সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের যুবক-যুবতীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ওপর অনেক গুরুত্ব দিয়েছে ও দিচ্ছে চীনের সরকার। স্কুলগুলোতে দরিদ্র পরিবারের বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা-ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি, অনেক ব্যক্তি ও বেসরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠানও দরিদ্র পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণে অর্থ-সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। আজকের অনুষ্ঠানে চীনের ইয়ুননান প্রদেশের খুনমিং শহরের সামরিক এলাকার অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লি ই ফেই’র গল্প তুলে ধরবো। টানা ৩২ বছর ধরে তিনি ৪২০ জন দরিদ্র শিক্ষার্থীর পড়াশোনার ব্যয় বহন করেছেন। চলতি বছর ৯৬ বছর বয়সী লি শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর গল্প এখন মানুষের মুখে মুখে।
১৯৯২ সাল থেকে টানা ৩২ বছর ধরে ইয়ুননান প্রদেশের ৪২০ জন সংখ্যালঘু জাতির দরিদ্র পরিবারের বাচ্চাদের অর্থ-সহায়তা দিয়েছেন জনাব লি ই ফেই। তিনি এই দীর্ঘ সময়ে তাদের পেছনে ব্যয় করেছেন ১১ লাখ ৪০ হাজার ইউয়ানেরও বেশি। ইয়ুননান আশা প্রকল্পের ইতিহাসে তিনি ব্যক্তিগতভাবে দীর্ঘতম সময় ধরে অর্থ-সহায়তা দিয়েছেন। চলতি বছরের পয়লা আগস্ট ইয়ুননান প্রদেশের চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রচার মন্ত্রণালয় তাঁকে ‘ইয়ুনলিং রোল মডেল’ পুরস্কারে ভূষিত করে।
এ খবর জেনে, জনাব লি’র সহায়তায় স্নাতক হয়েছে—এমন শিক্ষার্থীরা, ইয়ুননান প্রদেশের সরকার ও কিশোর উন্নয়ন তহবিলের কাছে একটি চিঠি পাঠায় এবং ৬ আগস্ট কয়েক জন শিক্ষার্থী-প্রতিনিধি হাসপাতালে গিয়ে জনাব লি-কে দেখা আসেন। চিঠিতে তাঁরা লি-কে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানান।
শিক্ষার্থী হান সু ছিন ইয়ুননান প্রদেশের পুয়ার শহরের মেংলিয়ান জেলার নালি উপজেলার মেয়ে। তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা বেশ দুর্বল ছিল। ২০০২ সালে প্রাথমিক স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী ছিল সে। তখন, জনাব লি’র কাছ থেকে আর্থিক-সহায়তা পায় হান সু ছিন। যখন উচ্চবিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী, তখন অনেকে তাকে লেখাপড়া বাদ দিয়ে চাকরি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। মেয়ে হান সু ছিন নিজের বিভ্রান্তির কথা জানিয়ে লি দাদাকে চিঠি লেখে। তখন লি জবাবি চিঠিতে তার পড়াশোনার দুর্বলতা বিশ্লেষণ করেন এবং কিছু বই পাঠান।
জনাব লি’র উত্সাহ ও পরামর্শে ইয়ুননান ঐতিহ্যিক চিকিত্সা ও মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আকুপাংচার বিভাগে ভর্তি হন এবং স্নাতক হওয়ার পর পুয়ার শহরের দুই নম্বর হাসপাতালে চাকরি পান হান সু ছিন। ২০১৭ সালের জুন মাসে তিনি ‘আশা প্রকল্পের স্বপ্ন পূরণ কার্যক্রমের’ বিশেষ পুরস্কার লাভ করেন। নিজের সাফল্য সম্পর্কে মেয়ে হান বলেন, ‘দাদা লি আমার বড় সমর্থন। তাঁর সহায়তায় আমি একজন চিকিত্সক হতে পেরেছি।’
মেয়ে হান সু ছিনের মতো ইয়ুননান ঐতিহ্যিক চিকিত্সা ও মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওয়াং কুও থাইও দাদা লি-কে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাতে চান। ছেলে ওয়াং কুও থাই’র জন্মস্থান তালি জেলার এরইউয়ান উপজেলার একটি ছোট গ্রামে। ৮ বছর আগে বন্যা ও ভূমিধসের কারণে তার জন্মস্থানের বাড়িঘর ও ধানক্ষেত সবই বিধ্বস্ত হয়। স্থানীয় সরকারের সহায়তায় গ্রামবাসীরা নতুন জীবন শুরু করেন। ২০২০ সালে ছেলে ওয়াং কুও থাই এবং তার বড় ভাই একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাঁরা চীন সরকারের ঋণ পাওয়ার পাশাপাশি, দাদা লি’র আর্থিক সহায়তাও পান।
প্রথমবারের মতো জনাব লি’র বাড়িতে তাঁকে দেখার সময় বেশ অবাক হয়েছিল ছেলে ওয়াং। কারণ, দাদা লি’র বাড়ির রুম ছোট আর আসবাবপত্রও পুরনো। যদিও তিনি প্রচুর টাকা দিয়ে অপরিচিত দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা দিয়ে থাকেন, তবে তাঁর নিজের জীবনযাপন বেশ সরল ও সহজ। কোনো ধনী মানুষের মতো নয়।
বস্তুত, অনেকে ছেলে ওয়াং’র সাথে একমত। কারণ, জনাব লি ই ফেই দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তায় ১১ লাখেরও বেশি ইউয়ান ব্যয় করেছেন। জনাব লি ই ফেই চীনের চিয়াংসু প্রদেশের উচিন শহরের লোক। ১৯৮৩ সালে অবসর নেওয়ার আগে, তিনি খুনমিং সামরিক এলাকার ব্যারাক বিভাগের উপমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯২ সালের ২৭ মে ‘পিপলস ডেইলি’ থেকে আশা প্রকল্পে শানতুং প্রদেশের তাপিয়েশান পাহাড়ের দরিদ্র পরিবারের মেয়ের পড়াশোনায় অর্থ সংগ্রহের খবর পড়েন তিনি। পরে তিনি চীনের কিশোর উন্নয়ন তহবিলে ২০০ ইউয়ান দান করেন।
একই বছর ইয়ুননান প্রদেশে ‘আশা প্রকল্প’ চালু হয়। স্থানীয় দরিদ্র শিশুদের সহায়তায় হানি জাতি ও ই জাতির অধ্যুষিত হংহ্য জেলা সর্বপ্রথমে ‘আশা প্রকল্প’ থেকে উপকৃত হয়। জেলার ৩০০০ জনেরও বেশি শিশু সংশ্লিষ্ট আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। লাংথি জেলার নিয়াংপু প্রাথমিক স্কুলের হানি জাতির ছেলে মা খ্য ইয়াং তাদের মধ্যে একজন। জনাব লি ই ফেই’র সহায়তায় ছেলে প্রাথমিক স্কুলের পড়াশোনা সম্পন্ন করে।
তখন থেকে তিনি প্রতিবছর নিজের বেতন থেকে দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা দিতে শুরু করেন এবং প্রত্যেক বাচ্চাকে চিঠি লিখতে থাকেন। চিঠিতে তাদের ফেরত চিঠির ডাকটিকিটও যুক্ত করতেন। এতে বাচ্চারা সহজে ফিরতি চিঠি লিখতে পারতো। চিঠিতে জনাব লি জানতেন বাচ্চাদের বিভিন্ন চাহিদার কথা। তিনি তাদের চাহিদা পূরণ করতেন। প্রত্যেক বাচ্চাকে নতুন ব্যাগ পাঠাতেন এবং ব্যাগের মধ্যে পেন্সিল কেস, নোটবুক, অভিধান, রুলারসহ বিভিন্ন স্টেশনারি দ্রব্য থাকতো।
বস্তুত, যুবকালে কাজের জন্য কটিদেশীয় মেরুদণ্ডের আঘাত পেয়েছেন জনাব লি ই ফেই। তখন দ্বিতীয় ডিগ্রি অক্ষম শ্রমিক হিসেবে তার নাম তালিকাভুক্ত হয়। টানা বহু বছর ধরে তিনি কেবল কটিদেশীয় সমর্থনের সহায়তায় হাঁটতেন। যখন ইয়ুননান প্রদেশের যুবক তহবিলের তদারকি কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করছিলেন, তখন মেরুদণ্ডের ব্যথা সহ্য করে ৩০টি জেলার ৮০টি উপজেলার ১৪৫টি গ্রামীণ স্কুল পরিদর্শন করেন তিনি।
ইয়ুননান প্রদেশের আশা প্রকল্পের অর্থ-সহায়তা পদ্ধতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, জনাব লি ই ফেই প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের অর্থ প্রদানের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সহায়তা দিতে শুরু করেন। ২০১১ সাল থেকে তিনি বিশেষভাবে ইয়ুননান চীনা চিকিত্সা ও মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছিলেন। জনাব লি-র বাড়িতে ৩টি বড় কাগজের বক্স রয়েছে, যাতে দরিদ্র শিক্ষার্থী ও তাদের পিতামাতাদের দেওয়া সহস্রাধিক চিঠি রয়েছে। জনাব লি প্রতিটি চিঠির নম্বর দিয়েছেন এবং তাঁর সহায়তাপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত পরিচয় রেকর্ড করেছেন। ইয়ুননান যুবক তহবিলের কর্মী চাও ক্য মান বলেন, ‘জনাব লি’র এসব চিঠির মাধ্যমে ইয়ুননান প্রদেশের আশা প্রকল্প উন্নয়নের ইতিহাস জানা যাবে।’
টানা ৩২ বছর ধরে যখন জনাব লি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের অর্থ-সাহায্য দিয়ে আসছেন। আর এ জন্য তার নিজের জীবনযাপন সহজ-সরল রাখতে হয়েছে। তিনি সবসময় একই পুরনো কাপড়চোপড় পরেন এবং তাঁর জুতা টানা ৭ থেকে ৮ বছরে পুরাতন হয়েছে। বাড়িতে বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও হিটিং ব্যবস্থার মেরামত পদ্ধতি শিখে নিয়েছেন তিনি। ফলে বাসায় যে সব জিনিসের মেরামত প্রয়োজন হয়, তিনি নিজেই তা মেরামত করেন। তাঁর ছেলে কারখানা থেকে বেকার হওয়ার পর স্থিতিশীল চাকরি খুঁজে পায়নি।
বৃদ্ধ হওয়ার পর জনাব লি’র শ্রবণশক্তি দুর্বল হয়ে যায়। হাসপাতালের ডাক্তাররা তাঁকে শ্রবণ-সহায়ক যন্ত্রপাতি কেনার পরামর্শ দেন। এ যন্ত্রপাতির দাম প্রায় ১০ হাজার ইউয়ান। এ কথা শুনে তিনি ডাক্তারের পরামর্শ উপেক্ষা করেন।
তবে, ছাত্রছাত্রীদের জন্য টাকা দেওয়ার সময় তিনি বেশ উদার। উচ্চবিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী পাই শু মার সাথে খুনমিংয়ে হাসপাতালে গিয়ে জনাব লি-কে দেখেন। প্রথমবারের মতো সাক্ষাতে জনাব লি তাদের ৪০০ ইউয়ান দেন। তাঁরা গ্রহণ করতে চাননি। তখন লি বলেন, খুনমিংয়ে আসার জন্য তোমাদের টিকিট কিনতে হয়েছে। এ জন্য এ টাকা দিলাম।
ছাত্রী লি চিয়াও প্রাথমিক স্কুল থেকে স্নাতক হওয়ার পর একদিন রাত ধরে বাসে বসে খুনমিংয়ে দাদা লি’র সাথে দেখা করতে আসে। তখন লি তাকে নিয়ে গ্রন্থাগারে গিয়েছেন এবং তার জন্য নতুন স্টেশনারি কিনেছেন।
ছাত্রী ছাও হং মেই মাধ্যমিক স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় তার জন্মগত হৃদরোগ সনাক্ত হয়। তখন তার পিতামাতা জনাব লি-কে চিঠি লেখেন এবং তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ শুনতে চান। লি এ খবরে জেনে ইউয়ুননান যুবক তহবিলের সাথে যোগাযোগ করেন। তাদের সহায়তায় ছাত্রী ছাওয়ের কুয়াংচৌ শহরের একটি হাসপাতালে বিনা খরচে হার্টের অপরেশন হয়। এ সম্পর্কে মেয়ে ছাও বলল, দাদা লি আমাকে দ্বিতীয়বারের মতো জীবন দিয়েছেন।
যখন শিক্ষার্থীরা জনাব লির বাড়িতে আসতেন, তখন তিনি সবসময় তাদের জন্য রান্না করতেন। লি ভালো করে রান্না করতে পারেন। সাধারণ শাকসবজি তাঁর হাতে বেশ সুস্বাদু খাবারে পরিণত হয়। তাঁর তৈরি ডাম্পলিং সবচেয়ে মজার খাবার। ছেলে মেয়েরা বলে, এ ডাম্পলিংয়ের সুগন্ধ আজীবন ভোলার নয়; খেতে বেশ মজার।
ইয়ুননান চীনা চিকিত্সা ও মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী তুয়ান ফেং মেই বলেন, দাদা লি মানচিত্র দেখতে পছন্দ করেন। কারণ, বয়স্ক হওয়ার পর তিনি আগের মতো দূরের জায়গায় ছাত্রছাত্রীদের দেখতে যেতে পারেন না। তাই, শুধু মানচিত্রের মাধ্যমে জানতে পারেন তাঁর সহায়তাপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের জন্মস্থান কোথায়।
হ্যনান চীনা চিকিত্সা ও মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ করা ডাক্তার লিয়াং তা ইয়ুন বলেন, দাদা লি’র বাড়ির ব্যালকনিতে দুটি সবুজ উদ্ভিদ আছে। তিনি ভালো করে এ উদ্ভিদের যত্ন নেন। ডাক্তার লিয়াং বলেন, জনাব লি সবসময় ছাত্রছাত্রীদের আন্তরিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত থাকতেন।
প্রায় ২ বছর আগে তিনি ইয়ুননান চীনা চিকিত্সা ও মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে মৃতদেহ দানকারী চুক্তি স্বাক্ষর করেন। মৃত্যুবরণের পর চিকিত্সাকাজে নিজের অবদান রাখতে চান তিনি। এ সম্পর্কে অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন, জনাব লি বেশ নিঃস্বার্থ ও সাহসী ব্যক্তি। তিনি যেন আলোর মতো অন্যদের জন্য ঠিক দিক-নির্দেশনা করেন।
এখন স্নাতক ছাত্রী ছাও হং মেই ইয়ুননান প্রদেশের ত্যহং তাই জাতি ও চিংপো জাতির অধ্যুষিত এলাকার ইংচিয়াং জেলার খাছাং উপজেলার সরকারে কাজ করছেন। তাঁর হার্টের অবস্থা মোটামুটি ভালো। তিনি বলেন, দাদা লি’র সহায়তায় আমি দ্বিতীয় জীবন পেয়েছি। আমি তাঁর মতো যথাযথ প্রচেষ্টা চালিয়ে অন্যদের সহায়তা দিতে চেষ্টা করছি।
(সুবর্ণা/আলিম/রুবি)