‘চীন ভ্রমণ’ ক্রমাগত জনপ্রিয় হচ্ছে
2024-10-03 18:56:54

বেইজিং পাতাল রেল ও ছেংতু রাস্তা থেকে হাংচৌ হ্রদ পর্যন্ত, সম্প্রতি, কিছু দেশীয় পর্যটন শহরে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক বিদেশী বন্ধুরা বেড়াতে এসেছেন, সুস্বাদু খাবারের স্বাদ নিতে, পান্ডার সাথে ছবি তুলতে এবং স্কোয়ার নাচের অভিজ্ঞতা নিতে এসেছেন।

সোশ্যাল মিডিয়াতে, ‘চায়না ভ্রমণ’ লেবেলটি অনেক ব্লগারের নেটওয়ার্ক ট্রাফিকের’র পাসওয়ার্ড’ হয়ে উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক লোক তাদের চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন এবং চীন ভ্রমণ সম্পর্কে ‘সবচে শক্তিশালী বক্তা’ হয়ে উঠেছেন।

‘নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে আমি দেখতে পেলাম যে, এই জায়গা অত্যন্ত পরিষ্কার। পার্কে অনেক লোক ব্যায়াম করছেন...’শহরের প্রাচীরে দাঁড়িয়ে ঘড়ির টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে এবং দেয়ালের পাদদেশে বরাবর হাঁটা, ব্রিটেন থেকে আসা ক্রিসের পরিবারের পাঁচজন সদস্য সি’আন শহরে এক সপ্তাহ কাটিয়েছেন এবং বিদেশী নেটিজেনদের সাথে ভাগ করার জন্য তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে এক একটি ভিডিও তৈরি করেছেন, যা প্রচুর মনোযোগ এবং পছন্দ পেয়েছে।

ক্রিসের মতো আরও বেশি সংখ্যক বিদেশী পর্যটক চীন ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন।

সম্প্রতি চীনের জাতীয় অভিবাসন প্রশাসন প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় যে, এই বছরের প্রথমার্ধে ১৪.৬৩৫ মিলিয়ন বিদেশী বিভিন্ন বন্দরের মাধ্যমে চীনে প্রবেশ করেছে, এই সংখ্যা গত বছরের অনুরূপ সময়ের চেয়ে ১৫২.৭ শতাংশ বেশি। তাদের মধ্যে ৮.৫৪২ মিলিয়ন বিদেশি ভিসা-মুক্ত উপায়ে চীনে প্রবেশ করেছেন এবং যা মোট সংখ্যার ৫২ শতাংশ। বছরের দ্বিতীয়ার্ধেও চীনে বিদেশীদের ভ্রমণের চাপ অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সিট্রিপ ডেটা দেখায় যে, এই বছরের প্রথমার্ধে, অভ্যন্তরীণ ভ্রমণের অর্ডারগুলো গত বছরের অনুরূপ সময়ের চেয়ে ১.৬ গুণেরও বেশি বেড়েছে৷ ২০১৯ সালের সাথে তুলনা করে, চীনে প্রবেশকারী শীর্ষ ২০টি উত্স দেশের প্রায় কোনও পরিবর্তন নেই, তবে উচ্চতর আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পুনরুদ্ধারের হার বা ভিসা-মুক্ত নীতিগুলো উপভোগ করা দেশগুলোর অর্ডার বৃদ্ধির হার আরও স্পষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।

সাক্ষাত্কারে সাংবাদিকরা দেখেছেন যে, ভ্রমণের গন্তব্যগুলো বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিদেশী পর্যটকদের আলাদা পছন্দ রয়েছে। বেইজিং, শাংহাই এবং কুয়াংচৌয়ের মতো উচ্চ মাত্রার আন্তর্জাতিকীকরণের প্রথম-স্তরের শহরগুলো প্রায়শই প্রথমবার চীনে আসা বিদেশিদের বাছাই। ছেংতু, চাংচিয়াংচিয়ে, সিনচিয়াং এবং ছোংছিংসহ নানা জায়গায় দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার চীনে আসা বিদেশী ভ্রমণকারীদের বাছাই হয়ে ওঠে।

চীন পর্যটন একাডেমির অন্তর্মুখী পর্যটকদের সন্তুষ্টির উপর একটি বিশেষ জরিপ দেখায় যে, উত্তরদাতাদের ৬০ শতাংশের বেশি ‘চীনা সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা’ চীন ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচনা করেন।

আমেরিকান ব্রায়ান লিন্ডেন ২০ বছর ধরে চীনে বসবাস করেছেন। তিনি ইউননানে যে হোটেলটি চালান তা গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অনেক স্কুলের সাথে সহযোগিতা করে। তিনি মনে করেন, পর্যটন শুধুমাত্র দর্শনীয় স্থানগুলোর জন্য নয়, এটি বিভিন্ন দেশের লোকেদের মধ্যে যোগাযোগ এবং বোঝাপড়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যানেল। ব্রায়ান লিন্ডেন বলেন, মার্কিন শিক্ষার্থীরা যখন চীনে আসেন, তখন তারা চীনা সংস্কৃতিতে গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছেন এবং চীনাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছেন।

ইতালীয় ট্র্যাভেল এজেন্ট এনরিকো রাদ্রিজানি ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পর্যটন শিল্পে নিযুক্ত রয়েছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন যে, ইতালীয় পর্যটকরা প্রাচীন স্থান ও জাদুঘর পরিদর্শন করতে এবং চীনা লোক প্রথার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পছন্দ করেন। তিনি মনে করেন, আমরা চীনে ভ্রমণ করার মাধ্যমে কেবল ফটোগুলোই লাভ করি না, বন্ধুত্বও অর্জন করেছি।

কুয়াংচৌ কুয়াংচিলুই ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেল সার্ভিস লিমিটেড কোম্পানির অন্তর্মুখী পর্যটন ব্যবসা বিষয়ক প্রধান দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ফাং ফাং বলেছেন যে, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কিছু শিক্ষার্থী গোষ্ঠী চীনা কোম্পানি যেমন হুয়াওয়ে এবং বিওয়াইডি, সেইসাথে চালকবিহীন যানবাহন ও ড্রোনসহ নান শিল্পের প্রতি খুব আগ্রহী। তারা চীনের অর্থনীতির উন্নয়নের বিস্তারিত তথ্য সম্পর্কে জানতে চায়।

‘চীন ভ্রমণ’ করার জন্য বিদেশীদের ক্রমবর্ধমান উত্সাহের পিছনে রয়েছে চীনের ভিসা-মুক্ত ‘বন্ধু বলয়ের’ বারবার সম্প্রসারণ।

২০২৩ সালের পহেলা ডিসেম্বর থেকে চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, স্পেন এবং মালয়েশিয়া ছয়টি দেশের সাধারণ পাসপোর্টধারীদের জন্য একটি একতরফা ভিসা-মুক্ত নীতি প্রয়োগ করেছে।

২০২৪ সালের ১৪ মার্চ থেকে ভিসা-মুক্ত নীতিটি সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম এবং লুক্সেমবার্গের সাধারণ পাসপোর্টধারী ব্যক্তিদের জন্য প্রসারিত করে প্রয়োগ করেছে।

২০২৪ সালের পহেলা জুলাই থেকে চীন নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং পোল্যান্ডের সাধারণ পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা-মুক্ত নীতি কার্যকর করেছে।

এ ছাড়াও ১৮টি প্রদেশ, স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল এবং পৌরনগরের ৩৮টি বন্দর বর্তমানে ৫৪টি দেশের জনগণের জন্য ৭২ ঘন্টা বা ১৪৪ ঘন্টা ট্রানজিট ভিসা-মুক্ত নীতি বাস্তবায়ন করেছে।

অর্থপ্রদানের সুবিধার উন্নতি, মনোরম স্থানগুলোর টিকিট কেনার রিজার্ভেশন ও ক্রয় পদ্ধতি অপ্টিমাইজ করা এবং বহুভাষিক সাংস্কৃতিক ও পর্যটন পরিষেবা প্রদান করা... এই বছরের শুরু থেকে বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন বিভাগ বিদেশী পর্যটকদের অভ্যন্তরীণ ভ্রমণের সুবিধার্থে ধারাবাহিক ব্যবস্থা চালু করেছে।

পরিবর্তনটা অনুভব করলেন জার্মান পর্যটক কেন গোফি। গত বছর যখন তিনি চীনে আসেন, তখন তিনি ইলেকট্রনিক পেমেন্ট করার জন্য বন্ধুদের সাহায্য চেয়েছিলেন। চলতি বছর কুয়াংচৌতে পৌঁছানোর পর তিনি আবিষ্কার করেছেন যে, একটি মোবাইল পেমেন্ট সফ্টওয়্যারের সাথে একটি ব্যাঙ্ক কার্ড সংযুক্ত করার পর তিনি সফলভাবে ট্রেনের টিকিট বুক করতে এবং স্টেশনে প্রবেশের জন্য সাবওয়ে কোড স্ক্যান করতে পারেন।

এই বছরের জুন মাসের শেষ থেকে কুয়াংচৌ শহর আন্তর্জাতিক ট্রানজিট যাত্রীদের বিনামূল্যে একদিনের ভ্রমণ পরিষেবা প্রদান করেছে, যার মধ্যে রয়েছে বিনামূল্যে ভ্রমণ বাস, ইংরেজি-ভাষী ট্যুর গাইড, দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন, স্ন্যাক-লাঞ্চ ইত্যাদি।

কুয়াংচৌ শহরের সংস্কৃতি এবং বেতার, টেলিভিশন ওবং পর্যটন ব্যুরোর উপ প্রধান লিউ সিও মিং বলেন, ‘আমরা আশা করি যে, এই ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে, আন্তর্জাতিক ট্রানজিট যাত্রীরা সীমিত সময়ের মধ্যে কুয়াংচৌ সম্পর্কে তাদের বোঝাপড়া বাড়াতে পারবেন এবং যাত্রীদের কুয়াংচৌ জনগণের উষ্ণতা ও আতিথেয়তা অনুভব করতে দেয়।’

ব্রিটিশ ওয়েন্ডি উ ট্র্যাভেল কোম্পানির ইংলিশ ট্যুর লিডার সুন থাও বলেছেন যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, কোম্পানি পর্যটকদের চীনের রীতিনীতি এবং সামাজিক উন্নয়নের অনেক দিক লাভ করার জন্য বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে, উদাহরণস্বরূপ, এই বছর চালু করা হাই-স্পিড রেলের মাধ্যমে চীন ভ্রমণের আশা হচ্ছে যে বিদেশী পর্যটকরা হাই-স্পিড ট্রেনের মাধ্যমে ‘চীনের গতি’ এবং পথের দৃশ্যের অনুভব করতে পারেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, চীনের মোবাইল পেমেন্ট দ্রুত বিকশিত হয়েছে। নগদ এবং ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে অভ্যস্ত অনেক বিদেশী পর্যটকদের জন্য চীনে কীভাবে ‘বাধা-মুক্ত’ খরচ করা যায় তা একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চীনের সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ইন্টারন্যাশনাল এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড কোঅপারেশন ব্যুরোর উপ-পরিচালক শি চে ই বলেছেন যে, বর্তমানে অনেক হোটেলে পিওএস মেশিন আপগ্রেড ও সংস্কার করা হয়েছে এবং ওয়াইল্ড কার্ড পিওএস মেশিনও বিমানবন্দর, দর্শনীয় স্থানগুলো এবং অনেক জায়গার কেনাকাটার স্থানে স্থাপন করা হয়েছে, যাতে বিদেশী পর্যটকদের অর্থ প্রদানে সুবিধা দেওয়া হয়।

