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর টেলিস্কোপটি হলো রেডিও টেলিস্কোপ। আর এই মুহূর্তের বিশ্বের সবচেয়ে বড় রেডিও টেলিস্কোপটি আছে চীনে। যার নাম ফাইভ হান্ড্রেড মিটার অ্যাপারচার রেডিও স্ফেরিক্যাল টেলিস্কোপ। সংক্ষেপে এফ এ এস টি বা ফাস্ট। প্রতিনিয়ত মহাবিশ্বের লাখ লাখ তথ্য প্রদানকারী ফাস্ট টেলিস্কোপ বিশ্বে মাথা উঁচু করে রাখা এমন এক আবিষ্কার, যা কিনা পুরোপুরি মেড ইন চায়না।


ফাস্ট টেলিস্কোপটিকে চীনাভাষায় বলা হয় থিয়ানইয়ান। এর মানে হলো স্বর্গের চোখ, যা স্থাপন করা হয়েছে চীনের কুইচৌ প্রদেশের তাওয়াতাং নামের একটি অতিকায় প্রাকৃতিক গর্তের মধ্যে। সাড়ে চার কোটি বছর আগে গ্রহাণুর আঘাতে তৈরি হওয়া ওই গর্তে ২০১৬ সালে ৫০০ মিটার ব্যাসের এই সুবিশাল রেডিও টেলিস্কোপটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। 

 

২০১১ সালে শুরু হয় কাঠামোর নির্মাণ। ৫ বছর পর মহাকাশের প্রথম আলোর সংকেত ধরা পড়ে এতে। ২০২০ সালে পুরোদমে কাজ শুরু করে টেলিস্কোপটি। চীন সরকারের অর্থায়নে তৈরি টেলিস্কোপটির দায়িত্ব পায় চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সেসের ন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেটরিজ। 


মহাবিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অনবরত ছুটে আসা রেডিও সংকেত শনাক্ত করাই এ টেলিস্কোপের কাজ। টেলিস্কোপটিতে আছে সাড়ে ৪ হাজার ধাতব প্যানেল। অধিবৃত্তাকার এই প্যানেলগুলোকে চাইলে প্রয়োজনমতো ঘোরানো যায়। এতে করে আকাশের নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলজুড়ে এটিকে তাক করা যায়। প্যানেলগুলোয় এসে পড়ে রেডিও সংকেত। সেই সংকেত তাৎক্ষণিকভাবে পৌঁছে যায় টেলিস্কোপের কেন্দ্রে থাকা ফোকাল পয়েন্ট বা ফিড কেবিনে। মূল ডিশ থেকে ১৪০ মিটার উঁচুতে থাকা ওই কেবিনটি হলো এই টেলিস্কোপের প্রাণকেন্দ্র। তাতেই প্রক্রিয়াকরণ করা হয় প্রতিফলিত রেডিও সংকেত। 


২০১৭ সালের আগস্টে, পৃথিবী থেকে ১৬ হাজার ও চার হাজার একশ আলোকবর্ষ দূরের দুটো পালসার নক্ষত্র শনাক্ত করে ফাস্ট। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এটি শনাক্ত করেছে ৯০০টিরও বেশি নতুন পালসার নক্ষত্র। সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, গত ৫০ বছরে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা সব মিলিয়ে মোট তিন হাজার পালসার নক্ষত্র শনাক্ত করতে পেরেছেন। 

কিন্তু ফাস্ট-এর জন্য এই পালসার নক্ষত্র শনাক্ত করাটা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষকরা জানিয়েছেন, মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণার দুটো বড় বিষয় হলো মাধ্যাকর্ষণজনিত রেডিয়েশন ও ব্ল্যাকহোল। এ দুটো গবেষণাতেই প্রাথমিক তথ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় পালসার নক্ষত্র থেকে আসা রেডিও তরঙ্গ। 

গতবছর চীনের তৈরি এই টেলিস্কোপে শনাক্ত করা হয় এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় মেঘ বলয়। হাইড্রোজেন পরমাণুর তৈরি ওই মেঘ বলয়টি ছিল ২০ লাখ আলোকবর্ষ চওড়া, যা কিনা আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির চেয়েও ২০ গুণ বড়। 

 


ফাস্ট নিয়ে এবার জেনে নিই আরও কিছু তথ্য

ফাস্ট-এর রেডিও সংকেত রিসিভিং এরিয়া প্রায় আড়াই লাখ বর্গমিটার। যা কিনা ৩০টি ফুটবল মাঠের সমান। এর আগেকার শক্তিশালী রেডিও টেলিস্কোপটির চেয়ে ফাস্টের সংকেত গ্রহণের ক্ষমতা আড়াই গুণ বেশি।

ফাস্ট-এর আশপাশের ৫ কিলোমিটার এলাকা হলো রেডিও-সাইলেন্ট এলাকা। অর্থাৎ এই সীমারেখার মধ্যে মোবাইল ফোন, ওয়াই ফাই সহ রেডিও তরঙ্গ ছড়ায় এমন যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিষিদ্ধ। 

আমাদের গ্যালাক্সিতে হাইড্রোজেন কোথায় কিভাবে ছড়িয়ে আছে সেটার মানচিত্র তৈরি করে ফাস্ট। 

টেলিস্কোপের প্যানেলগুলো ঘোরানোর জন্য  এর ঠিক নিচেই আছে ২২২৫টি কপিকল। 

পালসার নক্ষত্র বা হাইড্রোজেনের মানচিত্র তৈরি ছাড়াও বিশেষ রেডিও সংকেত খুঁজে বেড়ায় ফাস্ট। বিশেষ করে ভিনগ্রহের কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী যদি রেডিও সংকেত পাঠায়, তবে সেটা সহজে এড়িয়ে যাবে না ফাস্টের কান। 

এটি মিল্কিওয়ে এবং অন্যান্য ছায়াপথের মানচিত্র তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে নক্ষত্রের গঠন এবং গ্যালাক্সি ঘূর্ণন এবং সেগুলোর গঠন ও গতিবিদ্যা সম্পর্কেও বিজ্ঞানীদের হালনাগাদ তথ্য দিয়ে চলেছে টেলিস্কোপটি।


চীনের এ অভাবনীয় আবিষ্কারটি শুধু চীনের জন্যই সীমাবদ্ধ নেই। ফাস্ট-এ যে চীনা গবেষকরা কাজ করছেন তারা প্রায়ই বলে থাকেন, মহাকাশ গবেষণার কোনো দেশের সীমারেখায় আটকে থাকতে পারে না। তাই চীনের তৈরি এ সুবিশাল টেলিস্কোপে পাওয়া তথ্য নিয়ে গবেষণা করছেন আন্তর্জাতিক গবেষকরাও। 

চীনের ফাস্ট-এর সঙ্গে এখন যৌথভাবে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইনস্টিটিউট বা এসইটিআই, জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সস্টিটিউট ফর রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি, অস্ট্রেলিয়ার কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশন, ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরি, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিক্স এবং রাশিয়ার একাডেমি অব সায়েন্সসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান। 


ফাস্টের কাজকর্মের পরিধি কিন্তু ৫০০ মিটারে আটকে রাখতে রাজি নন চীনা বিজ্ঞানীরা। চলছে ফাস্টের দ্বিতীয় পর্যায়ের উন্নয়নের কাজ। নতুন পরিবর্ধন প্রকল্পে ফাস্ট সাইটের ৫ কিলোমিটারের মধ্যে স্থাপন করা হবে ২৪টি সেকেন্ডারি ৪০ মিটার আকারের অ্যান্টেনা। ২০২৭ সাল নাগাদ শেষ হবে দ্বিতীয় ধাপের নির্মাণকাজ।

এর লক্ষ্য হলো টেলিস্কোপটির সংবেদনশীলতা বাড়ানো এবং একে একটি উচ্চ কৌণিক রেজুলেশন দেওয়া।

 

বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে সংবেদনশীল রেডিও টেলিস্কোপ হিসাবে, চীনের তৈরি ফাস্ট শুধু যে মহাজাগতিক রহস্য উন্মোচনই করছে তাই নয়, বরং মানব জ্ঞানের সীমানাকেও এটি নিয়ে যাচ্ছে আরও বহুদূর। তত্ত্বীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গভীর মহাকাশ অনুসন্ধানেও যে চীন রকেটের গতিতে এগিয়ে চলেছে, তারই সুবিশাল সাক্ষী এই ফাইভ হান্ড্রেড মিটার অ্যাপারচার রেডিও স্ফেরিক্যাল টেলিস্কোপ।



গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

অডিও সম্পাদনা: নাজমুল হক রাইয়ান

কণ্ঠ: শান্তা/ফয়সল

সার্বিক তত্ত্বাবধান: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী