আগের এক অনুষ্ঠানে আমরা পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। পিতামাতারা কিভাবে বাচ্চাদের সাথে সহাবস্থান করতে পারেন এবং একটা সুন্দর পরিবেশে বাচ্চাদের বড় করতে পারেন, এ বিষয়টি নিয়ে অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের আলোকে আমরা আলোচনা করেছি। তবে, পারিবারিক শিক্ষা কখনও সহজ বিষয় নয়। একেক পরিবারে একে চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়। এটি কেবল চীনা পিতামাতাদের উদ্বেগের বিষয় নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাবামায়েদের জন্য একটি কমন উদ্বেগের বিষয়।
চীনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছে। এখন চীনের বিভিন্ন এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীর সংখ্যা একটু বেড়েছে। তাদের মধ্যে অনেকে স্কুলে যেতে চায় না এবং পড়াশোনায় আগ্রহ পায় না। ভেবে দেখুন, যদি আপনার বাচ্চা হঠাত্ একদিন বলে যে, সে স্কুলে আর যেতে চায় না, তাহলে বাবা বা মা হিসেবে আপনার কেমন লাগবে? আপনি তখন কী করবেন? আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এ সমস্যার মূল কারণ ও মোকাবিলার পদ্ধতি নিয়ে কিছু আলোচনা করব।
নতুন সেমিস্টারের মাত্র কয়েক সপ্তাহ কেটেছে। এরই মধ্যে কোনো কোনো বাচ্চা স্কুলে না-যাওয়ার বায়না ধরতে শুরু করেছে। স্কুলের প্রতি বাচ্চাদের এহেন অনাগ্রহ যে কোনো পিতামাতার জন্য উদ্বেগের ব্যাপার। তবে, স্কুলে যেতে আনাগ্রহ আর পড়াশোনায় অনাগ্রহ এক কথা নয়।
বাচ্চারা যখন পড়াশোনায় অনাগ্রহী হয়, তখন তারা স্কুলে বা বাসায় পড়াশোনা করতে চায় না। এটা এমন এক সমস্যা, যা সমাধানে অনেকসময় সংশ্লিষ্ট চিকিত্সকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। সময়মতো ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
তবে, গ্রীষ্মকালীন ছুটির পর, বাচ্চাদের পড়াশোনায় প্রাথমিক অনাগ্রহ প্রকাশ করা অনেকক্ষেত্রেই স্বাভাবিক। কারণ, ছুটিকালীন আরামদায় জীবন এবং স্কুলের পড়াশোনার চাপের জীবনে মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে। তাই, কোনো কোনো বাচ্চা আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই স্কুলের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করতে পারে। এতে তেমন উদ্বিগ্ন হবার কোনো কারণ নেই। এটি পড়াশোনায় অনাগ্রহের মতো গুরুতর সমস্যা নয়। এ সময় পিতামাতার উচিত বাচ্চাদের যথাযথ পরামর্শ দেওয়া, গাইড করা। যদি বাবা-মা শুধু যুক্তির আলোকে বাচ্চার এ মানসিকতার বিচার করেন, তবে বাচ্চার ওপর মানসিক চাপ আরও বেড়ে যাবে।
এ সময় বাবা-মার উচিত বাচ্চার জায়গায় নিজেদের রেখে চিন্তা করা। বাচ্চার পড়াশোনার চাপ পছন্দ না। এটা সে পিতামাতার সাথে শেয়ার করতেই পারে। আমরাও কিন্তু নিজেদের কর্মস্থলে কাজের চাপ বেশি হলে, হতাশা প্রকাশ করি। কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথাও বলি। তখন বন্ধুদের উচিত সহমর্মী হওয়া। ঠিক তেমনি, বাচ্চাদের মনোভাবকেও সম্মান করতে হবে, তাদেরকে বোঝাতে হবে; তাদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করতে হবে।
বাচ্চাদের মানসিক অবস্থা বিবেচনা করতে হবে। স্কুল সম্পর্কে তাদের নেতিবাচক মন্তব্য শুনে রাগ করা চলবে না। বরং তাদের সাথে এ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। কেন তার স্কুল পছন্দ না? তার যুক্তি শুনতে হবে। যুক্তি শুনে তা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সাময়িকভাবে তা মেনে নিতে হবে। তারপর, ধীরেসুস্থে বাচ্চাকে বোঝাতে হবে যে, স্কুলের সবকিছু মনের মতো নাও হতে পারে, কিন্তু সবকিছু খারাপ না। স্কুলের ভালো ভালো দিকগুলো বাচ্চার সামনে তুলে ধরতে হবে। স্কুলের যাকিছু বাচ্চার পছন্দ না, সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে। এভাবে বাচ্চার নেতিবাচক মনোভাব অনেকটাই দূর করা সম্ভব। রাগারাগি করলে একসময় দেখা যাবে বাচ্চা আর কোনো কথা শেয়ার করবে না। এটা আরও বিপদের কথা।
স্কুলে যেতে না চাওয়ার সাথে বাচ্চার আবেগ জড়িত থাকতে পারে। বর্তমানে প্রাথমিক স্কুল থেকে উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত ভিন্ন বয়সের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এ সমস্যা দেখা যাচ্ছে। সাধারণত, যখন তাদের মেজাজগত সমস্যা থাকে, তখন তার নেতিবাচক প্রভাব তাদের শরীরেও পরে। এ সম্পর্কে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ হাসপাতালের মনোরোগবিদ্যার বিশেষজ্ঞ ডক্টর ইউয়ান চুন লিয়াং বলেন, স্কুলে যেতে না-চাওয়া বাচ্চাদের কয়েক ধরনের মানসিক সমস্যা থাকতে পারে:
১. আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানবোধে দুর্বলতা। এ ধরনের শিক্ষার্থীদের অনেকে নিজেদের পছন্দের স্কুলে ভর্তি হতে পারে না। তখন তাদের পরীক্ষার ফলাফল আরও খারাপ হয়।
২. অতিরিক্ত মানসিক চাপ। স্কুলের পড়াশোনা শেষে, নতুন মাধ্যমিক স্কুল বা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির আগে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা দিতে হয়। তখন শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ থাকে। সেই সময় অনেক ছাত্রছাত্রী পরীক্ষার কারণে উদ্বিগ্ন থাকে। তখন তাদের মধ্যে বিষন্নতা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাদের মানসিক অবস্থার দ্রুত উন্নতি প্রয়োজন হবে। তা নাহলে, তাদের পড়াশোনায় আগ্রহ দ্রুত হ্রাস পেতে পারে।
৩. মেজাজ নিয়ন্ত্রণে দক্ষতার অভাব। অনেক বাচ্চা যখন চ্যালেঞ্জ বা সমস্যার সম্মুখীন হয়, তখন নিজের নেতিবাচক মেজাজ সমন্বয় করতে পারে না। নিজের বা অন্যের প্রতি রাগ বা অসন্তোষ প্রকাশ করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
৪. সামাজিক যোগাযোগে ভীতি। এমন বাচ্চারা সাধারণত অন্যদের সাথে কথা বলতে বা যোগাযোগ করতে চায় না। তাঁরা একাই থাকতে বেশ পছন্দ করে। তবে, দীর্ঘকাল ধরে নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায়।
৫. পারিবারিক পরিবেশ। পারিবারিক শিক্ষা এবং পিতামাতার সাথে সম্পর্ক ও কথা বলার পদ্ধতি বাচ্চাদের মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে। যখন পারিবারিক সম্পর্ক বেশ উত্তেজনাময় হয়ে ওঠে এবং বাচ্চারা পিতামাতার কাছ থেকে সমর্থন পায় না, তখন তাদের মানসিক সমস্যা অন্য বাচ্চাদের চেয়ে আরও সহজে প্রকট হতে পারে।
বাচ্চার মানসিক সমস্যা দেখা দিলে, যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে চিকিত্সা গ্রহণ করা ভালো। কারণ, মানসিক সমস্যার সাথে শরীরের অসুস্থতার পার্থক্য রয়েছে। এ অসুস্থতা স্রেফ ওষুধ খেলে ভালো হয় না। এক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে চলা জরুরি।
বাচ্চাদের জন্য আশেপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, পিতামাতার সাথে সুসম্পর্ক, পুষ্টিকর খাবার, যথেষ্ঠ ঘুম, যথাযথ খেলাধুলা এবং স্বাস্থ্যকর সামাজিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক উন্নয়ন ও মানসিক চাপ কমানোর ক্ষেত্রে এই ফ্যাক্টরগুলো বড় ভূমিকা রাখে। তবে, একেক পরিবারে সহাবস্থানের পদ্ধতি ভিন্ন এবং বাচ্চাদের চরিত্রেরও মধ্যেও ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তাই, বাবা-মার উচিত সবসময় বাচ্চার শরীরের স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থার ওপর নজর রাখা।
কোনো কোনো বাচ্চা মনে করে, তাদের পড়াশোনার দক্ষতা দুর্বল। তাঁরা স্কুলে শিক্ষকদের কাছ থেকে কোনো প্রশংসার কথা শোনে না। তখন বাবা-মার উচিত বাচ্চাকে সাহস দেওয়া এবং তাঁরা যে আসলে লেখাপড়ায় অনেক ভালো, তা বোঝানো। কী করলে শিক্ষক প্রশংসা করবেন, তা নিয়েও বাচ্চার সাথে খোলামেলা আলোচনা করা যেতে পারে।
কোনো কোনো বাচ্চা অনেক পরিশ্রম করে পড়াশোনা করে। তাঁরা সবসময় রাত ১২টা পর্যন্ত স্কুলের হোমওয়ার্ক করে। তবে, তাদের পরীক্ষার ফলাফল অতো ভালো নয়। সেক্ষেত্রে বাবা-মা বিভ্রান্ত হতে পারেন এবং বাচ্চার ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে পারেন। পিতামাতার উচিত এসময় নিজেদের জ্ঞানবুদ্ধি প্রয়োগ করা এবং সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করা এবং বাচ্চার সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করা। বাচ্চাকে গাইড করা ও পরামর্শ দেওয়া পিতামাতার কাজ।
বাচ্চার আত্মবিশ্বাস কীভাবে বাড়ানো যায়, সেদিকে পিতামাতা খেয়াল রাখতে পারেন। এমন ছোটখাটো সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের বলা যেতে পারে, যা বাচ্চা সহজে সমাধান করতে পারবে। তখন পিতামাতা তার প্রশংসা করবেন। এভাবে ধীরে ধীরে বাচ্চা বড় সমস্যা সমাধানের যোগ্যতাও অর্জন করবে।
পড়াশোনার তাত্পর্য কী? কেন পড়াশোনা করতে হবে? বাচ্চারা সহজে এ ধরনের প্রশ্ন করে থাকে। তখন বাবা-মার উচিত রেগে না যাওয়া এবং বাচ্চাদের সাথে এ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা। আলোচনার মাধ্যমে বাচ্চার জন্য একটি জীবনলক্ষ্য ঠিক করে দিতে পারেন পিতামাতা। জীবনলক্ষ্য ঠিক করার পর তাকে বলতে হবে, এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাকে কী কী করতে হবে। তখন আশা করা যায়, বাচ্চা পড়াশোনায় আরও বেশি আগ্রহী হবে।
লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করার পর বাচ্চার অবস্থা ও প্রাধান্য বিবেচনা করে, পরিকল্পনার কাঠামো নির্ধারণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। যখন স্বল্পকালীন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করার প্রশ্ন আসে, তখন বাচ্চাদের বেশি উত্সাহ দেখা যায়। এভাবে স্বল্পকালীন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে করতে তাঁরা দীর্ঘকালীন লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারেও আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।
বাচ্চাদের ছোটবেলায় সময়মতো উত্সাহ দেওয়া এক খুব কার্যকর পদ্ধতি। যদি বাবা-মা ভালো করে বাচ্চাদের প্রশংসা বা উত্সাহ দিতে পারেন, তাহলে বাচ্চাদের সুপ্তসম্ভাবনার বিকাশ ঘটতে পারে সহজে।
এমন কিছু বাচ্চা আছে যারা পড়াশোনার খানিকটা দুর্বল। তাঁরা অন্যদের মতো পরীক্ষায় ভালো স্কোর করতে পারে না এবং মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করলেও, সাধারণ বাচ্চাদের গড় বুদ্ধির চাইতে কম বুদ্ধির পরিচয় দেয়। এ সময় বাবা-মাকে খুঁজতে হবে এর মূল কারণ। তাদের পড়াশোনার পদ্ধতি দুর্বল, নাকি লেখাপড়ায় আগ্রহ কম? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করে বাচ্চাকে যথাযথভাবে গাইড করতে হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সবসময় পড়াশোনার কথা বললে বাচ্চাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বাচ্চারা খেলাধুলা পছন্দ করে; নতুন নতুন জিনিস শিখতে চায়। নতুন কিছু দেখলে তাঁরা সেদিকে আকৃষ্ট হয়। পিতামাতা বা শিক্ষকের উচিত নয় বাচ্চাদের এ ব্যাপারে অনুত্সাহিত করা এবং সবসময় লেখাপড়ার কথা বলা। পড়াশোনার বাইরের অ্যাক্টিভিটিকেও উত্সাহিত করতে হবে। তখন, বাচ্চা লেখাপড়ার প্রতিও আকৃষ্ট হবে।
(সুবর্ণা/আলিম/রুবি)