কিছু স্বাধীন পর্যটক এবং ট্রাভেল এজেন্সি কর্মীরা জানিয়েছেন যে, দর্শনীয় স্থানগুলোতে টিকিট বুক করা বিদেশী পর্যটকদের জন্য তেমন সুবিধাজনক নয়। একজন বিদেশী পর্যটক সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভ্রমণের ৭ দিন আগে রিজার্ভেশন করতে হবে। আমরা এটি আগে থেকে জানতাম না, তাই আমরা কেবল বাইরে ঘুরে বেড়াতে পারি।’

এই বিষয়ে সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পর্যটন রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের উপ-পরিচালক উ খ্য ফোং বলেছেন যে, বেশিরভাগ দর্শনীয় স্থান পর্যটকদের জন্য অফলাইন টিকিট কেনার পরিষেবা প্রদানের জন্য ম্যানুয়াল টিকিট উইন্ডোগুলো ধরে রেখেছে; দর্শনী স্থানে অনলাইনে বুক করতে ইংরেজি ইন্টারফেস প্রদান করা, স্বীকৃত পরিচয় নথির তালিকায় বিদেশী পাসপোর্টের অন্তর্ভুক্ত করার মতো নানা উদ্যোগ ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

বিদেশী পর্যটকদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হওয়ার সাথে সাথে কিছু হোটেল এবং মনোরম স্পটগুলোতে বিদেশী ভাষার প্রতিভা, বিশেষ করে অপ্রধান ভাষায় প্রতিভার ঘাটতি রয়েছে। এই বিষয়ে, কিছু ট্রাভেল এজেন্সি বিদেশী ভাষার ট্যুর গাইডের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি করছে। অনেক দর্শনী স্থানে বহু ভাষায় সাইনেজ এবং নেভিগেশন সুবিধাজনক স্থাপনা পূর্ণাঙ্গ করে তোলা হচ্ছে।

শিল্পের কিছু লোকও পরামর্শ দেয় যে, পর্যটকদের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বাড়াতে পর্যটন পণ্য এবং পরিষেবার সরবরাহ আরও সমৃদ্ধ করা উচিত।

নর্থওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক লিয়াং শুয়েছেং মনে করেন যে, ভবিষ্যতে, আরও ব্যক্তিগতকৃত এবং পৃথক ভ্রমণ রুট এবং বিক্রয়ের ধারণাগুলো আরও জনপ্রিয় হবে।

অস্ট্রিয়ান ট্র্যাভেল এজেন্ট ওয়াল্টার লডার এলিজাবেথ পরামর্শ দিয়েছেন যে, সিল্ক রোডের ইতিহাস ইউরোপীয় পর্যটকদের কাছে এর নৈকট্য বাড়াতে পর্যটন পণ্যের সাথে একীভূত করা যেতে পারে। ‘ধীরগতির পর্যটন’, ‘বাইসাইকেল পর্যটন’ এবং অন্যান্য পদ্ধতিগুলোও ইউরোপীয় পর্যটকরা পছন্দ করছেন এবং আরও সংশ্লিষ্ট পর্যটন সম্পদও বিকাশ করা যেতে পারে।

সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের শিল্প উন্নয়ন বিভাগের উপ-পরিচালক ফু হ্যানসিও মনে করেন, সারা বিশ্বের মানুষকে স্বজ্ঞাতভাবে চীনের একটি বিশ্বাসযোগ্য, মনোরম এবং সম্মানজনক ভাবমূর্তি অনুভব করাতে পর্যটনের চেয়ে আর ভালো কিছু নেই। গভীর সাংস্কৃতিক পর্যটন অভিজ্ঞতা, পর্যটন পারফর্মিং আর্টস, বরফ এবং তুষার পর্যটন, রাতের সাংস্কৃতিক পর্যটন, রাতের সাংস্কৃতিক পর্যটন এবং শহরের হাঁটাসহ নতুন পর্যটন ফর্ম্যাট উন্নয়নের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ পর্যটন পণ্য ও পরিবেষেবা দিয়ে বিদেশী পর্যটকরা চীনের সুন্দর পাহাড় ও নদী এবং চমত্কার সভ্যতা উপভোগ করার সুযোগ দেওয়া উচিত্ বলে তিনি মনে করেন।

লিলি/হাশিম