চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব ৯০তম পর্ব
2024-10-07 17:38:53


৯০তম পর্বে যা থাকছে:

 

১। মস্তিষ্কের জটিল রহস্যের অনুসন্ধান

২। চীনের প্রাচীন পনির আবিষ্কার


মস্তিষ্কের জটিল রহস্যের অনুসন্ধান

একটি প্রাপ্তবয়স্ক মাছির মস্তিষ্কের মানচিত্র তৈরিতে সাফল্য অর্জন করেছেন বিজ্ঞানীরা। নিউরোবায়োলজিক্যাল গবেষণায় যা বেশ ভালো অবদান রাখবে। এতে করে মানুষসহ সব প্রাণীর মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে সেটাও জানা যাবে। এ ছাড়াও, এই গবেষণা মস্তিষ্কের রোগের কারণ এবং চিকিৎসা আবিষ্কারে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।

 

সম্প্রতি নেচার জার্নালে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। ফ্লাইওয়্যার কনসোর্টিয়াম নামে পরিচিত একদল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী গবেষণাটি করেছেন।


গবেষণায় এই মাছির মস্তিষ্কের প্রায় ১ লাখ ৩৯ হাজার নিউরনের মাঝে (মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষ) ৫ কোটিরও বেশি সংযোগের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। মাছিটির বৈজ্ঞানিক নাম ড্রোসোফিলা মেলানোগাস্টার। নিউরোবায়োলজিক্যাল গবেষণায় প্রায় ব্যবহৃত হয় এটি।

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্স এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানের অধ্যাপক সেবাস্টিয়ান সিউং জানান, মাছির মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে সেটা জানতে পারলে তা মানুষসহ আরও কিছু প্রাণীর নিউরোবায়োলজিক্যাল গঠন সম্পর্কেও জানা যাবে।


মাছির মস্তিষ্কের নিউরাল নেটওয়ার্কের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন গবেষকরা। এর মস্তিস্ক মাত্র ১ মিলিমিটারেরও কম প্রস্থের। মানচিত্রে পরিষ্কার বোঝা যায় এত ক্ষুদ্র মগজের ভেতর নিউরনগুলো কীভাবে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এর আগে তারা এই কাজটি কৃমি এবং ফলের মাছির লার্ভা নিয়েও করেছিলেন। কিন্তু পূর্ণবয়স্ক ফলের মাছির জটিল আচরণের কারণে মস্তিষ্কের গবেষণা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল।

অপর গবেষক প্রিন্সটন নিউরোসায়েন্টিস্ট মালা মূর্তি জানান, গবষেণায় তারা মস্তিষ্কের নিউরাল সংযোগ কীভাবে প্রাণীর আচরণে ভূমিকা রাখে সেটাও দেখেছে। আর এ কাজে মাছির নিউরাল নেটওয়ার্কটি হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ মডেল সিস্টেম। মাছির মস্তিষ্ক মানুষের মস্তিষ্কের মতোই অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে। যেমন, তারা হাঁটা, ওড়া, কোনো কিছু শেখা, স্মরণ করা, নতুন জায়গা খুঁজে বের করা, খাওয়া এবং এমনকি অন্য মাছির সাথে যোগাযোগও করতে জানে। এই সমস্ত কাজ দেখেই মূলত বিজ্ঞানীরা মাছির মস্তিষ্ক নিয়ে আগ্রহী হন।

গবেষকরা মাছির বিভিন্ন কার্যকলাপ সম্পর্কে জানতে একাধিক গবেষণা করেছেন। একটি গবেষণায় মাছির হাঁটার সঙ্গে জড়িত মস্তিষ্কের নেটওয়ার্ক বিশ্লেষণ করেছেন। আবার ওড়া থেকে কীভাবে  মাছি থেমে যায় সেটাও বিশ্লেষণ করেছেন। এ ছাড়া একটি পা ব্যবহার করে মাছি কীভাবে তার শরীর ধুলা সরিয়ে নেয় এবং এ জাতীয় আচরণের পেছনে কোন নিউরন কাজ করে তা নিয়েও গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানীরা।


|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা:  ফয়সল আবদুল্লাহ



চীনের প্রাচীন পনির আবিষ্কার

চীনের থারিম বেসিনে প্রায় ৩ হাজার ৬০০ বছর আগের মমির পাশে পাওয়া প্রাচীন পনির থেকে প্রথমবারের মতো সফলভাবে ডিএনএ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছেন দেশটির বিজ্ঞানীরা। এই পনিরটির বৈশিষ্টের দিক থেকে আজকের দিনে খাওয়া কেফির পনিরের মতোই। এই সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল সেল জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে। এই আবিষ্কারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি পনিরের উৎপত্তি এবং ভালো ব্যাকটেরিয়া বা প্রোবায়োটিকের বিবর্তনের ব্যাপারে অনেক কিছু শিখতে সাহায্য করবে।

 

চীনের বিজ্ঞান একাডেমির ভার্টেব্রেট প্যালিওনটোলজি এবং প্যালিওঅ্যানথ্রোপোলজি ইনস্টিটিউটের ছিয়াওমেই ফু জানান, এটি বিশ্বে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাচীনতম পনির নমুনাগুলোর একটি। হাজার হাজার বছর ধরে পনিরের মতো খাবার সংরক্ষণ করা অত্যন্ত কঠিন, এটি অত্যন্ত বিরল এবং মূল্যবান। প্রাচীন পনিরের বিস্তারিত অধ্যয়ন পূর্বে খাদ্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করতে পারে।

প্রায় দুই দশক আগে প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি দল উত্তর-পশ্চিম চীনের থারিম বেসিনের শিয়াওহ্য সমাধিস্থলে পাওয়া বেশ কয়েকটি মমির মাথা ও ঘাড়ে লেগে থাকা রহস্যময় সাদা পদার্থ আবিষ্কার করে। এই মমির বয়স প্রায় ৩ হাজার ৩০০ থেকে ৩ হাজার ৬০০ বছর। শুরুর দিকে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন এই পদার্থগুলো কোনো ধরনের দুগ্ধজাত পণ্য হতে পারে, তবে তারা নিশ্চিত হতে পারেনি।

 

তবে এক দশকের প্রচেষ্টার পর ডিএনএ বিশ্লেষণে ফুর নেতৃত্বে একটি দল রহস্যটি উন্মোচন করেছেন। গবেষকরা তিনটি ভিন্ন সমাধি থেকে পাওয়া নমুনা থেকে সফলভাবে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ সংগ্রহ করেছেন। তারা পনির নমুনাগুলোতে গরু এবং ছাগলের ডিএনএ চিহ্নিত করেছে। প্রাচীন শিয়াওহ্য মানুষ পৃথকভাবে বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর দুধ ব্যবহার করত।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ফু এবং তার সহকর্মীরা দুধের নমুনা থেকে সুক্ষ্মজীবের ডিএনএ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং নিশ্চিত করেছিলেন যে সাদা পদার্থগুলো আসলে কেফির পনির ছিল। তারা আবিষ্কার করেছেন নমুনাগুলোতে ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক প্রজাতি ছিল। অর্থাৎ সেই নমুনায় ল্যাকটোব্যাসিলাস কেফিরানোফেসিয়েন্স আর পিচিয়া কুদ্রিয়াভজেভি নামে দুই ধরনের ব্যকটেরিয়া আছে, যা আজকের দিনেও কেফিরে পাওয়া যায়।

 

কেফির শস্য দানার ভেতরে অনেক ধরনের ভালো ব্যাকটেরিয়া থাকে যা দুধকে জমাট বাঁধিয়ে দেয় এবং তাতে একটা টক স্বাদ আনে।

প্রাচীন কেফির পনিরে ব্যাকটেরিয়াল জিন সিক্যুন্স করতে পারার ফলে দলটি প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া গত ৩ হাজার ৬০০ বছরে কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে তা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষ করে, তারা প্রাচীন কেফির পনির থেকে প্রাচীন ল্যাক্টোব্যাসিলস কেফিরানোফ্যাসিয়েন্সকে আধুনিক যুগের প্রজাতির সাথে তুলনা করতে সক্ষম হয়েছেন।

পূর্বে সবাই মনে করতো যে কেফির উৎপত্তি আসলে রাশিয়ার উত্তর ককেশাস পর্বত অঞ্চল। কিন্তু এই নতুন আবিষ্কারটা সেই ধারণাকে একটু বদলে দিচ্ছে। এখন বোঝা যাচ্ছে যে কেফির হয়তো তিব্বত থেকেও আসতে পারে। গবেষণা দেখা গেছে, দুধ জমা করার কাজে ব্যবহৃত ল্যাকটোব্যাসিলাস কেফিরানোফেসিয়েন্স ব্যকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়া অন্য এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সাথে নিজের জিনগত তথ্য আদান-প্রদান করে। একে জেনেটিক উপাদান বিনিময় বলে। এই প্রক্রিয়ার ফলে এই ব্যাকটেরিয়াটি আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে। ফলে, এই ব্যাকটেরিয়া দুধকে আরও ভালোভাবে জমা করতে পারে।

এই আবিষ্কারটি খাদ্য বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান এবং প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে। ভবিষ্যতে আরও অনেক প্রাচীন ডিএনএ বিশ্লেষণ করে খাদ্যের ইতিহাস এবং বিবর্তন সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।


|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা:  ফয়সল আবদুল্লাহ


নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।


প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার


অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল


স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- ফয়সল আবদুল্লাহ

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী