‘সর্বোত্তমকে নির্বাচন করা এবং সবচেয়ে যোগ্যদের নিয়োগ করার’ রাজনৈতিক ঐতিহ্য হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে চীন। এটি এখনও চীনের ক্যাডার নির্বাচন এবং নিয়োগ পদ্ধতির মূল ধারণা।
তেং শিয়াও পিং যেমন ১৯৭৮ সালে প্রস্তাব করেছিলেন, চীনকে অবশ্যই তার উন্মুক্তকরণ নীতির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হবে, দেশের ব্যাপক আধুনিকীকরণ লক্ষ্যগুলো নির্ধারিত মানে অর্জন নিশ্চিত করতে হবে এবং দেশের দীর্ঘমেয়াদী শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। সাংগঠনিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই কৌশলগত লক্ষ্যগুলোর দৃশ্যমানতা নিশ্চিত করার জন্য, একটি যোগ্যতা-ভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রয়োজন। ‘সঠিক রাজনৈতিক লাইন অবশ্যই সঠিক সাংগঠনিক লাইন দ্বারা নিশ্চিত করা উচিত। চীনের বিষয়গুলো সমাধান করা যেতে পারে কিনা, সমাজতন্ত্র এবং সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ অব্যাহত রাখা যায় কিনা, অর্থনীতি দ্রুত করা যায় কিনা, অর্থনীতি দ্রুত বিকশিত করতে পারে কিনা, একটি নির্দিষ্ট অর্থে মানুষ নিয়োগের উপরে নিহিত রয়েছে।’ চীন সর্বদা অভিজাত দেশের ঐতিহ্য অনুসরণ করেছে এবং এর সারমর্ম হল অভিজাতদের সংগঠিত অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান ও ন্যায়সঙ্গত সরকারের ইচ্ছাকে অপেক্ষাকৃত তেমন যুক্তিসঙ্গত নয় মানুষের দ্বারা বাস্তবায়ন করা এবং সম্মিলিত সাধারণ মূল্য অর্জন করা। পশ্চিমা নির্বাচনী ব্যবস্থার সুবিধা হল অতি ব্যক্তিত্বের সম্ভাবনাকে উন্মোচন করা, কিন্তু মূর্খ লোকেরা সমাজের সামগ্রিক স্বার্থে যে ক্ষতি করতে পারে তা সীমিত করতে পারে না।
এই মতাদর্শের অধীনে, সমসাময়িক চীন একটি সাংগঠনিক এবং কর্মী ব্যবস্থা গ্রহণের উপর জোর দেয়, যা কর্মকর্তাদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘নির্বাচন’ এবং ‘ভোট’ প্রক্রিয়াকে একত্রিত করে। যার মাধ্যমে অসামান্য নেতা নির্বাচন করার চেষ্টা করা হয়। চীনে ক্যাডার পদোন্নতি সাংগঠনিক বিভাগের একীভূত নেতৃত্বে এবং প্রাথমিক মূল্যায়ন, পর্যালোচনা, পোল, মূল্যায়ন, ভোট, জনসাধারণের মতামত সংগ্রহ এবং অন্যান্য পদ্ধতিসহ কঠোর মূল্যায়নের একটি ধারাবাহিক ব্যবস্থার মাধ্যমে তা করা হয়।
এ ছাড়াও, এই সাংগঠনিক কর্মী ব্যবস্থায় সিনিয়র ক্যাডারদের পদোন্নতির আগে দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যাপক তৃণমূল প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। শুধুমাত্র বিভিন্ন পদে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করার পরেই তারা মূল নেতৃত্বের পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন। কর্মজীবনের দৃষ্টিকোণ থেকে, একজন চীনা ক্যাডার যদি সিনিয়র লেভেলে উন্নীত হতে চান, তাহলে তাকে সাধারণত ২০ থেকে ৩০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, চীনের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক ব্যুরোর স্থায়ী কমিটির প্রায় সকল প্রার্থীই দুই মেয়াদে প্রাদেশিক পার্টির সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেছেন বা সংশ্লিষ্ট কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে উদাহরণ হিসেবে ধরুন। তিনি লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের কর্মী হিসেবে শুরু করেছিলেন এবং ৩০ বছর ধরে ধাপে ধাপে তার বর্তমান অবস্থান পর্যন্ত কাজ করেছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক ব্যুরোতে প্রবেশের আগে, তিনি হ্যপেই প্রদেশের জেংদিং জেলায় পার্টি সেক্রেটারি এবং পরে ফুচিয়ান প্রদেশের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তারপর তিনি চেচিয়াং প্রদেশের পার্টি কমিটির সেক্রেটারি এবং সাংহাই পৌর সরকারের পার্টি কমিটির সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই অঞ্চলগুলোর অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং রীতিনীতিগুলো সব ভিন্ন এবং তাদের শাসনের অগ্রাধিকার ও চ্যালেঞ্জগুলোও আলাদা। জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে, সি চিন পিং সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক ব্যুরোর স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়ার আগে, তিনি যে অঞ্চলগুলোতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তার ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ১৫কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছিল এবং মোট জিডিপি ১.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে এটি ভারতের চেয়েও বেশি। এরপর জাতীয় নেতা হিসেবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নেতৃত্বের কাজের সাথে পরিচিত হতে আরও পাঁচ বছর সময় লেগেছে তার।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ‘নির্বাচন + ভোট’ কর্মসংস্থান মডেল ‘ভোটের উপর ভিত্তি করে নয়, অঞ্চলের উপর ভিত্তি করে নয়, বয়সের উপর ভিত্তি করে নয়।’ এটি একটি দক্ষতা ও যোগ্যতা ভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা। এই মেধাভিত্তিক পদ্ধতি পশ্চিমা নির্বাচনী গণতন্ত্রের অধীনে ব্যালট পদ্ধতির বিপরীত। উদাহরণস্বরূপ, ট্রাম্প, যিনি ২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন, তিনি একজন রাজনৈতিক অপেশাদার এবং তার বিজয়ের পরে নিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সরকারের প্রকৃত দুই নম্বর ব্যক্তি, টিলারসনও একজন ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্ব। কখনো সরকারি পদে অধিষ্ঠিত হননি এবং কোনো কূটনৈতিক অভিজ্ঞতাও নেই। ফ্রান্সে, ম্যাক্রোঁ, যিনি ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হন, তার দল, প্রজাতন্ত্র মার্চ, নির্বাচনের শুধুমাত্র এক বছর আগে গঠিত ছিল এবং শাসন করার পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। তিনি নিজে কখনো কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি এবং মাত্র দুই বছরের বেশি সময় ধরে অর্থনৈতিক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ম্যাক্রোঁ নির্বাচিত হওয়ার পর গঠিত ২২ জনের মন্ত্রিসভায়, ১৮ জন ব্যক্তি রয়েছেন যারা প্রথমবারের মতো মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। যাদের মধ্যে ৯ জন সামাজিক ব্যক্তিত্ব, যার মধ্যে রয়েছে বেসরকারি পরিবেশবাদী, সাংবাদিক, অলিম্পিক ফেন্সিং চ্যাম্পিয়ন, ডাক্তার ইত্যাদি। চীনে, এমনকি একটি প্রদেশ পরিচালনার জন্য খুব উচ্চ প্রতিভা এবং ক্ষমতার প্রয়োজন, কারণ চীনের একটি প্রদেশের গড় আকার প্রায় চার বা পাঁচটি ইউরোপীয় দেশের আকারের সমান। এটা কল্পনা করা কঠিন যে চীনের মেধাভিত্তিক এবং তীব্র প্রতিযোগিতার প্রচারের মডেলের অধীনে, ইউরোপীয় এবং আমেরিকান দেশগুলোর দ্বারা নির্বাচিত অভিনেতা এবং ব্যবসায়ী-নেতারা দেশের শীর্ষ ব্যবস্থাপনায় প্রবেশ করতে পারে। কারণ এটি শাসনের জন্য প্রয়োজনীয় পেশাদারিত্ব, দায়িত্ব এবং যৌক্তিকতার নীতিগুলি থেকে গুরুতরভাবে বিচ্যুত হয়।
(স্বর্ণা/হাশিম/লিলি)