বিশ্বের চোখে চীনের অর্থনৈতিক উদ্ভাবনী শক্তি
2024-08-22 16:14:44

‘উদ্ভাবন হলো চীনের একটি মহান দেশ হওয়ারর মূল কারণ’, ‘চীন হল পশ্চিমা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণা ও উন্নয়নের পরীক্ষাগার’, ‘চীন অনুকরণ থেকে অতিক্রম করছে’... সাম্প্রতিক সময় ‘উদ্ভাবন’ অনেক বিদেশি গণমাধ্যমের কাছে চীনের অর্থনীতি নিয়ে একটি আলোচিত শব্দ হয়ে উঠেছে।

অর্থনৈতিক ‘অর্ধ-বার্ষিক প্রতিবেদনের’ তথ্য থেকে চীনের অর্থনীতির উদ্ভাবনের চালিকা শক্তি দেখা যায়।

চলতি বছরের প্রথমার্ধে, উচ্চ-প্রযুক্তি উত্পাদন শিল্পের অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারিত আকারের উপরে শিল্পের অতিরিক্ত মূল্যের ১৫.৮ শতাংশ, যা প্রথম ত্রৈমাসিক থেকে ০.৬ শতাংশ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে; ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট, সার্ভিস রোবট, নতুন শক্তির যান এবং সৌর কোষসহ বুদ্ধিমান সবুজ নতুন পণ্য সবার নজর কেড়েছে এবং উত্পাদনের পরিমাণ দুই-অঙ্কের বৃদ্ধি বজায় রেখে।

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তাসংস্থা তাস জানায়, ‘চীনের হাইটেক উৎপাদন শিল্পে দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। উচ্চ প্রযুক্তির ক্ষেত্রগুলোর উন্নয়ন হলো অর্থনৈতিক মানের স্তরের উন্নতির সবচেয়ে জোরালো প্রকাশ।’

ব্লুমবার্গ তাদের এক বিশ্লেষণে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, চীনের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) উচ্চ-প্রযুক্তি শিল্পের অনুপাত ২০১৮ সালে ১১ শতাংশ থেকে ২০২৬ সালের ১৯ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে। নতুন শক্তির যানবাহন, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং ফটোভোলটাইকসহ এ ‘তিনটি নতুন পণ্য’ যুক্ত করলে এই অনুপাত ২০২৬ সালে ২৩ শতাংশে প্রসারিত হবে।

সম্প্রতি অ্যাপলের প্রধান অপারেটিং অফিসার বা সিওও জেফ উইলিয়ামস সম্প্রতি চীনের শেনচেন শহরে পরিদর্শনকালে দেখেছেন যে, একসময় ম্যানুয়ালি পরিচালিত উত্পাদন লাইন এখন একটি ‘মানবহীন কারখানা’তে পরিণত হয়েছে, স্বয়ংক্রিয় নির্দেশিত যানবাহন এবং মোবাইল রোবটে চলছে সব কাজ। তিনি প্রশংসা করে বলেন, ‘গত ত্রিশ বছরের মধ্যে চীন প্রাথমিক উত্পাদন থেকে এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় উত্পাদন প্রযুক্তি আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছে, যা আমাকে ভীষণ অবাক করেছে। জাতিসংঘের প্রাক্তন উপ-মহাসচিব এরিক সোলহেইম, যিনি চীনের দশটিরও বেশি প্রদেশে ভ্রমণ করেছেন, বলেছেন যে, এক একটি প্রাণবন্ত কেস তাকে দেখায় যে, ডিজিটালাইজেশন এবং বুদ্ধিমত্তা দ্বারা চালিত একটি শিল্প আপগ্রেড হচ্ছে। চীন তার অতীত সাফল্যের উপর নির্ভর করে না, বরং ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং তার জনগণের উপকার করার জন্য উত্পাদনশীলতার বিকাশ অব্যাহত রাখে। এটি এই শতাব্দীতে চীনের সাফল্যের চাবিকাঠি হবে।

সার্বিকভাবে সংস্কার গভীরতর করা এবং চীনা-শৈলীর আধুনিকীকরণের প্রচারের বিষয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তে ব্যাপক উদ্ভাবনকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিঙ্গাপুরের ‘দ্য স্ট্রেটস টাইমস’ ওয়েবের এক প্রবন্ধে বলা হয়, চীন আগামী পাঁচ বছরে বড় ধরনের সংস্কারের পরিকল্পনা করেছে, এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনই তার দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গির চাবিকাঠি।

রোমানিয়ান অনুবাদক ইভান বউদুলা বলেন, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের প্রস্তাবিত ‘শিক্ষা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিভা ব্যবস্থার সমন্বিত এবং প্রচারিত সংস্কার’ তার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। মেধার মাধ্যমে দেশকে শক্তিশালী করার কৌশল এবং উদ্ভাবন-চালিত উন্নয়নের কৌশল বাস্তবায়ন করা দূরদর্শী বলে মনে করেন তিনি। তিনি মনে করেন, চীন প্রতিভা লালন পালন এবং শিক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। এই গুরুত্ব দেওয়া শুধুমাত্র দেশের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নে সাহায্য করে না, বরং বিশ্বকে মূল্যবান অভিজ্ঞতা প্রদান করে।

চীন বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে জোরালোভাবে প্রচার করছে এবং তার এ প্রচেষ্টা ধীরে ধীরে ফলপ্রসূ হচ্ছে, ফলে বিশ্ব উপকৃত হবে।

ব্রিটিশ ‘নেচার’ ম্যাগাজিন ওয়েবসাইটে সর্বশেষ ‘২০২৪ সালে প্রকৃতি সূচক – চীন’ দেখায় যে, গত বছর প্রকৃতি সূচক ডাটাবেস সম্প্রসারণের পর চীন এখনও রাঙ্কিংয়ের প্রথম স্থানে রয়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার ‘চোংআং ইবো’ ওয়েবসাইটের এক প্রবন্ধে এভাবে চীনের মূল্যায়ন করা হয় যে, ‘উচ্চ প্রযুক্তির শক্তির উত্থানের সাথে সাথে চীন একটি অনুসরণকারী হিসেবে তার ভাবমূর্তি ছিন্ন করেছে এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।’

চীনের উদ্ভাবনী শক্তি চীনে গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রে বিনিয়োগ করতে অনেক বহুজাতিক কোম্পানিকে আকৃষ্ট করেছে।

চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য দেখায় যে, ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত, বিদেশি বিনিয়োগকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণার ব্যয় ১৭৬.৩৬ বিলিয়ন ইউয়ান থেকে বেড়ে ৩৩৭.৭৪ বিলিয়ন ইউয়ানে দাঁড়িয়েছে, যা ৯১.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

ব্রিটিশ ‘ইকোনমিস্ট’ সাপ্তাহিক পত্রিকার ওয়েবসাইট সম্প্রতি একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে যে, বিশ্বের গবেষণা ও উন্নয়ন পরীক্ষাগার হিসাবে চীনের ভূমিকা দিন দিন জোরদার হচ্ছে। চীনে পশ্চিমা গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রগুলো উদ্ভাবনের মূল কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, যার ফলাফল বিশ্বজুড়ে বিক্রি হওয়া পণ্যগুলোতে ব্যবহৃত হচ্ছে।

অনেক বিদেশী অর্থনীতিবিদ এবং বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিতে, চীনের অতি-বৃহৎ বাজারের সুবিধা, সম্পূর্ণ শিল্প ও সরবরাহ চেইন ব্যবস্থা এবং বিপুল সংখ্যক উচ্চ শিক্ষিত শ্রমশক্তি পণ্য গবেষণা এবং উন্নয়ন থেকে উৎপাদন পর্যন্ত অন্যান্য দেশের তুলনায় চীনের সুবিধাগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি হয়েছে।

হ্যাং সেং ব্যাংকের চীনের প্রধান অর্থনীতিবিদ ওয়াং ড্যান মনে করেন যে, চীনের বাজারের আকার এবং শিল্প চেইনের সুবিধাগুলো দীর্ঘ সময়ের জন্য বিদ্যমান থাকবে এবং চীনের সরবরাহ চেইন এবং উদ্ভাবন ক্ষমতা সময়ের সাথে সাথে উন্নত এবং শক্তিশালী হবে। অ্যাপ্লিকেশনের ক্ষেত্রে চীনা বাজার হল বিশ্বের বৃহত্তম পরীক্ষামূলক ক্ষেত্র।

বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান টেমাসেক চায়না’র চেয়ারম্যান উ ইবিং মনে করেন, চীনা কোম্পানিগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে শিল্পচেইন ও মূল্য-চেইনের উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। তাদের শুধু বিশ্বমানের উৎপাদন দক্ষতাই আছে তা নয়, অনেক উদীয়মান ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক অধিকারও রয়েছে। উদ্ভাবন ক্ষমতার সুবিধাগুলো উত্থিত হতে চলেছে। অব্যাহতভাবে সংস্কারকে আরও গভীর করা চীনের অর্থনৈতিক উদ্ভাবন এবং উন্নয়নের জন্য একটি শক্তিশালী প্রেরণা প্রদান করবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

(লিলি/হাশিম/রুবি)