‘মিং রাজবংশের এবড়োখেবড়ো প্রাচীরটি বনের প্রান্তে প্রসারিত হয়েছে।’ ভেনিস থেকে যাত্রা করে ইতালিয় রাইডার আলবার্তো ফিওরিন চিয়াইউকুয়েন গ্রেট ওয়ালে এসে পৌঁছেছেন। সেদিন তিনি তার ডায়েরিতে লিখেছেন: ‘এটি একটি রোমাঞ্চকর ঝলক।’
এ বছর পূর্ব এবং পশ্চিমজুড়ে বিখ্যাত ইতালীয় পরিব্রাজক মার্কো পোলোর ৭০০তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২৫ এপ্রিল, দুই ভেনিসিয়ান, আলবার্তো ফিওরিন এবং ডিনো ফাচিনেটি তাদের সাইকেলে যাত্রা শুরু করেন।
জলের শহর হিসেবে পরিচিত শীতল ঝর্ণার ভেনিস থেকে ইউরেশীয় মহাদেশ অতিক্রম করে, সোফিয়া, ইস্তাম্বুল, সমরকন্দ, আলমাটি এবং চীনের সিনচিয়াংয়ের মধ্য দিয়ে ১ আগস্ট গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে তারা বেইজিংয়ে পৌঁছান।
ফিওরিন এবং ফাচিনেটি’র লাল টি-শার্টে ইতালিয় ভাষায় ‘মার্কো পোলো এ পেদালি’ লেখা রয়েছে, যার অর্থ ‘সাইকেলে মার্কো পোলো’।
ফিওরিন সিনহুয়া বার্তা সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেন, ‘আমরা মার্কো পোলোর পথে হাঁটার মাধ্যমে এই মহান ভেনেসিয়ান পরিব্রাজককে শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছি। মার্কো পোলোর যাত্রা ছিল খুব ধীর; পায়ে, ঘোড়ার পিঠে বা গাড়িতে করে ভ্রমণ করেছিলেন। আমরা দৃশ্যাবলী দেখতে খুব ধীর গতির পরিবহন ব্যবহার করতে চেয়েছি, প্রতি মিটার রাস্তায় চলতে চেয়েছি, যাতে পথের দৃশ্য আমাদের চোখে ও হৃদয়ে অমলিন হয়ে থাকে।’
ফিওরিন মার্কো পোলোর জন্মস্থান ভেনিসে জন্মগ্রহণ করেন এবং ‘মার্কো পোলো’ নামে একটি হাইস্কুলে পড়ালেখা করেন। শৈশব থেকেই এই কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বের গল্প শুনে শুনে ফিওরিন গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। তাকে সবচে বেশি মুগ্ধ করে মার্কো পোলোর কৌতূহল এবং বিশ্বের নিরপেক্ষ অনুসন্ধান।
ফিওরিন বলেন, ‘আমি সবসময় আমার সাইকেল চালিয়ে মার্কো পোলোর মতো মনোমুগ্ধকর, প্রত্যন্ত এবং প্রাচীন ইতিহাসের পথ ধরে চীনে পৌঁছাতে চেয়েছি।’
একজন লেখক, ভ্রমণকারী এবং সাইক্লিং উত্সাহী হিসেবে, ফিওরিন প্রাচ্য ভ্রমণের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করছিলেন।
ফিওরিন শতাব্দী প্রাচীন ভেনিস সাইক্লিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, ফাচিনেটি এর সচিব। ভেনিসের প্রাচীনতম সাইক্লিং অনুরাগীদের সংগঠনগলোর মধ্যে অন্যতম একটি হিসেবে, অ্যাসোসিয়েশন প্রায়শই বিভিন্ন সাইক্লিং প্রতিযোগিতা এবং সাইক্লিং ভ্রমণ কার্যক্রমের আয়োজন করে। এর উদ্দেশ্য হলো এই পরিবেশ বান্ধব ও স্বাস্থ্যকর খেলাধুলা এবং ভ্রমণের উপায়কে প্রচার করা।
২০০১ সালে, তিনি নয়জন সাইক্লিস্টের সঙ্গে ভেনিস থেকে বেইজিং যাওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। কিন্তু ভেনিসের জেসোলো শহরে একটি দুর্ঘটনার কারণে তাকে প্রত্যাহার করতে হয়েছিল, যেখানে যাত্রা শুরু হয়েছিল।
এ বছর মার্কো পোলোর মৃত্যুর ৭০০তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে ফিওরিন তার ভালো বন্ধু ফাচিনেটিকে প্রস্তাব করেন, ‘আমরা সাইকেল চালিয়ে চীনে যাবো। ‘ঠিক আছে!’ ফিওরিনের কথা শোনার পর বিনা দ্বিধায় রাজি হয়ে গেলেন ফাচিনেটি।
কিন্তু ৬৪ বছর বয়সী ফিওরিন এবং ৬৭ বছর বয়সী ফাচিনেটির জন্য দূরত্ব এবং অসুবিধা অনেক বেশি।
ফিওরিন সাংবাদিকদের বলেন যে, ভ্রমণের আগে তারা যাত্রার অসুবিধা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন এবং তারা এ জন্য বাড়তি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, সমস্ত অসুবিধা কাটিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন।
অভিজ্ঞ দুই সাইক্লিস্ট মরুভূমিতে একটি অত্যন্ত কঠিন পথের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ফিওরিন স্মরণ করেন যে, ‘সিনচিয়াংয়ের শানশান জেলায় আমরা যখন সকাল ৭টায় যাত্রা শুরু করি, তখন তাপমাত্রা ইতোমধ্যে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গিয়েছিল এবং দিনের বেলা মাটির তাপমাত্রা এমনকি ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল। ৯টায় হ্যান্ডেলবারের থার্মোমিটারটি ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস নির্দেশ করে।’
১ জুলাই ফিওরিন তাঁর ভ্রমণের ডায়রিতে লিখেছিলেন, এখানে বিখ্যাত ‘ফ্লেমিং মাউন্টেন’ আছে, যা খুবই মনোমুগ্ধকর। একপাশে অত্যন্ত শুষ্ক শিখা পর্বত, এবং অন্য পাশে অন্তহীন আঙ্গুর বাগান। জলবায়ু শুষ্ক, তাপমাত্রার পার্থক্য বিশাল, এবং এখানে বিশ্ব-বিখ্যাত কিশমিশ উৎপন্ন হয়। ওইদিন দুপুর দেড়টায় তারা ৯৩ কিলোমিটার রাইড করে অবশেষে তাদের গন্তব্যে পৌঁছান।
প্রচণ্ড গরমের পাশাপাশি বাইক চালানোর সময় ভাষার প্রতিবন্ধকতাও একটি সমস্যা। এখন পর্যন্ত তারা একমাত্র চীনা ভাষায় কথা বলতে পারেন, তা হল ‘ধন্যবাদ’, ‘হ্যালো’ এবং ‘কোনও প্রয়োজন নেই’, এবং কখনও কখনও গুগোল অনুবাদের সহায়তা পাওয়াও সহজ নয়। তবে তারা চীনা জনগণের আতিথেয়তা এবং উদারতা অনুভব করেছেন পুরো যাত্রায়।
ফিওরিন মনে করেন, এটি তাকে মনে করিয়ে দেয় যে, মার্কো পোলো ১৭ বছর বয়সে ভেনিস থেকে যাত্রা করেছিলেন। সেই সময়ে তিনি ভাষা সম্পর্কে খুব কমই জানতেন, কিন্তু তার আন্তরিকতা তাকে বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং রীতিনীতি বুঝতে দেয় এবং অবশেষে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সভ্যতার বিনিময়ের বার্তাবাহক হয়ে ওঠেন।
ফিওরিন একটি উদাহরণ দিয়েছেন যে, ‘যখন স্থানীয়রা বুঝতে পারে যে, আপনি কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, তারা আপনাকে একটি সমাধান খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।’ একবার কানসুতে তাদের সাইকেল খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। তাই হোটেলের কর্মচারীরা প্রথমে একটি ট্যাক্সি ডাকতে সাহায্য করেছিলেন, তবে সাইকেলগুলো ধারন করতে সক্ষম নয় ট্যাক্সি। তাই তারা হোটেলের ডাইনিং কার ব্যবহার করে লাগেজ এবং সাইকেলগুলোকে কাছের স্টেশনে নিয়ে যান, ফলে তারা নির্বিঘ্নে লানচৌতে পৌঁছাতে পারেন।
ফিওরিন সেদিন তার ভ্রমণের ডায়েরিতে লিখেছিলেন, চারজন চীনা লোক সাইকেল চালানো দুই ইতালিয়কে সাহায্য করেছেন এবং আমাদের প্রতিদান প্রত্যাখ্যান করেছেন... এটি অভাবিত।
সিনচিয়াং থেকে বেইজিং পর্যন্ত, দু’জন মরুভূমির মধ্য দিয়ে গেছেন এবং অনেক উঁচু ভবন দেখেছেন। ফাচিনেটি প্রথমবারের মতো এই দূরবর্তী দেশে এসেছেন। তিনি মনে করেন, সাইকেল চালানোর সময় তিনি অনুভব করেন যে, চীনারা এত উদার, বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সহায়ক।
ফিওরিন প্রথমবার চীনে এসেছিলেন ১৯৮৭ সালে। ৩৭ বছর পর আবার চীনে এসে তিনি বললেন, চীনের বড় পরিবর্তন দেখে খুব অবাক হয়েছেন।
তিনি ক্রমাগত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ভ্রমণের ডায়েরি আপডেট করেন, ‘এখানে বাস, বৈদ্যুতিক সাইকেল, ট্রাইসাইকেল এবং প্রাইভেট কারসহ সর্বত্র বৈদ্যুতিক যানবাহন রয়েছে। আমি ইউরোপে এমন দৃশ্য কখনও দেখিনি।‘ নতুন অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেন ফিওরিন। ‘রাস্তাগুলো প্রশস্ত এবং পরিষ্কার, পার্কসহ গণ স্থাপনা সুশৃঙ্খল এবং পরিচ্ছন্ন। পরিবেশ সুরক্ষা সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে।’ সাইকেল চালানোর পথে চীনা রীতিনীতি এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য তার বর্ণনা বিপুল সংখ্যক নেটিজেনকে আকৃষ্ট করেছে।
ফিওরিন বলেন, ‘আসলে আসার আগে, আমি কল্পনা করতে পারিনি, চীন দেখতে কেমন হয়েছে। সাইকেলের মাধ্যমে বিশ্বকে পর্যবেক্ষণ করতে পারি এবং লেখার মাধ্যমে আমার পর্যবেক্ষণ রেকর্ড করতে চাই। মার্কো পোলোর মতো বিভিন্ন সংস্কৃতির দূত হতে চাই আমি।’
১ আগস্ট, বেইজিংয়ে পৌঁছান ফিওরিন এবং ফাচিনেটি। দুই ভেনিসিয় রাইডার সফলভাবে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন। ফিওরিন বলেন, ‘এই যাত্রা, এই দেশ আমাকে বারবার মুগ্ধ করেছে। আমার এ বিস্ময় কখনো শেষ হবে না।’
(লিলি/হাশিম/রুবি)