এবারের পর্বে রয়েছে:
১. মিয়াও নারীর সূচশিল্প: টিনের সুতোয় ঝলমলে পোশাক
২. কবিতায় চীনা ভাষা শেখান লি পোলিন
৩. পুঁতিতে গাঁথা জীবনের কাব্য
নারী ও শিশু বিষয়ক অনুষ্ঠান আকাশ ছুঁতে চাই থেকে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আমাদের এ পর্বের অনুষ্ঠানে রয়েছে মিয়াও নারীদের সূচিশিল্প নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন। আরও রয়েছে কবিতার মাধ্যমে শিশুদের আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলার এক অসাধারণ গল্প। সেইসঙ্গে আছে পুঁতিবুনন শিল্পের একজন নারী ইনহেরিটরের কথা। চলুন শোনা যাক পুরো অনুষ্ঠান।
মিয়াও নারীর সূচিশিল্প: টিনের সুতোয় ঝলমলে পোশাক
টিন দিয়ে সূচিশিল্প শুনলে অবাক হতে হয়। কিন্তু এই অবাককরা কাজটি আবহমান কাল থেকে করে চলেছেন মিয়াও নারী।
ধাতব বস্তু দিয়েও যে চাইলে সূচিশিল্পের কাজ করা যায় অনায়াসে সেটাই প্রমাণ করেছে কুইচৌ প্রদেশের মিয়াও জাতিগোষ্ঠীর নারীরা। পাতলা ও সরু টিনকে সুতা হিসেবে ব্যবহার করে এখানকার নারীরা যুগের পর যুগ বানিয়ে চলেছে দারুণ সব পোশাক ও অলংকার। এর আবেদন এত বেশি যে ২০০৬ সালেই জাতীয় পর্যায়ের বৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নেয় এই টিনের সূচিশিল্প।
এবারের গ্রীষ্মের প্রতিটি ছুটির দিনেই কুইচৌ প্রদেশের ছিয়ানতোংনান মিয়াও ও তোং স্বায়ত্তশাসিত প্রিফেকচারের মিয়াও অ্যান্ড তোং এথনিক কালচারাল পার্কে অনুষ্ঠিত হচ্ছে অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রদর্শনী। এখানে মিয়াও সূচিশিল্পে পোশাকগুলো ফুটিয়ে তুলেছে এখানকার স্থানীয় নারীদের নিখুঁত হাতের কাজের নমুনা। তবে চিয়ানহ্য কাউন্টি থেকে আসা টিনের সূচিশিল্পের পোশাক ছিল সবার আকর্ষণের কেন্দ্রে। এখানে আসা এক ক্রেতা জানালেন, ‘এই পোশাকগুলোকে বলে টিন এমব্রয়ডারি। এগুলো অন্য সূচিশিল্পের চেয়ে আলাদা। যখন চোখের সামনে এগুলো দেখবেন, এগুলো ঝলমল করে এক ধরনের ভিজুয়াল ইফেক্ট তৈরি করবে।’
এখন চীনের শুধু চিয়ানহ্য ও ছিয়ানতোংমিয়াওতেই পাওয়া যাবে নারীদের হাতে বোনা টিন এমব্রয়ডারির কাজ। এটি তৈরির প্রক্রিয়া বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ। সূতার বুনন থেকে কাপড় বানানো, তাতে সূচের কারুকাজে ফুলের নকশা ফুটিয়ে তোলা ও টিনের ব্যবহার; একেকটি পোশাক তৈরিতে কয়েক বছরও লেগে যায়।
কুইচৌ মিনচু ইউনিভার্সিটির চারুকলা বিভাগের শিক্ষক চাং চিং জানালেন, কুইচৌ মিনচু ‘টিন এমব্রয়ডারির কাজে সাধারণত গাঢ় নীল রঙের কাপড়ে নীল রংয়ের সুতা ব্যবহার করা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় রূপালি রঙের ধাতব সুতা। এতে রঙের বৈপরীত্য ফুটে ওঠে ভালো।
শৈশব থেকে টিন এমব্রয়ডারি নিয়ে পড়ে আছেন ওয়াং হেংশি। ৪৪ বছর বয়সী এ নারী ৭ বছর থাকতেই হাতেকলমে টিন এমব্রয়ডারি শেখা শুরু করেন। টিনের সুতার কারুকাজ করার আগে তাকে বেশ সময় নিয়ে কাপড়টাও তৈরি করতে হয়।
ওয়াং হেংশি জানালেন, টিনের সূচিকর্মের একটি টুকরো তৈরিতে হাজার হাজার টিনের স্ট্রিপ লাগে। মিলিমিটার আকারের প্রতিটি পাতলা সুতা সাবধানে কাটা হয়। শিল্পীর ধৈর্য ও মনযোগের পরীক্ষা হয়ে যায় এ কাজে। প্রক্রিয়াটি টানা কয়েক মাস চলতে পারে।
তিনি আরও জানালেন, ‘তিনটি পাতলা সুতার গুচ্ছকে একটি সুতা হিসেবে ধরতে হয়। কিছু কাজে আবার পাতলা ও সরু একটি টুকরো মানেই একট সুতা। সুতাগুলোকে ক্রস করলেই টিনের এমব্রয়ডারির প্যাটার্ন তৈরি হয়। এক্ষেত্রে যদি থ্রেডগুলো গুনতে ভুল করেন, তবে নকশাতেও ভুল হবে।’
এ ধরনের টিন এমব্রয়ডারিতে সাধারণত জ্যামিতিক বিন্যাসকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। মূল রংটা টিনের চকচকে রূপালি হলেও সঙ্গে কালো, নীল, লাল ও সবুজকেও প্রাধান্য দেওয়া হয়।
বেশ কয়েক বছর ধরেই মিয়াওদের এই টিন সূচিশিল্পের প্রদর্শনী হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। বাইরের অনেক ফ্যাশন প্রতিষ্ঠানও এখন এই এমব্রয়ডারির অর্ডার পাঠাচ্ছে চিয়ানহ্যর কারিগরদের কাছে।
প্রতিবেদন: ফয়সল আবদুল্লাহ
সম্পাদনা: শান্তা মারিয়া
কবিতায় চীনা ভাষা শেখান লি পোলিন
কবিতার মাধ্যমে চীনা ভাষা শেখান লি পোলিন। হুনান প্রদেশের একটি স্কুলে ১৩০০ শিক্ষার্থীকে কবিতার মাধ্যমে মনের জোর বাড়িয়েছেন নারী এই শিক্ষক। দিনে দিনে তারকা শিক্ষকে পরিণত হয়েছেন তিনি। বিস্তারিত প্রতিবেদনে।
২৮ বছর বয়সী লি পোলিন। গেল সাত বছর ধরে হুনান প্রদেশের গভীর অরণ্যে সুয়ু হোপ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন এই নারী। এই প্রদেশেই অবস্থিত সুয়ু হোপ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৩০০ শিক্ষার্থীকে চীনা ভাষা শেখান তিনি।
যাদের বাবা মা অধিক আয়ের জন্য অন্য প্রদেশে কাজ করেন তাদের বেশিরভাগ সন্তানই পড়ে এই স্কুলে। আর এই শিশুদের কবিতার মাধ্যমে চীনা ভাষা শেখান লি। নিজেরদের আবেগ অনুভূতির প্রকাশ করতে পারে এই কবিতার মাধ্যমে। কবিতার শক্তিতে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে তারা। ধীরে ধীরে নিজেদের জীবনেও পরিবর্তন আনতে শুরু করে শিশুরা।
শুরুতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন লি। বড় শিক্ষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ থাকলেও ফিরে আসেন গ্রামের স্কুলে। শুরু করেন নিজের পছন্দের পেশায় কাজ করা।
লি বলেন, "প্রথমবার যখন আমি এখানে একটি ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম এবং দেখেছিলাম যে বাচ্চারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমার কথা এত মনোযোগ দিয়ে শুনছে, আমি বুঝতে পেরেছি যে গ্রামীণ শিশুদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
লি’র ক্লাস করে কবিতার মাধ্যমে মনের অনুভূতি প্রকাশ করতে পেরে খুশি শিশুরাও। এক শিশু বলে,
"আমি বাবা-মায়ের পথ অনুসরণ করি। তারা যখন বাড়িতে থাকে না, আমি বাধ্য হয়ে গ্রামের প্রতিটি পথে তখন হাঁটি," ।
সাহিত্যের অনুপ্রেরণামূলক শক্তিকে কাজে লাগাতে শিশুদের নিয়ে একটি সংগঠন করেন লি। গেল ছয় বছরে এই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের হাজারেরও বেশি কবিতার বই উপহার দিয়েছেন।
লি শিশুদের কবিতার জ্ঞান শুধু ক্লাসরুমেই দেন না, মাঠেও নিয়ে যান প্রকৃতিকে অনুধাবন করতে। এক শিশু বলে, "সূর্যের পায়ে হেঁটে, আমি পুড়ে যাচ্ছি। চাঁদের পদে পদে হেঁটে আমি একাকী,"
লি বিশ্বাস করেন কবিতা লেখা শিশুদের মনের জোরও বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি তারা বুঝতে পারে তাদের গুরুত্ব সম্পর্কে । অনুধাবন করতে পারে নিজেদের অবস্থান।
লি বলেন, "কবিতা লেখা আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। একটি শিশু একবার আমাকে বলেছিল সে যদি কবিতা লিখতে পারে,তার মানে সে অন্য কাজও করেতে পারে। আমি দেখি তারা নিজেদেরকে ছাড়িয়ে যায়। একসময় যা অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল তা এখন অনেক সহজ’।
নিজের কবিতা লেখার এবং আবৃতি করার দক্ষতা শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই এ যেন কঠিন সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন লি।
প্রতিবেদন: আফরিন মিম
সম্পাদনা: শান্তা মারিয়া
পুঁতিতে গাঁথা জীবনের কাব্য
পুঁতির মালা গাঁথার রীতি বিশ্বের সব দেশেই রয়েছে।তবে একেক দেশের পুঁতিশিল্প একেক রকম। চীনের হ্যনান প্রদেশের লুওইয়াং সিটি বিভিন্ন রকম কারুশিল্পের জন্য বিখ্যাত। এর অন্যতম হলো পুঁতি বুনন। এই কারুশিল্পের একজন ইনহেরিটর হলেন ছু ম্যংতান। শুনবো তার কথা
লু্ওইয়াং সিটির বিশেষ কারুশিল্প পুঁতি বুননের একজন ইনহেরিটর নারী ছু ম্যংতান। তিনি চার প্রজন্ম ধরে এই শিল্পের ধারা বহন করছেন।
এই গুণী নারী পুঁতি দিয়ে অলংকার, পোশাক, ব্যাগসহ বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করেন।
ছু বলেন, এর জন্য শুধু কারুশিল্পে দক্ষতাই নয় একজোড়া তীক্ষ্ম চোখ এবং অভিজ্ঞ হাতের দরকার। চুলের মতো সরু সূতা দিয়ে চালের দানার চেয়েও ছোট পুতি গাঁথতে হয়।
সিল্কের উপর পুঁতি দিয়ে নকশাও করেন তিনি। এটি অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় রয়েছে। পরবর্তি প্রজন্মের কাছে এই শিল্পকে পৌছে দিতে ছু নিয়মিত প্রশিক্ষণ ক্লাস নেন। লাইভ স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমেও এই কারুশিল্পের প্রশিক্ষণ দেন তিনি।
প্রতিবেদন: শান্তা মারিয়া
সম্পাদনা: মিম
সুপ্রিয় শ্রোতা। আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছি আমরা। সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আবার কথা হবে আগামি সপ্তাহে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। চাই চিয়েন।
সার্বিক সম্পাদনা : ইয়ু কুয়াং ইউয়ে আনন্দী
লেখা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: শান্তা মারিয়া
অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