আফ্রিকার ডিজিটাল বিকাশ দেরিতে শুরু হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, এ অঞ্চলের দেশগুলো এটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ কারণে আফ্রিকাতে ডিজিটাল পরিষেবাগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আফ্রিকার বর্তমান ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ার বিস্তৃত সম্ভাবনা রয়েছে, যেমন নীতি নির্দেশিকা এবং মোবাইল পেমেন্টের দ্রুত বিকাশের মতো উন্নয়নের সুযোগ আছে, একই সঙ্গে অপর্যাপ্ত ডিজিটাল অবকাঠামো এবং প্রতিভার ঘাটতির মতো চ্যালেঞ্জগুলোও রয়েছে।
বর্তমানে, ই-কমার্স, ফিনান্স, ই-গভর্নমেন্টসহ নানা ক্ষেত্রে আফ্রিকার ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া অনেক জায়গায় বিকশিত হয়েছে।
আফ্রিকান ই-কমার্স শিল্পের সামগ্রিক বৃদ্ধি শক্তিশালী। ই-কমার্স শিল্পের সামগ্রিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে, জার্মান স্ট্যাটিস্টা ডেটা প্ল্যাটফর্মের পরিসংখ্যান অনুসারে, আফ্রিকাতে ই-কমার্সের বার্ষিক বৃদ্ধির হার ২০২৪ সালে ২৪.৭ শতাংশে পৌঁছাবে এবং ই-কমার্স শিল্পের বিক্রির বার্ষিক পরিমাণ ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে, যখন ২০১৭ সালে এই সংখ্যাটি ছিল মাত্র ৭.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আফ্রিকার আর্থিক খাতে ডিজিটাল উদ্ভাবন ইতিবাচক ফলাফল অর্জন করেছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত, আফ্রিকায় ৫০০টিরও বেশি আর্থিক প্রযুক্তির ডিজিটাল উদ্ভাবনশীল সংস্থা ছিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ এবং কেপটাউন, কেনিয়ার নাইরোবি এবং নাইজেরিয়ার লাগোস বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি আর্থিক প্রযুক্তিগত সিস্টেমে উদ্ভাবনশীল শহরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
এ ছাড়াও, আফ্রিকার ই-গভর্নমেন্টের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ফলাফল অর্জিত হয়েছে। ‘২০২২ সালে জাতিসংঘ ই-গভর্নমেন্ট তদন্ত রিপোর্ট অনুসারে, ২০২০ সাল থেকে আফ্রিকার ই-গভর্নমেন্টের উন্নয়নে সবচে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, ই-গভর্নমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স বা ইজিডিআইয়ের গড় মান ৩.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আইভরি কোস্ট, রুয়ান্ডা এবং জাম্বিয়া প্রথমবারের মতো ইজিডিআইয়ের উচ্চ-স্তরের গ্রুপে যোগ দিয়েছে। ইজিডিআইয়ের নিম্ন-স্তরের গ্রুপে আফ্রিকান দেশগুলোর অনুপাতে নিম্নগামী প্রবণতা দেখা দিয়েছে। একটি বিস্তৃত সূচক হিসেবে ইজিডিআই টেলিকমিউনিকেশন অবকাঠামো সূচক, মানব মূলধন সূচক এবং অনলাইন পরিষেবা সূচকসহ তিনটি প্রমিত সূচকের ওজনযুক্ত গড় দ্বারা গণনা করা হয়।
উন্নয়নের একটি নতুন ইঞ্জিন হিসেবে আফ্রিকায় ডিজিটালাইজেশনের উন্নয়নের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। চায়না ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সের ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ স্কুলের ফ্রেঞ্চ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং আফ্রিকান স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা লিউ থিয়েননান বিশ্বাস করেন যে, এটি মূলত নীতি নির্দেশিকা, অবকাঠামোগত অগ্রগতি, জনসংখ্যার পরিমাণ ও গুণমানের উন্নতিতে এবং মোবাইল পেমেন্টের দ্রুত বিকাশসহ নানা ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়।
আঞ্চলিক বা জাতীয় পর্যায়ে, আফ্রিকা ডিজিটালাইজেশনের জন্য বিভিন্ন উন্নয়ন কৌশল তৈরি করে। একদিকে, আফ্রিকান ইউনিয়নের নীতি-নথিতে উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং প্যান-আফ্রিকান নেটওয়ার্ক সিস্টেম ও আফ্রিকান অনলাইন ইউনিভার্সিটির মতো ডিজিটাল ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে, অন্যদিকে অনেক আফ্রিকান দেশ প্রাসঙ্গিক নীতিগুলোকে উন্নীত করার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন মিশরের ‘২০৩০ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি কৌশল’ এবং কেনিয়ার ‘ডিজিটাল ইকোনমিক ব্লুপ্রিন্ট’ প্রভৃতি।
আফ্রিকার তথ্য ও যোগাযোগের প্রযুক্তির অবকাঠামো অব্যাহতভাবে অগ্রগতি হচ্ছে। আফ্রিকান ইউনিয়নের ‘এজেন্ডা ২০৬৩’র দ্বিতীয় কার্যকরি প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৩ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ইন্টারনেট অ্যাক্সেসসহ আফ্রিকার জনসংখ্যা ৪৫ শতাংশ থেকে ৭২ শতাংশে বেড়েছে। গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশন প্রকাশিত ‘২০২৩ সাব-সাহারান আফ্রিকা মোবাইল ইকোনমি’ রিপোর্ট অনুসারে ২০৩০ সাল পর্যন্ত আফ্রিকায় স্মার্টফোন ব্যবহারের হার ৮৮ শতাংশে পৌঁছাবে, ফোর-জি ব্যবহারের হার প্রায় ৫০ শতাংশে পৌঁছে যাবে এবং ফাইভ-জি’র ব্যবহারের হার প্রায় ১৭ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন যে, আফ্রিকা মহাদেশের জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জনসংখ্যার মানও ক্রমাগত উন্নত হচ্ছে, যা আফ্রিকায় ডিজিটালাইজেশনের প্রচার ও উন্নয়নের জন্য সহায়ক। পরিসংখ্যান অনুসারে, ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী আফ্রিকান যুবকদের সংখ্যা, যারা মাধ্যমিক বা উচ্চ শিক্ষার স্তরে পৌঁছেছে ২০১০ সালে ৪৭ মিলিয়ন থেকে ২০২০ সালে ৭৭ মিলিয়নে উন্নীত হয়েছে এবং ২০৪০ সালের মধ্যে প্রায় ১৬৫ মিলিয়নে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আফ্রিকাতে মোবাইল পেমেন্টও দ্রুত বিকাশ লাভ করছে। ২০০৭ সালে এম-পেসা প্ল্যাটফর্ম চালু হওয়ার পর থেকে, ২০১৮ সাল নাগাদ আফ্রিকায় মোবাইল পেমেন্ট দ্রুত প্রসারিত হয়েছে এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এম-পেসা হল কেনিয়ার টেলিকম অপারেটর সাফারি কমিউনিকেশনসের চালু করা একটি মোবাইল পেমেন্ট সিস্টেম, যা এখন একটি বিস্তৃত প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। এটি বিভিন্ন আর্থিক পরিষেবা যেমন আমানত এবং উত্তোলন, স্থানান্তর, অর্থপ্রদান, ক্রেডিট এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা পরিষেবা প্রদান করে।
যদিও আফ্রিকার ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া দারুণ অগ্রগতি করেছে, তবুও ডিজিটাল অবকাঠামো নির্মাণ, প্রতিভা এবং শাসন ক্ষমতার ক্ষেত্রে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
আফ্রিকা মহাদেশে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রযুক্তিগুলো বেশিরভাগই ২জি এবং ৩জি স্তরের এবং ৪জি’র প্রয়োগের সুযোগও যথেষ্ট প্রশস্ত নয়। এমনকি ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত এলাকায় অনেক লোক বিভিন্ন কারণে ডিজিটাল পরিষেবাগুলো উপভোগ করতে পারে না এবং আফ্রিকান দেশগুলোর বেশিরভাগ সার্ভার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো অতিরিক্ত-আঞ্চলিক দেশে রয়েছে তাদের সাবমেরিন অপটিক্যাল তারের মাধ্যমে যেতে হবে ইউরোপের মাধ্যমে যোগাযোগ সুবিধার বিনিয়োগের খরচ অনেক বেশি।
লিউ থিয়েননান উল্লেখ করেছেন যে, সমস্ত আফ্রিকান দেশ ডিজিটাল উন্নয়ন এবং উদ্ভাবনী প্রতিভার ঘাটতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। অঞ্চল, লিঙ্গ, শহুরে এবং গ্রামীণ অঞ্চলের কারণে আফ্রিকান যুবকদের সামগ্রিক শিক্ষার স্তর ভিন্ন।
এই বছরের জুলাইয়ের শেষে চীন-আফ্রিকা ডিজিটাল সহযোগিতা ফোরামের প্রকাশিত তথ্য দেখায় যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, চীনা কোম্পানিগুলো সক্রিয়ভাবে ডিজিটাল অবকাঠামো যেমন স্থল ও সমুদ্রের তার, ৫জি নেটওয়ার্ক এবং আফ্রিকাতে ডেটা সেন্টার নির্মাণে অংশগ্রহণ করেছে, ই-গভর্নমেন্ট, স্মার্ট পরিবহন, স্মার্ট কৃষি এবং অন্যান্য সমাধান প্রদান, আর্থিক প্রযুক্তি বৃদ্ধি, ই-কমার্স, মোবাইল ইন্টারনেট এবং অন্যান্য বিনিয়োগ পরিষেবা আরও আফ্রিকান ব্যবহারকারীদের ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে আনা সুবিধা উপভোগ করতে দেয়।
(লিলি/হাশিম/রুবি)