চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব
৮২তম পর্বে যা থাকছে:
১। মশা-বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রকৌশলগত সাফল্য অর্জন
২। চিকিৎসা বিজ্ঞোনে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ব্যবহার করবে চীন
৩। বিস্তারিত মানচিত্র ক্যান্সারের রক্তনালী নেটওয়ার্কের তৈরি
মশা-বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রকৌশলগত সাফল্য অর্জন
পুরুষ ও স্ত্রী মশাকে দক্ষতার সঙ্গে পৃথক করতে সক্ষম একটি অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র তৈরি করেছেন চীন-যুক্তরাষ্ট্রের এক দল বিজ্ঞানী। এটি মশা-বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে জৈব প্রযুক্তির ক্ষেত্রে একটি বিরাট সাফল্য।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি, চীনের চিনান ইউনিভার্সিটি এবং কুয়াংচৌ ওলবাকি বায়োটেক কোং লিমিটেড-এর গবেষকরা এ গবেষণাটি করেছেন। সম্প্রতি সায়েন্স রোবটিক্স আন্তর্জাতিক একাডেমিক জার্নালে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানব সৃষ্ট বিভিন্ন কারণে মশা-বাহিত প্রধান রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। চিনান ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক লি ইয়ংচুনের মতে, রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এই ডেঙ্গু লার্ভার উপর সীমিত প্রভাব ফেলে। পরিবেশ দূষণেও ভূমিকা রাখে।
এক্ষেত্রে জৈবিক নিয়ন্ত্রণের সুবিধা সম্পর্কে লি জানান, গবেষণায় দেখা গেছে কামড় না দেওয়া এবং রোগ বহন না করা পুরুষ মশাকে বন্য স্ত্রী মশার সঙ্গে প্রজনন করানোর মাধ্যমে বন্য মশার সংখ্যা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ইতোমধ্যেই এই নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি অনেক দেশে সফলভাবে বন্য রোগ বহনকারী মশার সংখ্যা কমিয়ে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব হ্রাস করেছে, তবে পুরুষ ও মহিলা মশাকে পৃথক করার সমস্যার কারণে এর ব্যাপক প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
কুয়াংচৌ ওলবাকি বায়োটেক কোং লিমিটেড-এর গবেষক কং চুনথানও জানান, তাদের দল স্বাধীনভাবে একটি অত্যাধুনিক যন্ত্র বিকাশ করেছে যা মশার পিপাকে দক্ষতার সাথে নাড়াতে, পৃথক করতে এবং সংগ্রহ করতে পারে। এই স্বয়ংক্রিয় পৃথককারী যন্ত্রটি একজন অপারেটরকে প্রতিদিন আট ঘন্টা এবং সপ্তাহে পাঁচ দিন কাজ করে ১৬ মিলিয়নেরও বেশি পুরুষ মশা পৃথক করতে সক্ষম করে, যা হাতে করে পৃথক করার তুলনায় ১৭ গুণ বেশি। ফলাফল দেখায় যে এই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটি ক্রান্তীয় মশা-বাহিত রোগ কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে।
এই যন্ত্রটি ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং ইতালি সহ ১৮টি দেশে বিক্রি হয়েছে।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
চিকিৎসা বিজ্ঞোনে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ব্যবহার করবে চীন
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং হলো কম্পিউটিংয়ের একটি নতুন ক্ষেত্র যা ক্লাসিকাল কম্পিউটারের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত ও জটিল সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম। এই প্রযুক্তিটি বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানেও ব্যবহৃত হচ্ছে। সম্প্রতি চীনা বিজ্ঞানীরা ছোট অণু ওষুধের বিকাশকে ত্বরান্বিত এবং ওষুধের প্যাটার্ন উন্নত করতে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন চীনের গবেষকরা।
পূর্ব চীনের আনহুই প্রদেশের বেংবু মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (বিএমইউ) হেফেই-ভিত্তিক অরিজিন কোয়ান্টাম কম্পিউটিং টেকনোলজি কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে। তারা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ওষুধ ডিজাইনের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে চায়। এই যৌথ উদ্যোগটি ওষুধ গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করতে পারে। কেননা কোয়ান্টাম কম্পিউটার বিশাল পরিমাণ ডেটা দ্রুত বিশ্লেষণ করতে পারে। এটি গবেষকদের বিদ্যমান ওষুধের উপর নতুন ডেটা প্রয়োগ করে নতুন ওষুধ আবিষ্কার করতে সাহায্য করবে। এছাড়া কোয়ান্টাম কম্পিউটার একটি ওষুধের একটি নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে কীভাবে কাজ করবে তা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। এটি গবেষকদের অনেক সময় এবং অর্থ সাশ্রয় করবে।
বিএমইউ স্কুল অফ ফার্মেসির গবেষক চাং ইসুয়ানের মতে, ছোট অণু ওষুধগুলো সহজেই কোষের ঝিল্লিতে প্রবেশ করতে পারে এবং যে কোনও স্থানে পৌঁছাতে পারে এবং তারা নির্দিষ্ট রোগের চিকিৎসায় সাহায্য করার জন্য কোষের ভেতরে থাকা বিশেষ প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হয়।
