চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব
৮১তম পর্বে যা থাকছে:
১। ভূমিকম্পের সতর্কীকরণ ব্যবস্থা চালু করছে চীন
২। স্থুলতা কিংবা মোটা না হওয়ার পেছনে দায়ী ব্যাকটেরিয়া
ভূমিকম্পের সতর্কীকরণ ব্যবস্থা চালু করছে চীন
দীর্ঘ পাঁচ বছরের নির্মাণকাজ শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ণ কার্যক্রম শুরু করেছে চীনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জাতীয় ভূমিকম্প সতর্কীকরণ প্রকল্প। এর ফলে জনবহুল ও ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চলের মানুষেরা ভূমিকম্পের মাত্র সাত সেকেন্ডের মধ্যে সতর্কতা পেয়ে যাবেন। সম্প্রতি দেশটির কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
'ন্যাশনাল আর্থকোয়েক ইনটেনসিটি র্যাপিড রিপোর্টিং অ্যান্ড আর্লি ওয়ার্নিং প্রজেক্ট' নামের এই ব্যবস্থাটি ভূমিকম্পের ধ্বংসাত্মক তরঙ্গ আগমনের ১০ সেকেন্ডের মধ্যে মানুষকে সতর্কতা জানাতে সক্ষম। বেইজিংয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে চীন আর্থকুয়েক নেটওয়ার্কস সেন্টারের পরিচালক লি ইয়ংলিন জানান।
দেশটিতে ২০১৮ সালে এই প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল, যার পরীক্ষামূলক অঞ্চল ছিল ইয়ুননান, সিছুয়ান এবং ফুচিয়ান প্রদেশ এবং বেইজিং-থিয়েনচিন-হেবেই। ২০২১ সাল থেকে এটি জনগণকে পরীক্ষামূলক সেবা দিতে শুরু করে। গত বৃহস্পতিবার এর নির্মাণ কাজের চূড়ান্ত পর্যায় সমাপ্ত হয়।
সমগ্র দেশকে এখন সতর্কতার নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। এর ফলে প্রধান সতর্কতা এলাকার মানুষ ভূমিকম্পের পর গড়ে মাত্র সাত সেকেন্ডের মধ্যে প্রথম সতর্কতা পেতে পারবে। সাধারণ সতর্কতা এলাকায় এই সময় ১০ থেকে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে হবে বলে তিনি জানান।
লি জানান, ভূমিকম্প ধরা পড়লে সতর্কীকরণ ব্যবস্থা প্রাথমিক, কম ধ্বংসাত্মক প্রাথমিক তরঙ্গের তথ্য ব্যবহার করে দ্রুত ভূমিকম্পের প্রধান সংকেতগুলো অনুমান করে এবং এর প্রভাবের পূর্বাভাস দেবে। এই তথ্যটি আরও ধ্বংসাত্মক দ্বিতীয় তরঙ্গ আগমনের আগেই সম্ভাব্য প্রভাবিত অঞ্চলে পাঠানো হয়।
উত্তর চীন, দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চল, দেশের উত্তর-দক্ষিণ ভূকম্পনীয় অঞ্চল এবং সিনচিয়াং উইগুর ও সিচাং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ১৯টি প্রাদেশিক বা স্থানীয় এলাকা প্রধান সতর্কতা অঞ্চলের অন্তর্গত।
কর্মকর্তা জানান, এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে জনগণ জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো জরুরি প্রতিক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে পারে, যেমন হাই স্পিড ট্রেন ব্রেক করা, গ্যাস পাইপলাইন বন্ধ করা, পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর বন্ধ করা এবং নিকটতম তলায় লিফট বন্ধ করা।
প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী মা ছিয়াং জানান, এই নেটওয়ার্কের আগে জনগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চীন আর্থকোয়েক নেটওয়ার্কস সেন্টারের দ্রুত ভূমিকম্প রিপোর্টের উপর নির্ভর করত, যা সাধারণত ভূমিকম্পের পর দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে প্রকাশিত হতো।
চীনের ভূমিকম্প প্রশাসনের মতে, দেশজুড়ে ১৫ হাজার ৮৯৯টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের একটি নেটওয়ার্কের সহায়তায় প্রাথমিক সতর্কতা ক্ষমতায় এই উন্নতি সম্ভব হয়েছে। চীন বর্তমানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের প্রাথমিক সতর্কতা দেওয়ার সক্ষমতা রাখা কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি।
তিনি জানান, প্রাথমিক সতর্কতা নেটওয়ার্কটি বৃহত্তর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, আরও সময়োচিত সতর্কতা দেয়, বেশি স্থিতিশীল এবং জাপান, মেক্সিকো এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের তুলনায় বেশি জনসংখ্যাকে সেবা দেয়। সামগ্রিকভাবে, এর কার্যকারিতা এবং পারফরম্যান্স বিশ্বমানের পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই ক্ষমতা সরকারকে উদ্ধার প্রচেষ্টা চালানো, দুর্যোগের ক্ষতি মূল্যায়ন এবং আরও অনেক কিছুর জন্য বৈজ্ঞানিক তথ্য সরবরাহ করে।
২০২২ সালে সিছূয়ান এবং ২০২৩ সালে কানসুতে ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্পের পর, প্রাথমিক সতর্কতার তথ্য কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্রভাবিত এলাকার লক্ষ লক্ষ ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল এবং দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
স্থুলতা কিংবা মোটা না হওয়ার পেছনে দায়ী ব্যাকটেরিয়া
প্রতিদিনের জীবনে আমরা দেখি, কেউ প্রচুর খেলেও স্লিম থাকে, কিন্তু অন্যরা খুব কম খেলেও মোটা হয়ে যান। এই বিষয়টির পেছনের কারণ হিসেবে 'মেগামোনাস' নামক একটি ব্যাকটেরিয়াকে দায়ী করেছেন চীনা গবেষকরা।
শাংহাই চিয়াও থোং বিশ্ববিদ্যালয়ের রুইচিন হাসপাতাল, বিজিআই রিসার্চ এবং বিজিআই জিনোমিক্সের অধীভুক্ত ইনস্টিটিউট অফ ইন্টেলিজেন্ট মেডিক্যাল রিসার্চের একদল গবেষক এ গবেষণাটি করেছেন।
সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল ‘সেল হোস্ট অ্যান্ড মাইক্রোব’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
চীনের স্থূল ব্যক্তিদের এক বিশাল গোষ্ঠীর উপর গবেষণা করে এই সম্ভাব্য স্থূলতা সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াটি শনাক্ত এবং তার পেছনের কারণ উদ্ঘাটন করা গেছে বলে জানিয়েছে চীন সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ডেইলি।
গবেষণায় দেখা গেছে পেটের প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে স্থূলতায় কোনও নির্দিষ্ট জীবাণু জড়িত এবং এর পেছনের কারণ সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
গবেষকরা ৬৩১ জন স্থূল এবং ৩৭৪ জন স্বাভাবিক ওজনের ব্যক্তির মলের নমুনা থেকে শটগান মেটাজিনোমিক সিকোয়েন্সিং করেছেন। এতে তারা স্থূল ব্যক্তিদের মধ্যে মেগামোনাস প্রভাবিত একটি জীবাণু ক্লাস্টারের উপস্থিতি খুঁজে পান।
গবেষকরা ১ হাজার ৫টি নমুনার মধ্যে তিনটি এন্টারোটাইপ-সদৃশ ক্লাস্টার শনাক্ত করেন - ব্যাকটেরয়েডস, প্রেভোটেলা এবং মেগামোনাস। মেগামোনাস সমৃদ্ধ ব্যক্তিরা অন্য দুই ধরনের তুলনায় বেশি শরীরের ভর সূচক এবং স্থূলতার হার বেশি দেখান।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মেগামোনাসের তিনটি প্রজাতিই শরীরের ওজন, কোমরের পরিধি এবং বিএমআই এর সাথে ইতিবাচক সম্পর্কিত। অতএব, গবেষক দল মেগামোনাস এবং স্থূলতার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক নির্ধারণ করেছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, কম জেনেটিক মেদবহুলতা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীতে মেগামোনাসের বিএমআই-এর উপর প্রভাব উচ্চ জেনেটিক মেদবহুলতা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
গবেষণার প্রথম লেখক এবং শাংহাই চিয়াও থোং বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন স্কুলের গবেষক উ চাও জানান, এই ফলাফলগুলো নির্দেশ করে যে, কম জেনেটিক মেদবহুলতা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য অন্ত্রের মাইক্রোবায়োটের মেদবহুলতার ঘটনায় প্রভাব উচ্চ জেনেটিক মেদবহুলতা ঝুঁকিপূর্ণদের তুলনায় বেশি।
স্থূলতা সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার কার্যপ্রক্রিয়া বুঝতে গবেষক দল বিভিন্ন মডেলের ওপর গবেষণা করেছেন, যেমন নির্দিষ্ট অনুজীব মুক্ত ইঁদুর, জীবাণুমুক্ত ইঁদুর এবং ছোট অন্ত্রের অর্গানয়েড ব্যবহার করে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, সাধারণ খাদ্য খাওয়ানো অণুজীব মুক্ত ইঁদুরের ওজনের উপর এম. রুপেলেনসিসের কোনও উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েনি, কিন্তু উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাদ্য খাওয়ানো ওজন বৃদ্ধি এবং চর্বি জমায় এটি উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত রেখেছে।
গবেষণা নিবন্ধের যৌথ লেখক এবং বিজিআই-এর গবেষক ইয়াং ফ্যাংমিং জানান, গবেষণায় মেগামোনাস এবং স্থূলতার মধ্যকার শক্তিশালী সম্পর্ক প্রকাশ পেয়েছে এবং মেগামোনাস কীভাবে স্থূলতা সৃষ্টি করে তার কার্যপ্রক্রিয়া স্পষ্ট হয়েছে।
গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন যে একটি ধরনের ব্যাকটেরিয়া, মেগামোনাস, স্থূলতা বাড়াতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়াটি ইনোসিটল নামক একটি পদার্থকে ভেঙে দেয়, যা আমাদের শরীরকে চর্বি শোষণ করতে বাধা দেয়। যখন এই ব্যাকটেরিয়াটি বেড়ে যায়, তখন ইনোসিটল কমে যায় এবং আমরা বেশি চর্বি শোষণ করি, ফলে ওজন বাড়তে পারে। গবেষকরা মনে করেন এই আবিষ্কার স্থূলতা চিকিৎসায় সাহায্য করতে পারে।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।
প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার
অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল
স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- ফয়সল আবদুল্লাহ
সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী