প্যারিস অলিম্পিক গেমস সম্পর্কে আমরা যা মনে রাখি তা শুধুমাত্র মাথা ঘুরিয়ে দেয়া প্রতিযোগিতা নয়, বরং উষ্ণতা ও বন্ধুত্বের সঞ্চার, অধ্যবসায় এবং স্বপ্নের মিশ্রণও। এই মুহুর্তগুলো, জয় বা পরাজয় নির্বিশেষে, জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে, আমাদের অলিম্পিক চেতনার আসল রূপটি দেখতে দেয়। এটি অলিম্পিক নীতির একটি নিখুঁত ব্যাখ্যা – ‘দ্রুততর, উচ্চতর, আরো শক্তিশালী, আরও ঐক্যবদ্ধ’।
চীনা স্কেটবোর্ডার জেং হাও হাও এই অলিম্পিকের সর্বকনিষ্ঠ স্কেটার। অনেকে বলেন যে জেং হাও হাও ‘খেলাধুলার বয়সে’ অলিম্পিকে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু যারা এই ‘ছোট্ট বোন’টিকে চেনেন তারা জানেন যে, ‘স্কেটবোর্ড মহলের শিখরে পৌঁছবার’ স্বপ্ন পূরণের জন্য, তিনি তার বয়সকে অতিক্রম করে কত কঠোর পরিশ্রম করেছেন।
চীনা স্কেটবোর্ড দলের সদস্য জেং হাও হাও বলেছেন যে, বোর্ডের আঘাতে তার আঙুলের নখ ছিটকে গেছে এবং তার হাতে চিড় ধরেছে। আসলে তিনি ভয় পেয়েছিলেন যে, তিনি হয়তো অলিম্পিকে অংশ নিতে পারবেন না। তিনি ২০২৫ সালের জাতীয় গেমসের অপেক্ষায় আছেন, আরও ভালো পারফর্ম করার আশায়, এবং আরও কয়েক বার অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণ করার আশায়।
ভালোবাসার কারণে আরও বেশি পরিশ্রম। ১১ই আগস্ট জেং হাও হাও-এর ১২তম জন্মদিন এবং এই অলিম্পিক গেমসের অভিজ্ঞতা তার জন্য জন্মদিনের সেরা উপহার হতে পারে।
ভালোবাসার জন্য ধৈর্য ধরা এবং স্বপ্নের জন্য দৃঢ় হওয়া। ৭ আগস্ট- এবারের অলিম্পিক ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায়, চীনা ক্রীড়াবিদ লি ফা বিন চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে, চ্যাম্পিয়নের জন্য উল্লাস করার পাশাপাশি, একজনের হাসিতেও সবাই আন্দোলিত হয়েছিল। তিনি ব্রোঞ্জ পদক জয়ী মার্কিন ক্রীড়াবিদ হ্যাম্পটন মরিস।
২০ বছর বয়সী মরিস ভারোত্তোলন পছন্দ করেন এবং তিনি ছোটবেলা থেকেই তার বাবার সাথে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এই অলিম্পিকে, পুরুষদের ৬১ কেজি ভারোত্তোলন শ্রেণীতে তৃতীয় স্থান অর্জনের বিষয়টি নিশ্চিত করার পর, মরিস কোর্ট থেকে ছুটে আসেন এবং তার বাবা ও কোচকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন, আনন্দে কেঁদে ফেলেন। সেই মুহুর্তে, গভীর ভালোবাসার কারণে, পদক সোনা নাকি ব্রোঞ্জ, তা আর গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
স্বপ্ন অর্জনের আবেগ মানুষকে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার শক্তি দেয়। চীনের সিছুয়ান প্রদেশের লিয়াংশান অঞ্চলের ১৫ বছর বয়সী সার্ফার গার্ল ইয়াং সি ছি শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়েছেন এবং তার প্রথম অলিম্পিক গেমসে নারীদের শীর্ষ ১৬-এ উঠেছেন। এই প্রতিযোগিতাটিও প্রথমবার যাতে চীনা সার্ফাররা অলিম্পিক মঞ্চে উপস্থিত হয়েছেন। যদিও প্রতিটি পদক্ষেপ সমুদ্রের জলে ও ঘামে ভিজে গিয়েছিল, তবুও তিনি বলেছিলেন যে তার বাতাস এবং ঢেউকে নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছা এবং ঢেউ কেটে এগিয়ে যাবার শক্তি কখনো হারায়নি।
হাল ছাড়ছে না চীনা নারী হকি দলও। এই অলিম্পিকে, চীনা নারী হকি দল ১৬ বছর পর ফাইনালে ফিরেছে এবং আবার রৌপ্য পদক জিতেছে। ২০০৮ সালে শিখর ছোঁয়ার অভিজ্ঞতার পর, দলটি একবার খাদে পড়েছিল। ১৬ বছর ধরে, প্রতিদিন উচ্চ-তীব্রতার প্রশিক্ষণ এমন শক্তি যা প্রত্যেককে হাল ছেড়ে দেওয়া থেকে বিরত রাখে। এবং জয়ের আকাঙ্ক্ষায় পূর্ণ, ‘আইসবার্গ এবং তুষার পদ্ম’ খ্যাতির সাথে মেয়েদের এই দলটি অবশেষে তাদের কষ্ট সত্ত্বেও প্রস্ফুটিত হয়েছিল।
অলিম্পিক অঙ্গনে, গতি এবং আবেগের প্রতিযোগিতা, শক্তি এবং দক্ষতার প্রতিযোগিতা এবং ঐক্য ও বন্ধুত্বের আলো জ্বলে।
নারীদের ব্যাডমিন্টন একক সেমিফাইনালে, স্প্যানিশ খেলোয়াড় মারিন তার হাঁটুতে ব্যথার কারণে কোর্টে যেতে পারেননি এবং তার নাম প্রত্যাহার করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। পরের দিন, পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে, চীনা ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হ্য বিং চিয়াও, যিনি রৌপ্য পদক জিতেছিলেন, পদকটি তুলেছিলেন এবং তার অন্য হাতে একটি স্প্যানিশ অলিম্পিক কমিটির ব্যাজ তুলেছিলেন।
চীনা ব্যাডমিন্টন দলের সদস্য হ্য বিং চিয়াও বলেছেন যে সেমিফাইনালে দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্প্যানিশ খেলোয়াড় মারিন আহত হওয়ার পর তার হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল। যেহেতু মেরিন একজন খুব ভাল খেলোয়াড়, তিনি আশা করেন যে তিনি তার কঠোর পরিশ্রমকে ফাইনালে আরও ভাল করতে পারবেন এবং তিনি আশা করেন যে তিনি এটি দেখতে পারবেন এবং তার দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন।
পরে, যখন মেরিন তার সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিলেন, তিনি বিশেষভাবে লিখেছেন: জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার মুহুর্তে, মঞ্চে হ্য বিং চিয়াও যা করেছে তা তাকে সবচেয়ে বড় বন্ধুত্বের অনুভূতি দিয়েছে। তিনি সবসময়য় তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন।
জার্মান টেবিল টেনিস অভিজ্ঞ বোল, যিনি অলিম্পিক মঞ্চ থেকে বিদায় নিতে চলেছেন, বিশেষভাবে তার সাথে বহুবার প্রতিযোগিতায় মুখমুখি হওয়া চীনা খেলোয়াড় মা লং-এর সাথে একটি ছবি তুলেছেন।
পুরুষ ও নারীদের মিশ্র ৪*১০০-মিটার মেডলে রিলে রেসের পরে, প্রতিপক্ষ বিশেষভাবে জাং ইউ ফেই’কে আলিঙ্গন করতে এসেছিল, যে সদ্য চোট থেকে সেরে উঠেছে।
একটি হ্যান্ডবল ম্যাচ চলাকালীন, একজন অ্যাঙ্গোলান খেলোয়াড় মাটিতে পড়ে গিয়ে শট নেওয়ার পর উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না, তার প্রতিপক্ষ ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড় তাকে তুলে নিয়ে যায়।
তারা প্রতিপক্ষ এবং বন্ধু উভয়ই। বন্ধুত্বের প্রতিটি মুহূর্ত পদকের গঠন এবং রঙ অতিক্রম করে এবং অলিম্পিক চেতনার সবচেয়ে স্পর্শকাতর অর্থ প্রকাশ করে।
(স্বর্ণা/হাশিম/লিলি)