চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব
৮৫তম পর্বে যা থাকছে:
১। প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের সংরক্ষণে বিশেষ পদ্ধতি আবিষ্কার
২। বিশ্বের সবচেয়ে ছোট, হালকা সৌরশক্তি চালিত ড্রোন তৈরি
৩। সামুদ্রিক প্রাণীতে মাইক্রোপ্লাস্টিক
প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের সংরক্ষণে বিশেষ পদ্ধতি আবিষ্কার
জাদুঘরে উচ্চ আর্দ্রতা একটি গুরুতর সমস্যা। এর ফলে সংরক্ষিত প্রাচীন নিদর্শনগুলো মরিচা পড়া, কাগজ ও বই পচে যাওয়া এমনকি বস্তুর রংও ফিকে হয়ে যেতে পারে। সম্প্রতি জাদুঘরে উচ্চ আর্দ্রতার সমস্যাকে কার্যকরভাবে মোকাবেলার জন্য বিশেষ প্রযুক্তিগত পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন একদল চীনা বিজ্ঞানী। ফলে এখন থেকে গুরুত্বপূর্ণ এসব সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলো আরও ভালোভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।
দীর্ঘ ছয় বছর গবেষণার পর প্রযুক্তিগত এ পদ্ধতি আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছেন তারা। এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল আন্তর্জাতিক জার্নাল অফ হেরিটেজ সায়েন্সে প্রকাশ করা হয়েছে।
উত্তর-পশ্চিম চীনের কানসু প্রদেশের ছিনআন কাউন্টতে আবিষ্কৃত প্রায় ৮ হাজার থেকে ৪ হাজার ৮০০ বছর আগের তাতিওয়ান সাইটে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এখন পর্যন্ত চীনে আবিষ্কৃত বৃহত্তম এবং সর্বোত্তম সংরক্ষিত নিওলিথিক সাইটগুলোর একটি এটি। এই সাইটটি খুবই পুরানো এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন পাওয়া গেছে। কিন্তু সাইটটিকে সংরক্ষণ করার জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল, তা আসলে আরও সমস্যা তৈরি করেছিল। সাইটের ভিতরে আর্দ্রতা অনেক বেড়ে গিয়েছিল, যার ফলে নিদর্শনগুলো নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
এতে তুনহুয়াং একাডেমি এবং চীনের বিজ্ঞান একাডেমির অধিভুক্ত উত্তর-পশ্চিম ইন্সটিটিউট অফ ইকো-এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্সেস এর গবেষকরা অংশ নিয়েছিলেন।
৫ হাজার বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাস এবং ৪২০ বর্গমিটার অঞ্চলজুড়ে থাকা এ স্থানটিতে চীনের প্রাগৈতিহাসিক যুগের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে জটিলভাবে নির্মিত বৃহৎ আকারের বাড়িগুলোর দেখা পাওয়া যায়। ৫ হাজার বছর আগে চীনে মানুষ কীভাবে থাকত? সেই সময় মানুষ অনেক বড় এবং জটিল বাড়ি তৈরি করত। এমনই একটি বাড়ি আবিষ্কার করা হয়েছে, যা চীনের প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে বড় বাড়িগুলির মধ্যে একটি। এই বাড়িটি খুব বড়, প্রায় একটি ফুটবল মাঠের সমান জায়গা জুড়ে ছিল!
প্রাথমিক সংস্কার প্রচেষ্টায় গবেষকরা একটি সিল করা গ্লাসের প্রাচীর যুক্ত করেন। এই কাজ করার পর সেই জায়গার ভিতরে আর্দ্রতা অনেক বেড়ে গিয়েছে। আর এই আর্দ্রতার কারণে সেখানে অনেক রোগ জীবাণু বেড়ে উঠে। গবেষকরা এই সমস্যার সমাধানে বায়ুচলাচলের কার্যকারিতা এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিবর্তন মূল্যায়ন করার জন্য বেশ কিছু গবেষণা পরিচালনা করেন।
গবেষকরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন যে, সাইটের ভিতরে বাতাসের চলাচল বাড়িয়ে দিলে এই সমস্যা সমাধান করা যায়। তারা সাইটের ভিতরে কিছু পরিবর্তন করেছেন, যেমন নতুন ধরনের জানালা এবং ফ্যান ব্যবহার করেছেন। এর ফলে সাইটের ভিতরের আর্দ্রতা কমে গেছে এবং নিদর্শনগুলো আরও নিরাপদ হয়েছে।
গবেষণার পত্রের লেখক লিউ বেনলি জানান, এই গবেষণাটি মাটির নিদর্শনগুলোর আবদ্ধ প্রদর্শনী হলগুলোর অবনতি সমস্যা নিরসন করার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই গবেষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি পুরাতাত্ত্বিক সাইটগুলোকে সংরক্ষণ করার জন্য একটি নতুন উপায় দেখিয়েছে। এই গবেষণার ফলাফল অন্য সাইটগুলোতেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
বিশ্বের সবচেয়ে ছোট, হালকা সৌরশক্তি চালিত ড্রোন তৈরি
বিশ্বের সবচেয়ে ছোট এবং হালকা সৌরশক্তি চালিত ড্রোন তৈরি করেছেন চীনের গবেষকরা। তাদের এমন উদ্ভাবন ড্রোন প্রযুক্তিতে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম। দেশটির বেইহাং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক ড্রোনটি তৈরি করেছে।
কুলম্বফ্লাই নামের এই ড্রোনটির ওজন মাত্র ৪ দশমিক ২১ গ্রাম এবং পাখার দৈর্ঘ্য ২০ সেন্টিমিটার। এ প্রযুক্তির পূর্বের ড্রোনগুলো সীমিত সময়ের জন্য উড়তে পারতো কিন্তু কুলম্বফ্লাই সূর্য যতক্ষণ আলো দেয় ততক্ষণ উড়তে সক্ষম। এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা নেচার জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রচলিত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক মোটরের বিপরীতে ড্রোনটিতে ব্যবহার করা হয়েছে ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক মোটর। ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক মোটর ছোট ড্রোনকে উড্ডয়ন করাতে সক্ষম। এছাড়াও দলটি একটি হালকা বুস্ট কনভার্টার উদ্ভাবন করেছে যা ভোল্টেজকে ১০০ ভোল্টের নিচ থেকে ৯ হাজার ভোল্ট পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারে, এর স্টেপ-আপ অনুপাত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভাবিত অনুরূপ প্রযুক্তির চেয়ে ৯২ শতাংশ বেশি।
বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন থেকে এমন ছোট ছোট ড্রোন তৈরি করার চেষ্টা করছিলেন। তারা পোকা বা পাখির মতো উড়তে পারে এমন ড্রোন তৈরি নিয়ে গবেষণাও করছেন। এই ড্রোনটিকে তারা দিয়ে ছবি তোলা, দুর্যোগের সময় মানুষকে সাহায্য করতে পারবে এবং পরিবেশ পর্যবেক্ষণের কাজে ব্যবহার করবেত পারবেন।
বর্তমান প্রোটোটাইপ সীমিত ওজন বহন করতে পারলেও ভবিষ্যতে এর ক্ষমতা বাড়াতে চান গবেষক দলটি। তাদের পরবর্তী লক্ষ্য হলো মাত্র ৯ মিলিগ্রাম এবং ৮ সেন্টিমিটার দৈঘ্যের মিনি ড্রোন তৈরি।
এই ছোট সৌরশক্তি চালিত ড্রোনটি ড্রোন প্রযুক্তির ভবিষ্যতের জন্য এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
সামুদ্রিক প্রাণীতে মাইক্রোপ্লাস্টিক