প্রথাগত পদ্ধতিতে ছোট অণু ড্রাগ ডিজাইন একটি জটিল এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। বিশাল সংখ্যক সম্ভাব্য অণুর মধ্য থেকে কার্যকরী ওষুধ খুঁজে বের করা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই প্রক্রিয়ায় যেসব বাধা রযেছে সেগুলো প্রায়শই একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তি ছোট অণু ওষুধ ডিজাইনের ক্ষেত্রে এসব বাধা অতিক্রম করতে পারে।
অরিজিন কোয়ান্টাম-এর এই ঘোষণা কম্পিউটার বিজ্ঞান ও ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। তাদের তৃতীয় প্রজন্মের সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম কম্পিউটার, অরিজিন উকং ব্যবহার করে ওষুধের অণুগুলোর বৈশিষ্ট্য ও পারস্পরিক ক্রিয়া নির্ণয়ের ক্ষমতা, ওষুধ আবিষ্কারের প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ নতুন এক পর্যায়ে উন্নিত করবে।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
ক্যান্সারের রক্তনালী নেটওয়ার্কের বিস্তারিত মানচিত্র তৈরি
বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের রক্তনালী নেটওয়ার্কের বিশ্বের সবচেয়ে বিস্তারিত মানচিত্র তৈরি করেছে একদল চীনা গবেষক। এই মানচিত্রের সাহায্যে ক্যান্সারের খুব প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হবে। কারণ, ক্যান্সার কোষগুলি রক্তনালী ব্যবহার করেই শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়া ক্যান্সার কোষগুলোকে রক্তনালী থেকে বিচ্ছিন্ন করার মতো নতুন ওষুধ তৈরি এবং বিভিন্ন ক্যান্সারের ধরনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন চিকিৎসা কৌশল উদ্ভাবন সম্ভব হবে। এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল নেচার জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে।
সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিকিং ইউনিয়ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা এ গবেষণাটি করেছেন। আর এ গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন ছোংছিং ইউনিভার্সিটি থ্রি গর্জেস হাসপাতালের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ইয়িন মিংচু। ‘টিউমার ভাস্কুলাচার অ্যাট সিঙ্গাল-সেল রেজোলিউশন’ শিরোনামের তাদের গবেষণাটি টিউমার অ্যানজিওজেনেসিস - নতুন রক্তনালী গঠনের জটিল প্রক্রিয়ার উপরও আলোকপাত করা হয়েছে, যা ক্লিনিকাল অনুশীলনে আরও কার্যকর অ্যান্টি-অ্যানজিওজেনিক থেরাপির পথ প্রশস্ত করেছে।
টিউমারের বৃদ্ধি এবং বেঁচে থাকার জন্য অ্যানজিওজেনেসিস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অ্যান্টি-অ্যানজিওজেনিক থেরাপিগুলোর লক্ষ্য হলো এই প্রক্রিয়াটিকে বাধাগ্রস্ত করে টিউমারের বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা। ক্যান্সার চিকিৎসার একটি পদ্ধতি হলো টিউমারকে বৃদ্ধি পেতে প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করা। টিউমার কোষগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং তাদের বেঁচে থাকার জন্য অনেক পরিমাণে শক্তি এবং পুষ্টির প্রয়োজন হয়। এই পদ্ধতিতে, টিউমার কোষগুলোতে এই খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়, যার ফলে তারা মারা যায় এবং টিউমারের বৃদ্ধি থামে।
গবেষক দলটি ৩১ ধরনের মানব ক্যান্সারের কোষকে খুবই বিস্তারিতভাবে পরীক্ষা করেছেন। তারা প্রতিটি কোষের মধ্যে থাকা আরএনএ (এক ধরনের জৈবিক অণু যা জিনের তথ্যকে প্রোটিনে রূপান্তর করতে সাহায্য করে) সিকোয়েন্স খুব নিখুঁতভাবে নির্ণয় করেছেন। এই বিশদ তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছেন যে, এই বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের কোষগুলোর মধ্যে কিছু কার্যকারিতা একই রকম, আবার কিছু কার্যকারিতা আলাদা আলাদা। এই বিষয়টির উপর নির্ভর করে চিকিৎসকরা রোগীদের জন্য আরও ভাল চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করতে পারবেন বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের।
এই গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে, গবেষকরা একাডেমিক, শিল্প এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রের লোকদের একসঙ্গে কাজ করতে উৎসাহিত করছেন। তাদের লক্ষ্য হলো প্রাথমিক ক্যান্সার সনাক্তকরণের জন্য নতুন সরঞ্জাম বিকাশ করা এবং প্রতিটি রোগীর জন্য সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি বেছে নেওয়ার পথ দেখানো।
ছোংছিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক লি সিন জানান, এই গবেষণার একটি সম্ভাব্য ব্যবহার হতে পারে এমন একটি পরীক্ষা কিট তৈরি করা, যা ক্যান্সারের শুরুর লক্ষণগুলো খুঁজে বের করতে পারে বা কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা একজন রোগীর জন্য উপযুক্ত কিনা তা আগেই বলে দিতে পারে।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।
প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার
অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল
স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- ফয়সল আবদুল্লাহ
সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী