এবারের পর্ব সাজানো হয়েছে
১। ফোন ছাড়া ১৩৪ দিন ভ্রমণ
২। চীনের পাহাড়ি গ্রামে তীর্থস্থান ঘিরে পর্যটন বিপ্লবের গল্প
৩। ঘুরে আসুন বেইজিংয়ের ন্যাশনাল সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্ট
বিশ্বব্যাপী অপরূপ সৌন্দর্যের চাদর বিছিয়ে রেখেছে বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি। কতো-শতো দেশ, কতো সংস্কৃতি, কতো ভাষা, কতো পেশা,.... কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতি কিংবা সময়ের টানাটানিতে দেখা হয় না, ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’
‘একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশির বিন্দু...’সেই অদেখাকে দেখাতেই আমাদের আয়োজন "ঘুরে বেড়াই"।
দেশ-বিদেশের দর্শনীয় স্থান, সেখানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, এবং সেই স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অর্থনীতি নিয়ে আমাদের অনুষ্ঠান ‘ঘুরে বেড়াই’।
ঘুড়ে বেড়াই অনুষ্ঠানের ৮৬ তম পর্ব আজ। আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি, আফরিন মিম।
১। মোবাইল ফোন ছাড়া ১৩৪ দিন ভ্রমণ
ডিজিটাল এই যুগে, স্মার্টফোন যেখানে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে, সেখানে ফোন, ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট ছাড়া ১/২ দিন নয়, পুরো ১৩৪ দিন কাটিয়েছেন চীনের পিএইচডি শিক্ষার্থী ইয়াং হাও।
ফোন ছাড়া জীবন কতটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, তা দেখতেই দুটি ক্যামেরা নিয়ে চীন ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিলেন ইয়াং।
ইয়াং গত বছরের নভেম্বরে শানসি প্রদেশে তাঁর নিজের বাড়ি থেকে ছয় মাসের জন্য ভ্রমণে বেরিয়ে যান। তিনি এ সময় ২৪টি প্রদেশ ও অঞ্চল ভ্রমণ করেন।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ইয়াং তাঁর মুঠোফোন ও ল্যাপটপ বাড়িতেই রেখে যান। সঙ্গে নেন শুধু দুটি ক্যামেরা, যেগুলো ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায় না। নিজের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ক্যামেরাবন্দী করতেই তিনি সেগুলো সঙ্গে নেন।
ইয়াং বলেন, ‘মুঠোফোনকে আমার নিজের ডিজিটাল অঙ্গ মনে হয়। এটি ছাড়া আমরা অনেক কিছুই করতে পারি না। তাই আমি দেখতে চেয়েছিলাম, যদি ইন্টারনেটে প্রবেশের কোনো রকম সুযোগ না থাকে, তাহলে কেমন হবে। টানা কয়েক মাস ধরে এমনটা হলে অভিজ্ঞতা ঠিক কেমন হবে।’
বলার অপেক্ষা রাখে না, চীনে প্রযুক্তি ছাড়া পথ চলতে গেলে অনেক প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয়। সাধারণ কোনো কাজও ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে। যেমন হোটেলে কক্ষ আগাম ভাড়া করা বা ট্যাক্সি ভাড়া করা।
ইয়াং বলেন, ‘আমি কোনো ফোন ব্যবহার করছি না, এটা শুনে বেশির ভাগ মানুষই অবাক হয়ে যেতেন। কেউ কেউ সন্দেহের গলায় জিজ্ঞেস করতেন, আমি খারাপ কিছু করছি কি না। কেউ কেউ এটাও ভাবতেন যে আমি বিশেষ কোনো কাজ করছি। বাকিরা মনে করতেন, মুঠোফোন ছাড়া জীবনযাপন দারুণ মজার কিছু।’
তবে নানা রকম উদ্ভট সংকটের মুখে পড়লেও ফোনবিহীন জীবনে অবাক করা কিছু সুবিধা খুঁজে পেয়েছেন ইয়াং। মুঠোফোনে ক্রমাগত নানা নোটিফিকেশনের ‘পিং’ শব্দ আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়া জীবনে প্রথমবার তিনি কোনো কাজে অধিক মনোনিবেশ করতে পেরেছেন, নিজেকে নিয়োজিত করতে পেরেছেন আরও অর্থবহ সাধনায়।
বই পড়ে, লেখালেখি করে এবং নানা বিষয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করে ইয়াং সময় কাটিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এসব সমস্যা ও আনন্দ অর্জন আমাকে বিস্মিত করেছে। এটা জীবনের দারুণ এক অভিজ্ঞতা।’
ইয়াং বলেন, ‘আমার নিজেকে প্রাচীন যুগের মানুষ মনে হয়েছে, সময় পরিভ্রমণ করে যে আধুনিক যুগে এসেছে।’
নিজের পিএইচডি গবেষণার জন্যই ইয়াং এ কাজ করেছেন। নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে তাঁর। রাস্তায় চলতে চলতে যেসব ভিডিও ও ছবি তিনি তুলেছেন, সেগুলো দিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরির পরিকল্পনাও আছে তাঁর।
প্রতিবেদন- আফরিন মিম
সম্পাদনা- শান্তা মারিয়া
২। চীনের পাহাড়ি গ্রামে তীর্থস্থান ঘিরে পর্যটন বিপ্লবের গল্প
শরতের সকাল, আকাশে ভেসে চলেছে পেজা তুলোর মতো মেঘ, দৃষ্টিসীমা জুড়ে বিস্তৃত শুভ্র তুষারাবৃত পর্বত মালা। পাহাড়ি দুস্তর পথে ঘোড়ার পিঠে পর্যটক নিয়ে চলেছেন সাংয়ে থেনচিন।
চীনের সিচাং অঞ্চলের মাউন্ট কাংরিনবোকের পাদদেশের ছোট্ট গ্রাম গাংকার বাসিন্দা এই তরুণ। পর্যটকদের ঘোড়ায় পিঠে ঘুড়িয়ে দেখানোই তার কাজ।
মাউন্ট কাংগ্রিনবোকে ৬ হাজার ৬৫৬ মিটার উচ্চতায় রয়েছে সনাতনি ও বৌদ্ধদের একটি তীর্থস্থান। তাই প্রতি বছর দেশ-বিদেশের পর্যটক এবং তীর্থযাত্রীরা আসেন এই পবিত্র পর্বতে। এখানকার যে গ্রামগুলো পশুপালনের উপর নির্ভর করত তা এখন দারিদ্রতাকে জয় করে ঝুঁকছেন ভ্রমণ গাইডে।
পর্যটকদের ঘোড়ায় পিঠে ঘুড়িয়ে গেল মাসে প্রায় তিনি আয় করেছেন ৭ হাজার ইউয়ান। আর এই ভ্রমণে প্রতিটি ট্রিপে সময় লাগে প্রায় তিন দিন। পশুপালনের চেয়ে এই পেশায় এখন আয় বেশি বলছেন তিব্বতিরা। পাশাপাশি মাল বাহক, ঘোরসাওয়ার, হোমস্টে সেবা ও পেশা নিয়েও নিজেদের জীবনযাত্রার ম্যান পালটে দিয়েছে এখানকার বাসিন্দারা।
৩৬০ টিরও বেশি পরিবারের এই গ্রামে ১৯৮০ সালে তীর্থযাত্রী এবং পর্যটকদের মালামাল বহনের জন্য একটি দল গঠন করা হয়। ২০১৮ সালে কাউন্টি সরকারের সহায়তায় ঘোড়া এবং ইয়াক পরিবহন এবং অন্যান্য পরিষেবাগুলোর ব্যবস্থাপনার জন্য কাংরিনবোকে একটি পর্যটন পরিষেবা সংস্থা চালু করা হয়। ম্যান্ডারিন, ইংরেজি ভাষা এবং রান্নার প্রশিক্ষণেরও আয়োজন করে থাকে সংস্থাটি।
৪৮ বছর বয়েসী এলেনা ফ্লেরোভা একজন বিদেশী টুরিস্ট। ঘুরতে এসেছেন এই তীর্থযাত্রায়। তিনি বলেন “ট্যুর গ্রুপটি গাংকার একটি হোটেলে রাত কাটায় যা ছিলো এক অপূর্ব দৃশ্য, এখানকার খাবারও আমার অনেক ভাল লেগেছে।
২০১৯ সালে কাউন্টি সরকার গ্রামে একটি রিসোর্ট তৈরি করেছে এবং স্থানীয় উন্নয়নে সহায়তা করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
তিব্বতীয় জাতিগত সংস্কৃতি প্রচার করতে এবং আরও পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে প্রতি বছর একটি সাংস্কৃতিক পর্যটন উৎসবের আয়োজনও করে থাকে। এই উৎসবে পর্যটকরা উপভোগ করে ঘোড়দৌড় এবং অন্যান্য লোক সংস্কৃতির নানা প্রদর্শনী।
প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করার জন্য, কাংরিনবোকে রিসোর্টের ভিতরের রাস্তাগুলো এখনও পাকা নয়। আর পরিচ্ছন্ন রাখতে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না দর্শনার্থীদের গাড়ি। পাশাপাশি রিসোর্টটিতে স্থাপন করা হয়েছে "আবর্জনা ব্যাঙ্ক"। আর এখানে যাতে পর্্যটকরা ময়লা ফেলে তাতে উৎসাহিত করতে তাদের দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন গিফট।
পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধার্থে গাংকা গ্রাম থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে শীঘ্রই বাণিজ্যিকভাবে চালু হচ্ছে বিমানবন্দর।
একসময়ের দারিদ্র্যপীরিত এই গ্রাম এখন পর্যটনে চাঙ্গা। গাংকা গ্রামের এইসব পর্যটন বান্ধব পদক্ষেপ সিচাংকে নতুন করে সজ্জিত করেছে।
প্রতিবেদন- নাসরুল্লাহ মানসুর
সম্পাদনা- আফরিন মিম
৩। ঘুরে আসুন বেইজিংয়ের ন্যাশনাল সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্ট
বেইজিংয়ের একটি আইকনিক স্থাপনা হলো ন্যাশনাল সেন্টার ফর দ্য পারফর্মিং আর্ট। জনসাধারণের মুখে মুখে এর নাম জায়ান্ট এগ। কারণ এর আকার হলো বিশাল এক ডিমের মতো। এটি এশিয়ার বৃহত্তম থিয়েটার কমপ্লেক্স। দূর থেকে দেখলে মনে হয় পুরো ভবনটি পানির উপর ভাসছে।
এই সেন্টারের শুরুতেই রয়েছে খোলা চত্বর। মূল ভবনে প্রবেশ পথ হলো পানির নিচ দিয়ে। ৮০ মিটার আন্ডারওয়াটার প্যাসেজ রয়েছে।
২০০৭ সালে এই আর্ট সেন্টার নির্মাণ করা হয়। দশতলা সমান উঁচু ভবনের বাইরের আবরণ তৈরি করতে ১৮ হাজার টিটানিয়াম মেটাল প্লেট ব্যবহার করা হয়েছে। ১২শ’ পিস আলট্রা হোয়াইট গ্লাস ব্যবহার করা হয়েছে।
বেইজিংয়ের একদম প্রাণকেন্দ্রে এই থিয়েটার হল। ছাংআন স্ট্রিটের পাশে অবস্থিত এই কেন্দ্র গ্রেট হল অব পিপল, থিয়েনআনমেন চত্বর এবং রয়্যাল প্যালেস মিউজিয়াম থেকে বেশ কাছে।
এই ভবনে চীনের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য নকশার সঙ্গে আধুনিক স্থাপত্য প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। মূল ভবনের ভিতর তিনটি প্রধান পারফরম্যান্স হল রয়েছে। অপেরা হল, মিউজিক হল এবং থিয়েটার হল। অপেরা হলটি সবচেয়ে জমকালো। এই হলটি রাজকীয় সোনালি রঙের। এখানে অপেরা, নৃত্য ব্যালে এবং বড় আকারের অনুষ্ঠান পরিবেশনা করা হয়। মিলনায়তনে ২২০৭টি দর্শক আসন রয়েছে। পুরো মঞ্চ ঘূর্ণায়মান। মঞ্চটি উপরে, নিচে ও পাশেও সরানো সম্ভব।
মিউজিক হলে ১৮৫৯টি দর্শক আসন রয়েছে। চীনের সবচেয়ে বড় অর্গ্যান এখানে রয়েছে।
থিয়েটার হলটি ঐতিহ্যবাহী চাইনিজ লাল রঙে সজ্জিত। এখানে ১০৩৬টি দর্শক আসন রয়েছে। এই থিয়েটার হলের মঞ্চ অত্যাধুনিকভাবে তৈরি। ফলে পরিবেশনাকে একদম বাস্তব করে তোলা সম্ভব। ঐতিহ্যবাহী চীনা থিয়েটারের প্রদর্শনের জন্য রয়েছে বিশেষ প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা।
পুরো স্থাপনাটি তৈরি করতে ৩ বিলিয়ন ইউয়ান ব্যয় হয়েছে। ন্যাশনাল সেন্টার ফর পারফর্ আর্ট ভবনে নানা রকম প্রদর্শনীও হয়ে থাকে। যে কোন সময়ে পর্যটকরা এখানে ঘুরতে যেতে পারেন। এখানে ঘোরার জন্য কোন টিকেট কাটার প্রয়োজন হয় না।
প্রতিবেদন- শান্তা মারিয়া
সম্পাদনা- আফরিন মিম
ঘুরে বেড়াই অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও প্রযোজনা - আফরিন মিম
অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল
সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী