চীন এবং লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান (এলএসি) দেশগুলো তাদের ব্যাপক সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বকে আরও গভীর করে চলেছে। বিপরীতক্রমে পশ্চিমা দেশগুলো চীনের তথাকথিত ‘ঋণ ফাঁদ’ তৈরির অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তবে, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা এ অপপ্রচারকে দু’পক্ষের মধ্যে স্বাভাবিক সহযোগিতা ব্যাহত করার প্রচেষ্টা হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
সম্প্রতি বেইজিংয়ে চীন-লাতিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান (এলএসি) উন্নয়ন ফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হন্ডুরাসের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরার্ডো টরেস চীনা গণমাধ্যমের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাত্কারে বলেছেন, চীনের বিরুদ্ধে পশ্চিমা শক্তিগুলোর দ্বারা প্রচারিত ‘ঋণের ফাঁদ’ আখ্যান ‘অত্যন্ত ভণ্ডামিপূর্ণ’।
চীন-এলএসি জয়-জয় সহযোগিতা ওই অঞ্চলের উন্নয়নের চাহিদার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত বলে উল্লেখ করে টরেস বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর চীনের তথাকথিত ‘ঋণ ফাঁদ’ বিষয়ক সমালোচনা করার নৈতিক অবস্থান নেই, কারণ এক সময় ওই অঞ্চলের প্রধান ঋণদাতা হিসাবে তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।
তিনি পশ্চিমা ঋণদাতাদের কাছে এলএসি দেশগুলোর বিপুল ঋণের উল্লেখ করে বলেন, ‘দশকের পর দশক ধরে, পশ্চিমা দেশগুলো ঋণের মাধ্যমে তাদের আর্থিক মানদণ্ড আরোপ করেছে যা কখনোই ওই অঞ্চলকে সত্যিকারের উন্নয়নের দিকে পরিচালিত করেনি।”
ব্রাজিলের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিক রিসার্চের গবেষক পেড্রো ব্যারোস, চীনের তথাকথিত ‘ঋণ ফাঁদ’ আখ্যানকে পশ্চিমাদের বাগাড়ম্বরপূর্ণ অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
ব্যারোস স্পষ্ট করে বলেন, “দশকের পর দশক ধরে, পশ্চিমা দেশগুলো ঋণের মতো একটি আর্থিক হাতিয়ারের অপব্যবহার করেছে, তারা এলএসিতে গণতন্ত্র এবং উন্নয়নকে দুর্বল করেছে। এখন, তারা চীনকে একই কাজ করার জন্য অভিযুক্ত করেছে। কিন্তু অতীতে পশ্চিমাদের অপব্যবহারগুলো ঋণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সেটি একটি ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল যা শতাব্দী ধরে অব্যাহত ছিল।”
চীনের আর্থিক সম্পৃক্ততা এলএসি এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত চাহিদা মেটাতে এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে, যা ঐতিহ্যগত আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অদক্ষতা এবং কার্যকারিতার অভাবকেও প্রতিফলিত করে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন ব্রাজিলিয় এই গবেষক।
চায়না-লাতিন আমেরিকা আর্থিক ডাটাবেস অনুসারে, ২০০৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চীনের ঋণ এলএসিতে অবকাঠামো প্রকল্পগুলোকে বহুলাংশে সমর্থন করেছে।
ব্যারোস বলেন, “চীনা অর্থায়ন আঞ্চলিক প্রবৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যক। উদাহরণস্বরূপ, ইকুয়েডর একসময় বিদ্যুৎ আমদানির উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু চীনের সহায়তায় একাধিক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে, এর ফলে দেশটি উল্লেখযোগ্যভাবে বিদ্যুতের ঘাটতি ও আমদানি কমাতে পেরেছে।”
আন্দিয়ান কমিউনিটির মহাসচিব গঞ্জালো গুতেরেস বলেছেন যে, “চীন কেবল ঋণই দিচ্ছে না বরং সরাসরি বিনিয়োগও করছে, যা এই অঞ্চলে ব্যাপকভাবে স্বাগত জানানো হয়েছে। প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ তা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ায়।”
লাতিন আমেরিকা এবং চীনের ক্যারিবিয়ান নেটওয়ার্কের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এলএসিতে চীনের সহযোগিতাপুষ্ট প্রকল্পে ৭ লাখ ৭৭ হাজারের বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
চাইনিজ একাডেমি অফ সোশ্যাল সায়েন্সেসের লাতিন আমেরিকা ইনস্টিটিউটের উপ-পরিচালক ইউ ইউনজিয়া বলেছেন, চীন-এলএসি আর্থিক সহযোগিতা, দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার উদাহরণ হিসাবে, সংহতি এবং পারস্পরিক সুবিধার নীতিগুলোকে মূর্ত করে।
তিনি বলেন, “পশ্চিমা ঋণ পেতে প্রায়শই এলএসি দেশগুলোর জন্য পশ্চিমা মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংস্কার বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা থাকে। বিপরীতে, চীনের ঋণ রাজনৈতিক শর্ত আরোপ না করেই অভিন্ন উন্নয়ন লক্ষ্যের উপর ফোকাস করে।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, গত দুই দশকে চীনা ঋণের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি সত্ত্বেও, এই ঋণ গ্রহীতা দেশগুলোর জন্য ঋণ ঝুঁকি তৈরি করে না।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালে, এলএসি’র কাছে চীনের পাওনা ঋণ তাদের (উচ্চ আয়ের দেশগুলো ব্যতীত) মোট বাহ্যিক ঋণের মাত্র ০.৭ শতাংশ। ইকুয়েডর, ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার মতো ওই অঞ্চলের চীনের প্রধান ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর কাছে ঋণের পরিমাণ যথাক্রমে ৬.৮, ০.৬, ১.২ শতাংশ মাত্র।
খোদ বোস্টন ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট পলিসি সেন্টারের একটি প্রতিবেদনেও তথাকথিত ‘ঋণ ফাঁদ’ আখ্যানকে চ্যালেঞ্জ করে চীনের ঋণকে ‘রোগীর মূলধন’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক বিকল্প যা সংযোগ বাড়ায়, বাণিজ্য বাড়ায় এবং বিনিয়োগ আকর্ষণ করে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ধারণাগত সমস্যা, অভিজ্ঞতামূলক ভিত্তির অভাব হেতু ‘ঋণ ফাঁদ কূটনীতি’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা উচিত। কারণ চীনা অর্থায়ন উদীয়মান বাজার এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতি-ইএমডিইতে অর্থায়ন ও অবকাঠামোগত ব্যবধান মোকাবেলার জন্য আরও অর্থায়নের একটি বৈধ প্রয়োজনকেই তুলে ধরে।
মাহমুদ হাশিম
সিএমজি বাংলা, বেইজিং।