চীনের বিভিন্ন এলাকার শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের গল্প
2024-09-23 15:30:43

বেইজিং ওপেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চাং লিন লিনের গল্প

শিক্ষক চাং লিন লিন টানা ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষকতার কাজ করছেন। তিনি যখন পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন, তখন থেকেই প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষা-কার্যক্রমে যোগ দেন। শিক্ষার্থীদের চাহিদাকে কেন্দ্র করে, পড়াশোনার পদ্ধতি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করা তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল।

বেইজিং ওপেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে, প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রছাত্রীদের চাকরি ও পড়াশোনার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার এবং শিক্ষার্থীদের অল্প সময়ে বেশি শেখানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন চাং লিন লিন। প্রাপ্তবয়ষ্ক শিক্ষার্থীদের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে, শিক্ষক চাং এবং তাঁর সহকর্মীরা ‘বেইজিং ওপেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদানের বহুমুখী সংস্কার প্রস্তাব’ রচনা করেন, যা শিক্ষার্থীদর পড়াশোনার বিষয়, পদ্ধতি, শিক্ষকের দায়িত্ব ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীরা নিজে নিজে পড়াশোনা করতে পারেন। তা ছাড়া, তাদের আগের শিক্ষাও একটা প্লাস পয়েন্ট। শিক্ষক চাং তাদের অর্জিত আগের পড়াশোনা বা জ্ঞানকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করেন। এ ব্যবস্থায় বয়স্ক শিক্ষার্থীদের জানা বিষয়গুলো দ্বিতীয়বার আর পড়ানো হয় না। তাদের কর্ম-অভিজ্ঞতা ও সাফল্যকে সংশ্লিষ্ট ক্লাসে অর্জিত স্কোর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এভাবে, শিক্ষার্থীদের সময় সাশ্রয় হয়। তারা শুধু তাদের কাছে অজানা বিষয়ের ক্লাসে যোগ দেন। সংশ্লিষ্ট শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে শিক্ষক চাং ‘কর্ম-অভিজ্ঞতা স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থায় একাডেমিক শিক্ষা এবং নন-একাডেমিক শিক্ষা সংযুক্ত করার উদ্ভাবনী অনুশীলন’ শীর্ষক বই রচনা করেছেন। তাঁর সংশ্লিষ্ট গবেষণার বিষয় ২০১৮ সালে বেইজিং কারিগরি শিক্ষা খাতের বিশেষ পুরস্কার লাভ করে।

প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের মান নিশ্চিত করতে তিনি পেশাদার শিক্ষক ও অস্থায়ী শিক্ষকদের বিশেষ প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। শিক্ষকদের মধ্যে কাজ ভাগাভাগি করার ব্যবস্থাও তিনি চালু করেন। এ ব্যবস্থায় শিক্ষকরা ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। যেমন, কেউ ক্লাসে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেন, কেউ শুধু ক্লাসে সহায়ক পরামর্শ দেন। তা ছাড়া, কাজের চাপে যারা পড়াশোনায় তেমন একটা সময় দিতে পারেন না, এমন প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীকে বিশেষ সহায়তা দেন শিক্ষকরা। পরীক্ষায় ব্যর্থতার আশঙ্কা দেখা দিলে, সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীকে আগেই সতর্ক করা হয় এবং তার প্রতি বিশেষ নজর রাখা হয়।

যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজে অনেক সময় দিতে হয়, তবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাদানের কাজে কখনও শিথিলতা প্রদর্শন করেন না শিক্ষক চাং। যখন প্রশাসনিক কাজ করেন, তিনি নিজের কর্মঅভিজ্ঞতা যুব শিক্ষক ও প্রশাসনিক বিভাগের কর্মীদের সাথে বিনিময় করেন। যখন শিক্ষকতার কাজ করেন, তিনি আইন ক্ষেত্রের সংশ্লিষ্ট কোর্স ও ক্লাস উন্নয়নে চেষ্টা করেন। ‘প্রমাণ আইন’ কোর্সের ক্লাস সম্পর্কে তিনি যুব-শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেন এবং তাদেরকে ক্লাস নেওয়ার কার্যকর পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। তার টানা ২০ বছরের প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজ ও শিক্ষাদানের মান অনেক উন্নত হয়েছে।

 

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষক অধ্যাপক লি ছুয়ান মিং

চীনের নর্থ টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণাগারের প্রধান লি ছুয়ান মিং দীর্ঘকাল ধরে খনিজ পাহাড় নিরাপত্তা আর খনিশিল্পে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি ও নিরাপত্তাব্যবস্থা উন্নয়ন নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁর দৃষ্টিতে, উত্পাদনলাইনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনুশীলন ও গবেষণা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের গবেষণায় তিনি জাতীয় পর্যায়ে অনেক পুরস্কার ও পেটেন্ট লাভ করেছেন।

বহু বছর ধরে খনিতে জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পর্যবেক্ষণ এবং প্রাথমিক সতর্কতা ও ভূগর্ভস্থ ঝুঁকি প্রতিরোধক-ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করছেন লি। তাঁর গবেষণার ফলাফল চীনের বিভিন্ন এলাকার খনিতে নিরাপদ উত্পাদনে কার্যকর ভুমিকা পালন করছে।

তাঁর দৃষ্টিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণাগারের প্রধান হিসেবে সবসময় গম্ভীর মনোভাব নিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কাজ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচিত শুধু পাঠ্যপুস্তকের বিষয় শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি, বাস্তব গবেষণা ও শিল্পচাহিদা বিবেচনা করে সবসময় পড়াশোনায় নতুন জ্ঞান যুক্ত করা। ঐতিহ্যিক শিল্পের উন্নয়ন, নবোদিত শিল্পের সম্প্রসারণ এবং ভবিষ্যতে প্রশিক্ষণ কাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও চাহিদা সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার টপিক হিসেবে বিবেচনা করা উচিত, যাতে বাস্তব চাহিদায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণার কাজ করা সম্ভব হয়।

তিনি কেবল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের গবেষণায় শীর্ষস্থানে দাঁড়িয়েছে তা নয়, বরং শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী চেতনা ও অনুশীলনে উত্সাহ দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্লাসের বাইরে যান এবং বিভিন্ন সামাজিক অনুশীলন কাজে অংশ নেন।

শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী চেতনা সৃষ্টিতে তিনি সবসময় ক্লাসে আন্তর্জাতিক গবেষণার সর্বশেষ খবর তুলে ধরেন এবং বাস্তব গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করেন। তিনি মনে করেন, যুব বিজ্ঞানীদের যত দ্রুত সম্ভব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় অংশ নেওয়া উচিত। বর্তমানে এআই প্রযুক্তি, বিগ ডেটা, নতুন কাঁচামালসহ বিভিন্ন খাতে এবং নতুন মানের উত্পাদনশক্তির উন্নয়নে যুববিজ্ঞানীদের ভূমিকা দরকার। তাঁর শিক্ষার্থীরা শহর নিরাপত্তা প্রযুক্তি ও শহর অবকাঠামো ব্যবস্থাপনার রূপান্তর ও নবায়নের নিরাপত্তা প্রশাসন প্রযুক্তির গবেষণা নিয়ে কাজ করে।

লি সবসময় বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞানের উত্তরাধিকারী ও সৃষ্টিকারী; তারা যুব শিক্ষার্থীদের চরিত্র ও উদ্ভাবনী চেতনায় নির্দেশনা ও সহায়তা দেন। তাই শিক্ষার্থীদের সাথে বিভিন্ন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা এবং তাদের গবেষণার আদর্শ স্থাপনে উত্সাহ দেওয়া লি’র প্রধান কাজ।

 

উদ্যানবিদ্যার শিক্ষক লিউ ইয়ানের গল্প

চীনের বন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যান একাডেমির ফুল গবেষণাগারের পরিচালক লিউ ইয়ান টানা ৪০ বছর ধরে শিক্ষকতার কাজ করছেন। তিনি না-দেখেই অফিসভবনের দরজা, বাতি খুলে দিতে পারেন এবং উদ্যান বিষয়ে পড়াশোনার গল্প আমাদের সাথে শেয়ার করেন।

১৯৮০ সালে ১৭ বছর বয়সের শিক্ষার্থী লিউ ইয়ান বেইজিং বন একাডেমিতে (পরে বেইজিং বন বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন এবং তখন থেকে উদ্যান বিভাগে পড়াশোনা শুরু করেন। এ উদ্যান বিভাগ তাঁর জন্য অপরিচিত বিষয় ছিল। তবে, অপরিচিত হলেও, বেশ আকর্ষণীয়ও ছিল। দিনের বেলায় তিনি উদ্যান কারখানায় থাকতেন এবং রাতে স্কুলে ফিরে সংশ্লিষ্ট ডিজাইনের ছবি আঁকতেন। এমন কাজ শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কষ্টকর। তবে, যদি কেউ ভালো করে এ কাজ করতে চান, তাহলে অবশ্যই অন্যদের চেয়ে আরও বেশি পরিশ্রম করতে হবে।

শিক্ষক লিউ’র জন্য একটি উত্সাহব্যঞ্জক ব্যাপার হচ্ছে, তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অনেকে পরিশ্রম করে মনোযোগ দিয়ে উদ্যান গবেষণার কাজে অংশ নেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, মাস্টার্সে তাঁর শিক্ষক ওয়াং লিয়ান ইং ছাত্রী লিউ ইয়ানকে নিয়ে শানতুং প্রদেশে ফিল্ড জরিপ করতে যান। তখন তাঁরা খেয়াল করেন যে, কৃষিক্ষেতে গ্রামবাসীদের চাষকৃত পিওনি ফুল মাত্র ২০ দিনে শুকিয়ে যায়। তখন, লিউ ইয়ান মনে মনে ভাবলেন, কেন পিওনি ফুল বেশিদিন তাজা রাখা যাবে না? এমনটা করা গেলে, গ্রামবাসীরা ফুল চাষ থেকে আরও বেশি টাকা উপার্জন করতে পারবেন।

টানা ৩০ বছর ধরে পিওনি ফুল নিয়ে গবেষণা করেন শিক্ষক লিউ এবং পিওনির ধরণ, ফুল ফুটানোর সময় নিয়ন্ত্রণ, পিওনিবান্ধব প্রাকৃতিক পরিবেশসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি আয়ত্ব করেন। পিওনির পাত্রে ফুল, তাজা পিওনি ফুলসহ বিভিন্ন ধরনের ফুলদ্রব্য ও শিল্প চেইন নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি। তা ছাড়া, উদ্যানে ব্যবহৃত ৭০ ধরনেরও বেশি উদ্ভিদের চাষাবাদ পদ্ধতি ও বিঁচি সংরক্ষণের প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন তথ্য ভান্ডার স্থাপন করেছেন। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ তাত্পর্য রয়েছে এর।

নিজের গবেষণাকাজ সম্পর্কে শিক্ষক লিউ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনার সময় ‘উদ্যান ও তৃণভূমির ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা’ ক্লাসে অধ্যাপক ইয়াং শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করেন: সাপ্তাহিক ছুটিতে তোমরা কী করো? তখন অনেকে বলল ক্লাসরুমে পড়াশোনা করি। তবে অধ্যাপক ইয়াং সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি আবার প্রশ্ন করেন: তোমাদের পড়াশোনার বিষয় অন্যদের জন্য সুন্দর পরিবেশ স্থাপন করা। যদি তোমরা নিজেই বাইরে না যাও, তাহলে কিভাবে অন্যদের জন্য সুন্দর পরিবেশ গড়ে তুলবে? এ কথা ক্লাসের শিক্ষার্থীদের মনে গভীর দাগ কাটে। টানা ৪০ বছরের গবেষণার পর শিক্ষক লিউ বুঝতে পেরেছেন অধ্যাপক ইয়াংয়ের কথার অর্থ। তিনিও অধ্যাপক ইয়াংয়ের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য আরও প্রাণবন্ত করে ক্লাস নেওয়ার চেষ্টা করেন; তাদেরকে নমনীয় পদ্ধতিতে শেখানোর চেষ্টা করেন।

 (সুবর্ণা/আলিম/রুবি)