চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব
৮৭তম পর্বে যা থাকছে:
১। অঙ্গের ভেতরে কোষের জটিল যোগাযোগ দেখতে সক্ষম মাইক্রোস্কোপ
২। মোবাইল টাওয়ারের জন্য একসঙ্গে লিথিয়াম ব্যাটারি তৈরি করবে ওয়ালটন-হুয়াওয়ে
অঙ্গের ভেতরে কোষের জটিল যোগাযোগ দেখতে সক্ষম মাইক্রোস্কোপ
একটি অত্যাধুনিক ইন্ট্রাভাইটাল মাইক্রোস্কোপ তৈরি করেছেন চীনের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল। এই মাইক্রোস্কোপটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ভেতরে কোষগুলো কীভাবে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করে এবং কোষের নেটওয়ার্কের সমস্ত ত্রিমাত্রিক (৩ডি) ইন্টারঅ্যাকশন স্পষ্টভাবে দেখাতে সক্ষম। সম্প্রতি সেল জার্নালে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।
এই যন্ত্রটি অনকোলজি, ইমিউনোলজি এবং নিউরোসায়েন্সে উদ্ভাবনী গবেষণা বাড়ানোর জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এই যন্ত্রটি এত শক্তিশালী যে, এটি এক একটি কোষকে আলাদা করে পরীক্ষা করতে পারে। এর ফলে আমরা জানতে পারবো যে, একটা অঙ্গের ভিতরে কোষগুলো কীভাবে কাজ করে, কীভাবে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে এবং রোগের সময় কী পরিবর্তন হয়। এটি পুরো অঙ্গের কার্যকলাপকে খুব সহজে বুঝতে সাহায্য করবে। আমরা জানতে পারবো যে, কোন কোন কোষ একসাথে মিলে কাজ করে কোন কাজটি সম্পন্ন করে।
রাস৩ডি সিস্টেম নামক এই মাইক্রোস্কোপটি খুব শক্তিশালী। যা খুব ছোট জিনিসকে খুব বড় করে দেখাতে পারে। এটি সেকেন্ডে ২০ ফ্রেমের হারে হাই-স্পিড ৩ডি ইমেজিং করতে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে অসংখ্য নিউরন নামক কোষ আছে। এই নিউরনগুলো একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং বিভিন্ন ধরনের তথ্য আদান-প্রদান করে। এই যোগাযোগের মাধ্যমেই আমরা চিন্তা করি, অনুভূতি অনুভব করি, সিদ্ধান্ত নিই এবং শারীরিক কাজ করি।
বিজ্ঞানীরা এই মাক্রোস্কোপের সাহায্যে একটি জীবিত ইঁদুরের মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট অংশ (সেরেব্রাল কর্টেক্স) খুব কাছ থেকে পরীক্ষা করেছেন। যন্ত্রটি ইঁদুরের মস্তিষ্কের এই অংশের বিভিন্ন স্তরগুলোকে খুব দ্রুত গতিতে ত্রিমাত্রিক চিত্রে দেখাতে সক্ষম হয়েছে। তারা বিভিন্ন ধরনের সংবেদন (যেমন দেখা, শোনা, স্পর্শ) একসাথে দিয়ে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারা একই নিউরনকে বারবার পরীক্ষা করে এবং দেখেছেন যে মস্তিষ্কের কোটি কোটি নিউরন কীভাবে বিভিন্ন সংবেদনের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই পরীক্ষা তারা কয়েকদিন ধরে চালিয়েছেন।
গবেষণাপত্রের লেখক তাই ছিওংহাই জানান, ঐতিহ্যগত ফ্লোরেসেন্স মাইক্রোস্কোপি আমাদেরকে একটি অঙ্গের, যেমন একটি ইদুরের নির্দিষ্ট মস্তিষ্কের অঞ্চলটি পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম করেছে।
এই আবিষ্কার জীববিজ্ঞান গবেষণায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বিশেষ করে, কোষ জীববিজ্ঞান, টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং, এবং রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে এর অপরিসীম সম্ভাবনা রয়েছে। এই মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে বিভিন্ন রোগের কারণ ও প্রক্রিয়া আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে। ফলে নতুন ও আরও কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করা সম্ভব হবে।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
একসঙ্গে লিথিয়াম ব্যাটারি তৈরি করবে ওয়ালটন-হুয়াওয়ে
বাংলাদেশের টেলিকম খাতের বিটিএসগুলোতে (বেস ট্রান্সসিভার স্টেশন) ব্যবহারের জন্য লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদন করবে দেশের শীর্ষ স্থানীয় ইলেকট্রনিক কোম্পানি ওয়ালটন। প্রতিষ্ঠানটি বছরে ৮০ হাজার ব্যাটারি উৎপাদনে সক্ষম একটি অত্যাধুনিক ও সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় প্রোডাকশন লাইন তৈরি করার পাশাপাশি সারা দেশে এই ব্যাটারির বিক্রয় ও বিক্রয়-পরবর্তী সেবা পরিচালনা করবে। আর এ লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদনের জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা, ডিজাইনের নির্দেশনা, কাঁচামাল ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে।
সম্প্রতি লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদন সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে হুয়াওয়ে ও ওয়ালটন। ঢাকায় হুয়াওয়ে বাংলাদেশ একাডেমিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন হুয়াওয়ে বাংলাদেশের সিইও ফ্যান চুনফেং ও ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান এস এম রেজাউল আলম। আর এই চুক্তির আওতায় ওয়ালটন আগামী সাত মাসের মধ্যে টেলিকম লিথিয়াম ব্যাটারি বাংলাদেশে উৎপাদন ও বাজারজাত করবে।
বহু বছর ধরে বিটিএস টাওয়ার ব্যাকআপ পাওয়ারের উৎসের জন্য লেড-এসিড ব্যাটারির উপর নির্ভরশীল। এই ব্যাটারিগুলো লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির মতো পরিবেশবান্ধব নয়। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির চেয়ে লেড ব্যাটারি ৫০% বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে। এছাড়া এগুলো বায়ু ও মাটির দূষণের জন্যও দায়ী। অন্যদিকে লেড-এসিড ব্যাটারির সক্ষমতাও তুলনামূলকভাবে কম। এর কার্যকারিতা মাত্র ৮০-৮৫%। পাশাপাশি স্থায়ীত্ব ও ব্যাটারি এনার্জি ডেনসিটিও কম। বিটিএস-এ এগুলোর জন্য বেশি জায়গা প্রয়োজন হয়।
এদিকে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির কার্যকারিতা প্রায় ১০০%। এই ব্যাটারি যেমন দীর্ঘস্থায়ী, তেমন এর রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনও কম। পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি পরিবেশবান্ধব। এই কারণে বিটিএস টাওয়ারের ব্যাকআপ পাওয়ার হিসেবে লিথিয়াম ব্যাটারি টেলিকমখাতে ইতোমধ্যেই গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। তবে বাংলাদেশের বাজারে এখনো নিম্ন মানের নন-ইন্টেলিজেন্ট লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহৃত হচ্ছে।
এইসব নন-ইন্টেলিজেন্ট লিথিয়াম ব্যাটারির স্থায়ীত্ব কম এবং রক্ষণাবেক্ষণও বেশ জটিল। এছাড়া এনএমএস (নেটওয়ার্ক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম)-এর মাধ্যমে এসব ব্যাটারির ব্যবস্থাপনা সম্ভব নয়। এই ধরনের নন-ইন্টেলিজেন্ট লিথিয়াম ব্যাটারি কোনো সাইট থেকে চুরি হলে টেলিকম অপারেটররা সময়মতো চুরির ঘটনা সনাক্ত করতে পারে না। ফলে সেই সাইটে ব্যাকআপ পাওয়ার থাকে না এবং অনেক সময় সাইটটি বন্ধও হয়ে যায়। এই কারণে সেই এলাকার ব্যবহারকারীরা নেটওয়ার্ক সমস্যার সম্মুখীন হন।
হুয়াওয়ে ও ওয়ালটনের চুক্তি এবং আগামীতে উৎপাদিত উচ্চমানের ইন্টেলিজেন্ট ব্যাটারি টেলিকম শিল্পে খরচ সাশ্রয়, পরিচালনা দক্ষতা বৃদ্ধি ও দুর্যোগ পরবর্তী পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় সহায়ক হবে। এছাড়া এর ব্যবহার বাংলাদেশকে বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সাহায্য করবে।
চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, ‘বর্তমানে সারাবিশ্বে নবায়নযোগ্য শক্তির একটি বিপ্লব চলছে। ক্রমশ জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে সোলার ফটোভোলটাইক ও বায়ুচালিত শক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। আগামীতে উন্নয়নের জন্য লিথিয়াম এনার্জি স্টোরেজ প্রযুক্তি প্রয়োজন অনস্বীকার্য। হুয়াওয়ে ও ওয়ালটনের মধ্যে আজকের চুক্তিটি এই প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ”।
ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম মঞ্জুরুল আলম অভি বলেন, এই উদ্যোগ বাংলাদেশের টেলিকম শিল্পে বর্তমানে ব্যবহৃত লেড অ্যাসিড ব্যাটারির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেবে, যার ফলে সামগ্রিকভাবে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমবে”।
হুয়াওয়ে বাংলাদেশের সিইও ফ্যানচুনফেং বলেন, ‘বিশ্বের টেলিকম খাতে ব্যবহৃত শক্তির এক-তৃতীয়াংশের জন্য এই ব্যাটারি ব্যবহৃত হচ্ছে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে হুয়াওয়ের লিথিয়াম ব্যাটারির বাজারের শেয়ার ৩৫ শতাংশ”।
পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও শক্তি উৎপাদনের মাধ্যমে সবুজ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে হুয়াওয়ে। প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য হলো দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সুফল বয়ে আনতে টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখা। ওয়ালটনের সঙ্গে হুয়াওয়ের চুক্তিটি এই প্রচেষ্টারই একটি প্রতিফলন।
|| প্রতিবেদন: আফরিন মিম
|| সম্পাদনা: শুভ আনোয়ার
নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।
প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার
অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল
স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- ফয়সল আবদুল্লাহ
সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী