চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গ্রামীণ উন্নয়নে বুদ্ধিমান ও উদ্ভাবনী চেতনা কাজে লাগাচ্ছে
2024-08-19 15:00:46

চলতি বছরের জুলাই মাসে বেইজিং ফিংকু উপকন্ঠ এলাকার দুই শতাধিক গ্রামের উন্নয়নে সহস্রাধিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তাদের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগাতে শুরু করে। আজকের অনুষ্ঠানে চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গ্রামীণ উন্নয়নে নিজেদের উদ্ভাবন ও মেধার প্রয়োগ নিয়ে কিছু আলোচনা করবো।

চলতি বছরের জুলাই মাসে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১৯৩ জন ছাত্রছাত্রী বেইজিংয়ের উপকন্ঠ এলাকা ফিংকুর গ্রামে আসেন। শুরুর দিকে তারা আপেল গাছ বা আখরোট গাছের পার্থক্য বুঝতে পারেননি। তবে, এক মাসের মধ্যে গ্রামীণ জীবনের সাথে তাঁরা খাপ খাইয়ে নেন এবং রসুন ও মরিচের আকৃতিতে বিভিন্ন গ্রামে মজার মজার সব লোগো ডিজাইন করেন। যদিও এক মাস খুব বেশি সময় নয়, তবে চীনের ৬২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফিংকুর ২০০টিরও বেশি গ্রামের ভিন্ন ধরনের সমস্যা মোকাবিলায় প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এটি ছিল উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর ছাত্রছাত্রীদের প্রথম অনুশীলনের অভিজ্ঞতা।

চলতি বছর ফিংকু এলাকায় দ্বিতীয়বারের মতো  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপের সুযোগ দেওয়া হয়। এলাকার কর্মকর্তারা আশা করেন, এমন উদ্যোগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বুদ্ধি গ্রামের উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণে কাজে লাগানো যাবে।

ফিংকু এলাকায় আসার আগে চীনের উত্তরপূর্ব বনবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের মাস্টার্স শিক্ষার্থী ফু চিং খানিকটা হোমওয়ার্ক করেছেন। ফিংকু এলাকার সরকারি বিভাগ স্থানীয় বন অর্থনীতির উন্নয়নে আগ্রহী। তাই ফিংকু এলাকায় আসার পর শিক্ষার্থী ফু এবং তার সহপাঠীরা মাছাংইং জেলার ওয়াংক্যচুয়াং গ্রামে যান। গ্রামের কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে তারা স্থানীয় আবহাওয়া, বনাঞ্চলের উত্পন্ন কৃষিপণ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। সংশ্লিষ্ট গবেষণার ফলাফল অনুসারে, গ্রামের জন্য বনাঞ্চলে চাষাবাদের উপযোগী কৃষিপণ্য সুপারিশ করেন তাঁরা। এ কাজ সম্পর্কে ছাত্রী ফু বলেন, ‘গ্রামে আসার পর বই পড়ে শেখা জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগের সুযোগ পেয়েছি।’

অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মনে করেন, গ্রামের উন্নয়নের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তাঁরা বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনী ধারণা পেশ করেছেন। যেমন, ফিংকু এলাকা পিচ ফল বেশি উত্পন্ন হয়। তবে, জমি থেকে পিচ সংগ্রহের সময় অনেক পিচ নষ্ট হয়। সংগ্রহের সময় যদি পিচের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত  হয়, তখন এর বিক্রয়মূল্য কমে যায়। বেইজিং শিল্প ও ব্যবসা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াইন প্রক্রিয়াকরণ বিভাগের শিক্ষার্থী ওয়াং শুও এবং তার সহপাঠীরা বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পিচগুলো ওয়াইন তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। এখন ফিংকু এলাকায় কেবল তাজা পিচ বিক্রি হয় না, বরং পিচ ওয়াইন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

শিক্ষার্থীদের পরামর্শের ভিত্তিতে, ফিংকু এলাকার তাহুয়াশান জেলার দায়িত্বশীল ব্যক্তি স্থানীয় ওয়াইন কারখানার সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি ওয়াং শুও ও তার সহপাঠীদের পিচ থেকে ওয়াইন তৈরি বিষয়ে গবেষণার সুযোগ করে দেন। শিক্ষার্থীরা হলুদ পিচ বেছে নিয়ে ওয়াইন তৈরির চেষ্টা করে এবং তাতে সফলও হয়। ইন্টার্নশিপের সমাপনী অনুষ্ঠানে তারা নিজেদের তৈরি ওয়াইন বিচারকদের সামনে পেশও করে।

তা ছাড়া, বেইজিং সিনেমা একাডেমির দুটি কর্মদলের যৌথ প্রয়াসে এক মাসের মধ্যে ‘পিচ উপত্যকা ভ্রমণ’ শীর্ষক ভিডিওচিত্র নির্মিত হয়। তাঁরা ফিংকু এলাকার পিচ-বাগানের সাথে প্রাচীনকালের ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস ‘পশ্চিমে ভ্রমণ’-এ বর্ণিত স্বর্গের পিচ বাগানের তুলনা করেন। তাদের এ ভিডিওচিত্র  গ্রামবাসীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

বেইজিং কৃষি একাডেমির পর্যটন প্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ওয়াং ইয়ানের জন্মস্থান ফিংকু এলাকার পিইতুলেহ্য গ্রামে। তাই এবারের ইন্টার্নশিপে জন্মস্থানের উন্নয়নে নিজের অবদান রাখার সুযোগ পান তিনি। ক্লাসের সহপাঠীদের সাথে পরামর্শ করে তিনি গ্রামের কৃষিপণ্যের জন্য ব্র্যান্ড ডিজাইন করেন। এভাবে সবাই দ্রুত সংশ্লিষ্ট কৃষিপণ্যের সাথে পরিচিত হয় এবং এর বিক্রিও অনেক বাড়ে। তাঁরা রসুন ও মরিচের আকৃতিতে একটি লোগো ডিজাইন করেন। কারণ, এ গ্রামে রসুন ও মরিচের চাষাবাদ অনেক বেশি হয় এবং এর মানও বেশ ভালো।

ফিংকু এলাকার শানতুংচুয়াং জেলার ইয়ুচিশান গ্রামে একটি পরিত্যক্ত বিদ্যুতকেন্দ্রকে চারুকলা জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে, যা নেটিজেনদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। গত বছর বেইজিং কাপড়চোপড় একাডেমির শিক্ষার্থীদের ডিজাইনে এবং ফিংকু অঞ্চলের সরকারের যৌথ প্রয়াসে, এ বিদ্যুতকেন্দ্রটি চারুকলা জাদুঘর শিল্পকলা প্রদর্শনী আর শিল্পীদের ডিজাইন অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন তত্পরতা আয়োজন করে। এর মাধ্যমে ‘কফি প্লাস প্রদর্শনী প্লাস সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্লাস প্রদর্শনী’ শীর্ষক বহুমুখী উন্নয়ন বাস্তবায়িত হয়েছে। গ্রামের বিশেষ আমেজ এবং শিল্পকলা ভালোমতো মিলেমিশে গেছে। ফলে, এ জাদুঘর দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

ফিংকু এলাকার কাছে সিয়াক্যচুয়াং জেলার তালিংহৌ গ্রাম হ্যপেই প্রদেশ ও থিয়ানচিন মহানগরের কাছে অবস্থিত। এখানে সুস্বাদু খাবারের বাজার স্থাপন করে পর্যটকদের আকর্ষণ করা ছিল শিক্ষার্থীদের পরামর্শ। কারণ, ফিংকু এলাকার প্রাকৃতিক দৃশ্য বেশ সুন্দর। তাই, ছুটির দিনে অনেক পর্যটক শহর থেকে গাড়ি চালিয়ে এখানে ভ্রমণে আসেন। সাপ্তাহিক ছুটিতে এখানকার গ্রামীণ হোস্টেল ও হোটেল বেশ জনপ্রিয়। তবে, অনেক হোস্টেল বা হোটেলে খাবার পাওয়া যায় না। তালিংহৌ গ্রামের কর্মকর্তারা আশা করেন, সুস্বাদু খাবারের বাজার স্থাপনে আরও বেশি পর্যটক আকৃষ্ট হবে এবং তাদের দুই-এক রাতের অবস্থান গ্রামবাসীদের আয়ও দ্রুত বাড়াবে।

চীনের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছেং শাও নান মনে করেন, তালিংহৌ গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য দারুণ সুন্দর। তবে, অনেক ভালো হোস্টেলে রেঁস্তোরা নেই। তাই এখানে সুস্বাদু খাবারের বাজার বা রিসোর্ট স্থাপন করা জরুরি। তাদের প্রস্তাব ব্যাপক স্বীকৃতি পায়। চলতি বছর স্থানীয় ব্যাংক গ্রামের রিসোর্ট নির্মাণে ৫০ লাখ ইউয়ানের ঋণ দেবে।

 

দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলের হিপহপ শিক্ষকের গল্প

চীনের কুইচৌ প্রদেশের চেনফেং জেলার ৪ নম্বর প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক চাং হান ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে হিপকপ নৃত্য শিখতে ব্যস্ত। ৩ বছর আগে তিনি স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক হিসেবে এ স্কুলে আসেন। শিক্ষক চাংয়ের মতো আরও অনেক স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক কুইচৌ প্রদেশের বিভিন্ন স্কুলে কাজ করে থাকেন। তাদের মূল কাজ দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলের স্কুলে হিপহপসহ বিভিন্ন আধুনিক নৃত্য শেখানো। সিরেন শহরের একটি গ্রামাঞ্চলের স্কুলে নৃত্য শিক্ষক হিসেবে কাজ করে থাকেন শিক্ষক লং ছাও। শহরের কেন্দ্রীয় এলাকা থেকে এ গ্রামাঞ্চলের স্কুলের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। শিক্ষক লং ছাও বলেন, যখন প্রথমবারের মতো এ স্কুলে আসেন তখন ছাত্রছাত্রীরা দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখছিল। তবে, কয়েক ঘন্টার মধ্যেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

এ গ্রামীণ স্কুলে মোট ৬টি শ্রেণীতে শতাধিক ছাত্রছাত্রী রয়েছে। প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ নৃত্য দলে যোগ দিয়েছে। এ স্কুলে কোনো বিশেষ নৃত্যের ক্লাসরুম নেই। পরে শিক্ষক লংয়ের নৃত্য প্রতিষ্ঠান স্কুলের নৃত্যের ক্লাসরুমের বড় আয়না, কাঠের ফ্লোর স্থাপন করে।

স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক চাং হান এবং তাঁর সহকর্মীরা প্রতি সপ্তাহে কুইচৌ প্রদেশের ১০টিরও বেশি গ্রামীণ স্কুলে গিয়ে নৃত্যের ক্লাস নেন। তাঁর কর্মজীবন অনেক ব্যস্ততায় কাটে। তাই মেয়ের সাথে থাকার সময় খুবই কম পান। একবার তিনি মেয়ের সাথে বাসায় টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখছিলেন। তখন মেয়ে বলল, স্কুলের অনেক ছাত্রছাত্রী জানে তার মা গ্রামীণ স্কুলে নৃত্যের ক্লাস নেয়। এটি মেয়ের জন্য বেশ গর্বের ব্যাপার। তখন মা চাং হান মেয়ের কথা শুনে বেশ আনন্দিত হন।

শিক্ষক লং ছাও গ্রামীণ স্কুলের নৃত্যের ক্লাসও বেশ পছন্দ করেন। তিনি বলেন, “আমিও গ্রামে বড় হয়েছি। তাই গ্রামীণ স্কুলে বাচ্চাদের সাথে নৃত্য আমার জন্য আনন্দের ব্যাপার। তাদের হাসিমুখ দেখাও অনেক আনন্দের।”

২০১৮ সালের মে মাসে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি এবং চীনের নৃত্য শিল্পী পরিষদের যৌথ উদ্যোগে, গ্রামীণ স্কুলে হিপহপ নৃত্য শেখার কার্যক্রম শুরু হয়। তখন থেকে কুইচৌ প্রদেশে হিপহপ নৃত্যের স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক দল গঠিত হয়।

বর্তমানে কুইচৌ প্রদেশের ৫৭টি হিপহপ নৃত্য প্রতিষ্ঠানের ৪০০ জনেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবক সংশ্লিষ্ট নৃত্যের ক্লাস নিচ্ছেন এবং তারা গ্রামীণ স্কুল, আবাসিক কমিউনিটি আর জেলার স্কুলে গিয়ে ৩৮টি হিপহপ জনকল্যাণমূলক নৃত্য ক্লাসরুম নির্মাণ করেছেন। তাদের প্রচেষ্টায় গ্রামাঞ্চলের ১৫ হাজারেরও বেশি ছাত্রছাত্রী হিপহপ নৃত্য শেখার সুযোগ পেয়েছে।

কুইচৌ হিপহপ নৃত্য লীগের প্রধান হিসেবে শিক্ষক পান ছাং ফেই টানা ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হিপহপ নৃত্যের চর্চা করছেন। ১৮ বছর আগে তিনি নৃত্যের প্রশিক্ষণ ক্লাস চালু করেন। তাঁর অনেক ছাত্রছাত্রী স্নাতক হওয়ার পর হিপহপ নৃত্যের শিক্ষক বা শিল্পী হয়েছে। নতুন প্রজন্মের হিপহপ শিক্ষার্থীরা আরও বেশি জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।

শিক্ষক পান বেশ প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁর নেতৃত্বে কুইচৌ প্রদেশের অনেক হিপহপ নৃত্য প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ স্কুলে স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। টানা ৬ বছর ধরে শিক্ষক পান ছাং ফেই অনেক গ্রামীণ স্কুলে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক হিসেবে হিপহপ নৃত্য শিখিয়েছেন এবং কুইচৌ প্রদেশের বাইরে থেকে আসা হিপহপ শিক্ষকদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন।

২০২২ সালে কুইচৌ প্রদেশের হিপহপ যুবক প্রশিক্ষণ ক্লাস আয়োজিত হয়। ৫০ জন হিপহপ নৃত্যপ্রেমী প্রশিক্ষণ ক্লাসে অংশ নেওয়ার পর নৃত্য প্রদর্শন করেন। তাদের প্রদর্শনী আরও বেশি যুবক-যুবতীকে আকর্ষণ করেছে। ২০২৩ সাল থেকে হিপহপ নৃত্য ক্লাসে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ৫০ জন থেকে ১৯০ জনে উন্নীত হয়। আরো বেশি যুবক-যুবতী হিপহপ শেখা ও চর্চার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। স্নাতক হওয়ার পর তারাও স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক হিসেবে আরও বেশি গ্রামীণ স্কুলে নৃত্যের ক্লাস নেবে বলে আশা করা যায়।