সমুদ্রে ছড়ানো ছোট ছোট প্লাস্টিকের কণা সমুদ্রের জীববৈচিত্রের ব্যাপক ক্ষতি করছে। এই প্লাস্টিকের কণাগুলো আকারে খুব ছোট এবং জুপ্ল্যাঙ্কটনের খাবারের সঙ্গে মিলে যায়। আর জুপ্ল্যাঙ্কটনকে খেয়ে বড় প্রাণীরাও এই প্লাস্টিক খেয়ে ফেলছে। অর্থাৎ, খাদ্যশৃঙ্খলার নিচের স্তর থেকে শুরু করে উপরের স্তর পর্যন্ত সব জীবই এই প্লাস্টিকের দূষণের শিকার হচ্ছে। চীনের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এ চাঞ্চল্যকর তথ্য উন্মোচন করেছেন।
কিটোগ্ন্যাথ নামে এক ধরনের মাংসাশী জুপ্ল্যাঙ্কটন আছে, যারা সাধারণত অন্য এক ধরনের জুপ্ল্যাঙ্কটন কোপপড খেয়ে থাকে। এই কিটোগ্ন্যাথরা খাদ্য শৃঙ্খলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
চীনের বিজ্ঞানীরা দেখেছেন কিটোগ্ন্যাথও সূক্ষ্ম প্লাস্টিক খায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে কিটোগ্ন্যাথের শরীরে সূক্ষ্ম প্লাস্টিকের পরিমাণ কোপপডের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ, যেখানে কোপপড বেশি, সেখানে কিটোগ্ন্যাথের শরীরেও বেশি প্লাস্টিক পাওয়া যায়। এমনকি, কিটোগ্ন্যাথ যে কোপপডকে খায়, সেই কোপপডের পেটেও এই প্লাস্টিক পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি চীনের বিজ্ঞান একাডেমির সমুদ্রবিদ্যা ইনস্টিটিউটের চিয়াওচৌ বে স্টেশনের অধ্যাপক সুন সিয়াওসিয়ার নেতৃত্বে এক দল বিজ্ঞানী এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা করেছেন। গবেষণাটি জার্নাল অফ হ্যাজার্ডাস ম্যাটেরিয়ালস-এ প্রকাশ করা হয়েছে।
কিটোগ্ন্যাথ ঋতু বদলের সাথে সাথে প্লাস্টিক খায় কি না গবেষণায় বিজ্ঞানীরা সেটা বোঝার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা দেখেছেন যে এই প্রাণীগুলো সারা বছর প্রায় সমান পরিমাণ প্লাস্টিক খায়। যদিও কিটোগনাথের শরীরে প্লাস্টিকের পরিমাণ অন্য অনেক প্রাণীর তুলনায় কম। কিন্তু এই প্লাস্টিকগুলো পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, সেই হিসাবটা অনেক বেশি। অর্থাৎ, কিটোগনাথের শরীরে প্লাস্টিকের পরিমাণ কম হলেও, সেই প্লাস্টিকগুলো পরিবেশকে অনেক বেশি ক্ষতি করতে পারে।
গবেষকরা বিভিন্ন সমুদ্রে প্ল্যাঙ্কটন নমুনা সংগ্রহ করেছেন এবং পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, অনেক প্ল্যাঙ্কটনের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি রয়েছে। এটি নির্দেশ করে যে, মাইক্রোপ্লাস্টিক সরাসরি প্ল্যাঙ্কটন দ্বারা গ্রহণ করা হচ্ছে এবং খাদ্য শৃঙ্খলায় উপরের স্তরে স্থানান্তরিত হচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই গবেষণা আমাদের আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করবে যে সমুদ্রে ছড়ানো প্লাস্টিক প্রাণী তথা মানব শরীরে কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং কী ক্ষতি করে। সামুদ্রিক প্ল্যাঙ্কটন খাদ্য শৃঙ্খলায় মাইক্রোপ্লাস্টিক স্থানান্তর একটি গুরুতর পরিবেশগত সমস্যা। এই সমস্যা মোকাবেলায় প্লাস্টিক দূষণ কমানো এবং মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব সম্পর্কে আরও গবেষণা করা জরুরি।
প্ল্যাঙ্কটন হল ছোট ছোট জীবের একটি সমষ্টি যা স্বাধীনভাবে সাঁতার কাটতে পারে না এবং স্রোতের উপর নির্ভর করে। এরা সামুদ্রিক খাদ্য শৃঙ্খলার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং অনেক বড় জীবের খাদ্য হিসেবে কাজ করে।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।
প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার
অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল
স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- ফয়সল আবদুল্লাহ
সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী