হাজার বছর আগের কাগজ, চা এবং নুডলস থেকে শুরু করে আজকের প্যাসেঞ্জার ড্রোন, কিংবা নতুন জ্বালানির গাড়ি। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে চলেছে চীনের শক্তিশালী আবিষ্কারের হাত ধরে। নানা সময়ে দারুণ সব আবিষ্কার করে আধুনিক সভ্যতার ভিত গড়ে দিয়েছে চীন। আর সেই সব আবিষ্কার নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন মেড ইন চায়না।
মেড ইন চায়নার চতুর্দশ পর্বে সাথে আছি আমি ফয়সল আবদুল্লাহ...আজকের পর্বে থাকছে চীনের আবিষ্কার ঘুড়ির কথা।
সেই কবে থেকেই আকাশে ওড়ার শখ মানুষের। কিন্তু কোনো জাদুবিদ্যায় তো কাজ হলো না। আবার পাখির মতো শরীরে নকল ডানা জুড়েও হলো না মুক্ত আকাশে ওড়া। তাই বলে, যে মানুষ পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তাদের কাছে আকাশটা অধরা থেকে যাবে, তা কি আর মেনে নেওয়া যায়। আকাশ জয়ের সেই অদম্য ইচ্ছে থেকেই আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে চৌ রাজবংশের সময় চীনা দার্শনিক মোচি ও চীনা স্থাপত্যবিদ্যার জনক লু বানের হাত ধরে চীনের আকাশে ওড়ে বিশ্বের প্রথম ঘুড়ি। আড়াই হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও ঘুড়ির সঙ্গে মানুষের আগ্রহের সুতোটা এখনও কেটে যায়নি।
কিন্তু চীনেই কেন ঘুড়ি আবিষ্কার হলো? উত্তরটা হলো প্রাচীন চীনেই ঘুড়ি বানানোর উপকরণগুলো আবিষ্কার হয়। ঘুড়ি তৈরিতে চীনারা ব্যবহার করেছিল চীনের তৈরি উন্নতমানের সিল্ক। আবার উচ্চ স্থিতিস্থাপকতা সম্পন্ন সিল্ক দিয়েই তৈরি হয়েছিল সেই ঘুড়ির দড়ি।
অবশ্য মোচি ও লু বান কিন্তু স্রেফ খেলনা হিসেবে কিংবা সময় কাটানোর জন্য ঘুড়ি আবিষ্কার করেননি। ঘুড়ি তৈরির একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল তাদের।
প্রাচীনকালের ঘুড়ির প্রথম কাজ ছিল বিপদের বার্তা পাঠানো। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় আকাশে ঘুড়ি দেখলেই বুঝতে হতো কেউ পানিতে আটকা পড়েছে বা কেউ বিপদে পড়েছে গভীর সাগরে।
ঘুড়ি ব্যবহার করে মাপা হতো একটি এলাকা থেকে আরেকটি এলাকার দূরত্ব। প্রাচীনকালে চীনের যোদ্ধারাও ঘুড়ি ব্যবহার করে বিভিন্ন অঞ্চলের দূরত্ব ও বাতাসের গতিপথ মাপতো। আবার একদল সেনার মধ্যে কেউ যেন দুর্গম অঞ্চলে পথ না হারায়, সেটাও নিশ্চিত করা হতো ঘুড়ির সাহায্যে।
আবার যেসব দুর্গম অঞ্চলে কোনো সেতু ছিল না, সেখানে ঘুড়ির সঙ্গে বেঁধে ছোটখাট জিনিসপত্র পাঠানো হতো এ পার থেকে ও পারে।
ঘুড়ি নিয়ে কয়েকটি মজার তথ্য জানাচ্ছেন শান্তা মারিয়া
· চীনে ছিং রাজবংশের সময় দুর্ভাগ্য তাড়াতে ঘুড়ি ওড়ানো হতো। তবে এর জন্য ঘুড়িটা ওড়ানোর পর হাতের দড়িটা ছেড়ে দেওয়া হতো। অর্থাৎ, ধরে নেওয়া হতো, অনেক উঁচুতে হেলেদুলে পড়ন্ত ঘুড়ির মতো নিজের দুর্ভাগ্যটাও দূরে কোথায় চলে যাবে।
· জোরালো বাতাসে বড় আকারে ঘুড়ি ধরে রাখা বেশ কঠিন কাজ। আর বাতাসের এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রাচীন চীনে এমন কিছু ঘুড়ি ছিল যাতে ভর করে মানুষও উপরের দিকে যেতে পারতো বেশ খানিকটা। ১২৮২ সালের দিকে চীনে ঠিক এমন একটা মনুষ্যবাহী ঘুড়ির দেখা পেয়েছিলেন ভেনেসিয়ান যুগের পর্যটক মার্কো পোলো।
· হান রাজবংশের সময় চীনা সেনাপ্রধান হান শিন একবার একটি শত্রু শিবিরের দিকে ঘুড়ি উড়িয়েছিলেন। দুর্গ থেকে শত্রুরা কত দূরে আছে সেটা মাপতেই ব্যবহার করেছিলেন ঘুড়ি। ঘুড়ির সঙ্গে বাঁধা দড়ি দিয়েই মাপা হয়েছিল ওই দূরত্ব।
· প্রতি বছর এপ্রিলের ৪ তারিখ চীনে পালিত হয় জনপ্রিয় ছিংমিং উৎসব। প্রিয়জনদের সমাধি পরিষ্কার করাই উৎসবের প্রধান কাজ। আর এ কাজের পরপরই অনেক চীনা ওড়াতে শুরু করেন ঘুড়ি। ছেলেবেলার মতো আনন্দ আর হই হুল্লোড়ে সময় কাটানোর রেওয়াজ হিসেবেই ছিংমিংয়ের দিন বিকেলে তারা সবাই ঘুড়ি ওড়ান।
ঘুড়িতে করে মানুষ উড়তে পারে না। কিন্তু রাইট ভাইয়েরা যখন প্রথম বিমানের নকশা করেন, তখন কিন্তু তারা বাকশো ঘুড়ি দেখেই তৈরি করেছিলেন উড়োজাহাজের মূল কাঠামোর নকশা।
তবে এ নিয়ে যে যাই বলুক না কেন, আকাশে ওড়া মানুষের তৈরি দীর্ঘতম বস্তুটি কিন্তু ঘুড়ি।
২০১৫ সালে, ছয় কিলোমিটার লম্বা ‘চীনা স্বপ্ন’ নামের একটি ড্রাগন ঘুড়ি উড়েছিল চীনের ছংছিংয়ের আকাশে। দীর্ঘ ঘুড়িটি ঠিকঠাক আকাশে উড়াল দিতেই ভেঙে যায় আগের গড়া গিনেজ বিশ্ব রেকর্ড।
চীনের ঘুড়ির রাজধানী বলা হয় শানতোংয়ের ওয়েইফাং শহরকে। ওই শহর থেকেই আনা হয়েছিল ঘুড়িটি। দুই বছর ধরে প্রায় এক লাখ ইউয়ান খরচ করে বানানো ঘুড়িটিকে আকাশে ওড়াতে তিনজন লোকের লেগেছিল প্রায় ছয় ঘণ্টা।
চীনে কত শত রকমের যে ঘুড়ি বানানো হয় তার শেষ নেই। আগের যুগে সিল্কের ভেতর থাকতো নানা কারুকাজ। আর এখন নাম না জানা অসংখ্য পোকা-মাকড়, পাখি, প্রাণী থেকে শুরু করে পৌরাণিক ড্রাগনও উড়তে থাকে ঘুড়ির বেশে।
চীন থেকে বেশ সময় নিয়েই বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়েছে ঘুড়ির কদর। প্রথম দিকে চীন থেকে ভারতর্ষ জানতে পারে ঘুড়ির কথা। পরে জাপানসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশও ঘুড়িকে নিজেদের সংস্কৃতিক উপাদান হিসেবে আপন করে নেয়।
চীনা ঘুড়ির কথা ইউরোপ জানতে পারে সবার শেষে। ত্রয়োদশ শতকের দিকে মার্কো পোলোর হাত ধরেই ইউরোপবাসীরা ঘুড়ির সন্ধান পায়। পরে আঠারোশ সালের দিকে সেই ঘুড়ি দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকান বিজ্ঞানীরা রীতিমতো গবেষণার কাজও শুরু করেন। ১৭৫২ সালে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন এই ঘুড়ির সাহায্যেই প্রমাণ করেছিলেন, বজ্রপাত হওয়ার জন্য বাতাসে বিদ্যুৎশক্তির তারতম্যই দায়ী। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছিল চীনের এই আবিষ্কারটি। সারভাইভাল রেডিও বা মিলিটারি রেডিও অ্যান্টেনাকে উঁচুতে তুলে ধরার কাজে ওড়ানো হয়েছিল ঘুড়ি।
বিশ্বের অন্যতম ঘুড়ি রপ্তানিকারক দেশ চীন। দেশটির ঘুড়ির রাজধানী ওয়েইফাংয়ে রয়েছে সবচেয়ে বেশি ঘুড়ির কারখানা। এখান থেকে বছরে রপ্তানি হয় কোটি কোটি ঘুড়ি।
ওয়েইফাংয়ে তৈরি হয় নানা ধরনের ঘুড়ি। ১০ ইউয়ান থেকে শুরু করে ১০ হাজার ইউয়ান দামের প্রিমিয়াম ঘুড়িও বিক্রি হয় এখানে। আর হাজার বছর আগের সোং রাজবংশের সময় থেকেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন হয়ে আসছে শানতোংয়ের শহরটিতে। এ বছরই সেখানে হয়ে গেল ২০ তম বিশ্ব ঘুড়ি চ্যাম্পিয়নশিপ। ৪৫টি দেশ থেকে ৪৬৫ জন এ প্রতিযোগিতায় উড়িয়েছিল পাঁচশর বেশি রকমের ঘুড়ি।
তবে উৎসব ও বাণিজ্যের চেয়েও বড় বিষয় হলো ওয়েইফাংয়ের ঘুড়িগুলো ধরে রেখেছে চীনের হাজার বছরের ঐতিহ্য। বাঁশ ও চীনা পেইন্টিং সমৃদ্ধ ঘুড়িগুলো স্থান পেয়েছে চীনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায়।
ঘুড়ি ওড়ানো যেমন মজার, তেমনি নিজে নিজে ঘুড়ি তৈরি করাটাও একটা বড় শিল্প বটে। সিল্কের চারকোণা বা ডায়মন্ড আকৃতির কাপড়ের সঙ্গে তীর ধনুকের আদলে মাপমতো দুটো বাঁশের কঞ্চি ভারসাম্য বজায় রেখে বেঁধে দিলেই হয়ে যায় ঘুড়ি। আর ওড়ানোর জন্য এখন নানা ধরনের সিনথেটিক নাইলনের দড়িও পাওয়া যায়।
সুপ্রিয় শ্রোতা আজকের মেড ইন চায়না এ পর্যন্তই। আগামী সপ্তাহে আবার আসবো চীনের সাড়া জাগানো আরেকটি আবিষ্কার নিয়ে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।
গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
অডিও সম্পাদনা: নাজমুল হক রাইয়ান
সার্বিক তত্ত্বাবধান: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী