চীনে প্রবেশের ৩০ বছর পর হলিউড মুভির আকর্ষণ কেন হ্রাস পাচ্ছে?
2024-09-05 10:34:02

কেন আমেরিকান চলচ্চিত্র চীনে আর জনপ্রিয় হচ্ছে না? হলিউড কি চীনা বাজারে তার আকর্ষণ শক্তি হারাচ্ছে? এটি এমন একটি বিষয় যা কিছু সময়ের জন্য অনেক আমেরিকান গণমাধ্যম এবং পেশাদারদের মধ্যে ঘন ঘন আলোচনার রসদ যোগাচ্ছে।

১৯৯৪ সালে ‘দ্য ফিউজিটিভ’ নামে মুভিটি চীনে আমদানি করা প্রথম আমেরিকান চলচ্চিত্র হিসেবে চীনা দর্শকদের এবং চীনা চলচ্চিত্র শিল্পকে হতবাক করেছিল, যা চীনা বাজারে হলিউডের ভাল সময়ের সূত্রপাত করে। পরবর্তী বছরগুলোতে, ‘ট্রু লাইজ’, ‘টাইটানিক’ এবং ‘ট্রান্সফরমারস’সহ অনেক হলিউডি চলচ্চিত্র একবার চীনের বার্ষিক বক্স অফিস তালিকার অর্ধেক ছিল। একটি সিনেমা সহজেই বক্স অফিসে কয়েক মিলিয়ন বা এমনকি বিলিয়ন ইউয়ান আয় করতে পারে, যা চীনকে হলিউডের বৃহত্তম বিদেশী বাজার করে তোলে। ২০১৯ সালে, ‘অ্যাভেঞ্জার্স-৪’ চীনে ৪.২ বিলিয়ন ইউয়ানের বেশি বক্স অফিস আয়ের মধ্য দিয়ে হলিউডি চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ রেকর্ড স্থাপন করে।

যাহোক, ২০২৩ সালে প্রবেশের পর হলিউড অবাক হয়ে দেখে যে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চলচ্চিত্র বাজার হিসেবে চীনে হলিউডের সমৃদ্ধি থেকে পতনের গতি কল্পনার চেয়ে আরো দ্রুত হয়েছে। ২০২৩ সালে চীনের বক্স অফিস তালিকার শীর্ষ দশে একটিও হলিউডি চলচ্চিত্র নেই। মার্কিন গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ি, চীনের বক্স অফিসে হলিউডি চলচ্চিত্রের শেয়ার ২০২৩ সালে প্রায় ১২ শতাংশে নেমে গেছে। ২০২৪ সাল থেকে চীনের বক্স অফিসের সেরা দশটির মধ্যে শুধুমাত্র একটি ‘গডজিলা বনাম কং ২: রাইজ অফ অ্যান এম্পায়ার’ বর্তমানে অষ্টম স্থানে রয়েছে।

চীনা বাজারে প্রবেশের ৩০ বছরে তুমুল সেই জনপ্রিয়তা এখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমেরিকান গণমাধ্যম এবং পেশাদার বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল হলিউডে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুনত্ব এবং অগ্রগতির অভাব রয়েছে এবং এর চলচ্চিত্রগুলোতে দর্শকেরা বিরক্তি বোধ করছেন।

বছরের পর বছর ধরে হলিউডের চলচ্চিত্রগুলো ফর্মুল্যাক এবং ম্যাট্রিওশকা-এর মতো আইপি ডেভেলপমেন্টে আচ্ছন্ন হয়েছে এবং উদ্ভাবনী জীবনীশক্তি এবং কল্পনার সাথে মূল চলচ্চিত্রগুলোর একটি গুরুতর ঘাটতি রয়েছে। ২০২৩ সালে চীনে প্রবেশকারী হলিউডি চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস ১০’ বক্স অফিসের সর্বোচ্চ র‍্যাঙ্কিং, ১২তম স্থান লাভ করে। সেইসাথে ‘অবতার: জলের পথ’, ‘ট্রান্সফরমারস: রাইজ অফ দ্য সুপার ওয়ারিয়র্স’ এবং ‘গার্ডিয়ানস অফ দ্য গার্ডিয়ানস ভলিউম ৩’ চীনের বক্স অফিস র‍্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ ৩০টিতে ছিলো। ২০২৪ সালে চীনে প্রবেশ করা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘গডজিলা বনাম কং ২: রাইজ অফ এন এম্পায়ার’, ‘ডেডপোল অ্যান্ড ওয়ালভেরিনে’, ‘ডেস্পিক্যাপল মি’ ইত্যাদি। এসব চলচ্চিত্র মোটামুটিভাবে সিক্যুয়াল হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে, যা দিয়ে দর্শকদের সতেজতা এবং উত্সাহকে উদ্দীপিত করা কঠিন।

এনবিসি ফাইন্যান্সিয়াল চ্যানেল উল্লেখ করেছে যে, চীনা দর্শকেরা স্টাইলাইজড হলিউডি চলচ্চিত্রের বর্ণনায় ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। হলিউড ইন্ডাস্ট্রি ম্যাগাজিন ‘বৈচিত্র্য’ মনে করে, চীনে হলিউড তার আগের সমৃদ্ধির পুনরাবৃত্তি করতে পারছে না। পুরানো মুভি’র ধারাবাহিকতা এবং বীর থিমযুক্ত মুভিগুলো চীনের বাজার নেতৃত্ব দিতে চাইলে তা খুব কঠিন হবে।

হলিউড চলচ্চিত্রের আকর্ষণ হ্রাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল চীনের স্থানীয় চলচ্চিত্র শিল্পের দ্রুত বিকাশে সৃষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

আমরা বলতে পারি, ১৯৯৪ সালে ‘দ্য ফিউজিটিভ’ মুভির কারণে চীনা চলচ্চিত্র আত্মনির্ভরশীলতা এবং চলচ্চিত্র শিল্পায়নের দ্রুত বিকাশের পথে যাত্রা করতে বাধ্য হয়। ৩০ বছরের সাধনায়, চীনা চলচ্চিত্র শিল্প অবশেষে অগ্রগতি হয়েছে, শুধুমাত্র চলচ্চিত্র বিষয়বস্তু এবং নির্মাণ স্তরের ক্ষেত্রেই নয়, বরং বিভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্রে দুর্দান্ত অগ্রগতি করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, কার্টুন, অ্যাকশন মুভি, সাসপেন্স মুভি এবং সায়েন্স ফিকশন মুভিসহ বিভিন্ন থিমযুক্ত মুভিগুলো জনপ্রিয় হচ্ছে।

আমেরিকান ফিল্ম রিসার্চ এবং কনসালটিং সংস্থা আর্টিসেংওয়ের প্রধান ল্যান্স বো উল্লেখ করেছেন যে, অনেক জনপ্রিয় চীনা চলচ্চিত্র বাস্তব গল্প বা সাধারণ মানুষের জীবন থেকে অভিযোজিত হয় এবং দর্শকদের সাথে সহজেই অনুরণিত হতে পারে। তিনি মনে করেন, চীনে সাম্প্রতিক অপরাধ বা সাসপেন্স বিষয়ক চলচ্চিত্রের উত্থান অপ্রত্যাশিত এবং বুদ্ধিদীপ্ত বর্ণনার বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা দর্শকদের সিনেমা দেখার আগ্রহকে উদ্দীপিত করেছে। বিপরীতে, হলিউডের অনেক সিক্যুয়াল সিনেমা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনুমানযোগ্য হয়ে ওঠে।

দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, চীনা চলচ্চিত্র অধ্যয়ন করা বিশেষজ্ঞ স্ট্যানলি রোজেন মনে করেন, চীনা চলচ্চিত্র এবং হলিউড চলচ্চিত্রের মধ্যে ব্যবধান দিন দিন কমে আসছে। চীনের চলচ্চিত্র শিল্প প্রথমে হলিউডকে শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করে, তারপর চীনের বাজারের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হলিউডকে পরাজিত করেছে।

তা ছাড়া, চীনা চলচ্চিত্রের বিকাশ এবং বৃদ্ধি চীনা দর্শকদের স্বদেশের সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের স্বীকৃতিকে প্রতিফলিত করে। ইউএস ‘ন্যাশনাল রিভিউ ম্যাগাজিন’ জানায় যে, চীনের চলচ্চিত্র শিল্প অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, সাংস্কৃতিক পার্থক্য আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।

কিছু আমেরিকান মিডিয়া চীনকে তথাকথিত ‘জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘দেশপ্রেম’ পরিবেশনে অভিযুক্ত করার জন্য রঙিন চশমা এবং দ্বৈত মানদণ্ড ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। একদিকে, তারা অসহায় বোধ করে যে, হলিউড ক্রমবর্ধমানভাবে লাভজনক চীনা বাজার হারাচ্ছে, তবে তাদের এটাও স্বীকার করতে হবে যে, চীনা চলচ্চিত্র শিল্প আরও উচ্চমানের চলচ্চিত্র তৈরি করছে যা দেশীয় দর্শকদের সাথে অনুরণিত হয়। আমেরিকান সাংস্কৃতিক কলামিস্ট স্টিফেন কেন্ট যেমন বলেছেন, ‘চীন সক্রিয়ভাবে তার সাংস্কৃতিক আখ্যানকে রূপ দিতে এবং তার জনগণকে একত্রিত করতে চাইছে।’

আমেরিকান গণমাধ্যম উল্লেখ করেছে যে, চীন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিদেশী বাজার হয়ে থাকবে, যা ভবিষ্যতে হলিউডকে ছেড়ে দেওয়া কঠিন হবে, তবে হলিউডকে এই বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হওয়ার জন্য তার মানসিকতা এবং কৌশলগুলোকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হতে পারে। তবে হলিউডের চীনা বাজারে ‘অসামান্য’ এই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি করা কঠিন হতে পারে বলে মার্কিন গণমাধ্যম মনে করে।

(লিলি/হাশিম/রুবি)