চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব
2024-07-15 18:28:57

চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব

৭৯তম পর্বে যা থাকছে:

১। মঙ্গল গ্রহের পরিবেশ সহ্য করতে সক্ষম উদ্ভিদ আবিষ্কার

২। হৃদস্পন্দসহ সকল স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য দেবে ঘড়ি

৩। মানুষের বিলুপ্ত প্রজাতি ডেনিসোভান

মঙ্গল গ্রহের পরিবেশ সহ্য করতে সক্ষম উদ্ভিদ আবিষ্কার

সিনট্রিচিয়া ক্যানিনার্ভিস নামে একটি মরুভূমির মস খুঁজে পেয়েছেন চীনা একাডেমি অফ সায়েন্সের সিনচিয়াং ইনস্টিটিউট অফ ইকোলজি অ্যান্ড জিওগ্রাফির বিজ্ঞানীরা। এই মসের বিশেষত্ব হলো এটি খরা, উচ্চ মাত্রার বিকিরণ এবং অতি শীতসহ মঙ্গল গ্রহের মতো পরিবেশ সহ্য করতে সক্ষম।

এ সংক্রান্ত গবেষণাার ফলাফল দ্য ইনোভেশন জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে। এটি তিব্বতের মালভূমি, মোজাবে মরুভূমি মতো জায়গাগুলোতে বছরের পর বছর ধরে স্থায়ী হিমশীল অবস্থায় টিকে থাকে।

গবেষকরা বলছেন, মরুভূমির এই মস বিরূপ পরিবেশে শুধু টিকে থাকে না বরং দ্রুত বেড়ে উঠে এবং সুস্থ পানিবিহীন স্থানে। এটি -৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর এবং -১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ৩০ দিন পর্যন্ত কাটিয়ে এবং গামা রশ্মির সংস্পর্শে আসার পরেও সাধারণ বৃদ্ধির অবস্থায় পুনর্জন্ম লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল।

গবেষক দলটি মঙ্গল গ্রহের অনুরূপ চাপ, তাপমাত্রা, গ্যাস এবং রোদের অতিবেগুনীসহ একটি পরিবেশ তৈরি করে। তারা দেখেছেন যে মস কেবল মঙ্গল গ্রহের মতো পরিবেশে টিকে থাকেনি তা, সাধারণ বৃদ্ধির অবস্থার মধ্যেও পুনর্জন্ম লাভ করেছে।

গবেষণার ফলাফলটি বেইজিংয়ের ইনস্টিটিউট অফ জিওলজি অ্যান্ড জিওফিজিকসেরর জ্যোতিঃজীববিজ্ঞানী লিন ওয়েই এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যিনি এটিকে "খুবই আকর্ষণীয় এবং মূল্যবান" হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

 একগুচ্ছ বিজ্ঞানমূলক পরীক্ষার মাধ্যমে গবেষক দলটি দেখিয়েছে যে সিএনট্রিকিয়া ক্যানিনার্ভিস একটি কৃত্রিম মঙ্গল গ্রহের পরিবেশে এক সপ্তাহ ধরে টিকে থাকতে পারে,

প্রধান লেখক, সিনচিয়াং ইনস্টিটিউট অফ ইকোলজি অ্যান্ড জিওগ্রাফির একজন কোষ বিজ্ঞানী লি চিয়াওশুয়াং জানান যে তিনি দুই দশক ধরে এই গাছটি নিয়ে গবেষণা করছেন।

 

লি এবং তার দল খরা-প্রতিরোধী জিনের খোঁজার কাজ করছিল, যা অন্যান্য গাছপালাকে খুব শুষ্ক পরিবেশে ভালোভাবে বাঁচতে সাহায্য করবে বলে তারা আশা করেছিল।

লি জানান, খুব কৌতূহলী হয়ে পড়েছিলাম এবং ফ্রিজারে এবং তারপর তরল নাইট্রোজেনের ট্যাঙ্কে রাখা শুরু করি। বিভিন্ন পরিবেশগত চাপের বিরুদ্ধে এত অসাধারণ প্রতিরোধ ক্ষমতা দেখানোর ক্ষেত্রে এটিই একমাত্র উদ্ভিদ হিসাবে সত্যিই স্বতন্ত্র ছিল।

লি ও তার দল মঙ্গল গ্রহের পরিবেশের অনুকরণে তৈরি করা যন্ত্রে শুকনো মস গাছগুলোকে এক, দুই, তিন এবং সাত দিন রেখে পরীক্ষা চালিয়েছেন। পরীক্ষার পর ৩০ দিনের মধ্যে এই গাছগুলো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছে। আর্দ্র গাছগুলোকেও একদিনের জন্য যন্ত্রের মধ্যে রাখা হয়েছিল এবং সেগুলোও বেঁচে ছিল, তবে শুকনো গাছগুলোর চেয়ে ধীরে ধীরে পুনর্জন্ম লাভ করে।

এর পরের ধাপে, লি এবং তার দল মহাকাশে কাবির নমুনা পাঠানোর সুযোগ খুঁজবেন, এমনকি চাঁদ বা মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠেও পাঠানোর চেষ্টা করবেন।

এই গবেষণাটি চরম পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষেত্রে জীবজগতের সহনশীলতার নতুন দৃষ্টান্ত, মহাকাশ অনুসন্ধান এবং বাসযোগ্য গ্রহ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং মানুষের দ্বারা মঙ্গল গ্রহে একটি নতুন বসতি স্থাপনে করতে অবদান রেখেছে।

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা:  ফয়সল আবদুল্লাহ

হৃদস্পন্দসহ সকল স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য দেবে ঘড়ি

পরিধানযোগ্য একটি স্মার্ট রিস্টওয়াচ বা হাতঘড়ি ডিজাইন করেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। মূলত এই ডিভাইসটিতে যুক্ত করা হয়েছে উন্নতসব ফিচার। এর মাধ্যমে সকল ধরনের স্বাস্থ্য ও ফিটনেসের তথ্য পাওয়া যাবে। বিশেষ করে হৃদস্পন্দ পর্যবেক্ষণ, স্টেপ কাউন্ট, ক্যালোরি হিসাব করা যাবে এই ঘড়ির মাধ্যমে। এই ঘড়ি ৯৫ শতাংশ সঠিক তথ্য প্রদানে সক্ষম।

চীনের বিজ্ঞান একাডেমির অধিভুক্ত হফেই ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্যাল সায়েন্সের বিজ্ঞানীরা এই রিস্টওয়াচটি ডিজাইন করেছেন। এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল ‘এসিএস ন্যানো  জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে।  এমন কি ব্যবহারকারীদের ইলেক্ট্রোলাইট পানীয়ের প্রয়োজন হলে সেটিও অবহিত করবে। শরীরের ঘামে অপরিহার্য রাসায়নিকগুলো পরিমাপ করতে পারে।

ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং গবেষক ইয়াং মেং জানান, মানুষের ঘামে ইলেক্ট্রোলাইট থাকে, প্রাথমিকভাবে পটাশিয়াম, সোডিয়াম এবং ক্যালসিয়াম। এই অত্যাবশ্যকীয় খনিজগুলোর ভারসাম্য পেশী কার্যক্রম, স্নায়ু স্বাস্থ্য এবং নিয়মিত হৃদস্পন্দে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘাম ঝরার ফলে পানি এবং ইলেক্ট্রোলাইট উভয়ই হ্রাস পায়। উদাহরণস্বরূপ, অতিরিক্ত পটাসিয়ামের ক্ষয়ের ফলে হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা এবং নিউরোমাসকুলার কার্যকলাপ প্রভাবিত হতে পারে। ঠিক  একইভাবে সোডিয়াম আয়নের ঘাটতির ফলে ক্লান্তি, মাথা ঘোরা এবং পেশী সংকোচন হতে পারে। এ কারণেই এমন ফিচার যুক্ত করা হয়েছে।

ইয়াংয়ের দলটির ডিজাইন করা রিস্টওয়াচটি ত্বক থেকে ঘাম সংগ্রহ করে এবং আয়ন-সংবেদনশীল মেমব্রেনসহ একটি সেন্সর চিপ ব্যবহার করে এটিকে রিয়েল টাইমে বিশ্লেষণ করে। ঘাম যন্ত্রটিতে প্রবেশ করলে এটি মেমব্রেনের সংস্পর্শে আসে যাতে যথাক্রমে সোডিয়াম, পটাসিয়াম এবং ক্যালসিয়ামের মাত্রা পরিমাপের জন্য তিনটি নালিকা থাকে। সাধারণ ইলেক্ট্রোলাইট পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে গিয়ে নমুনা দিতে হতো। নতুন হাতঘড়িতে ইলেক্ট্রোলাইট পরিমাপের জন্য কোনও নমুনা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

যদিও ঘাম সেন্সর আবিষ্কারের ক্ষেত্রে প্রথম নন এই বিজ্ঞানীরা, তবে চীনা গবেষকরা দীর্ঘস্থায়ী ও নির্ভরযোগ্যতার জন্য রিস্টওয়াচের দৃঢ় ইন্টারফেসের উপর জোর দিয়েছেন।

হফেই ইন্সটিটিউটের অধীনস্থ ইন্সটিটিউট অফ সলিড স্টেট ফিজিক্সের প্রধান গবেষক হুয়াং সিংচিউ জানান, এটি ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে মানব ঘামের তিনটি আয়ন পর্যবেক্ষণ করে।

গবেষণা দলটির পরবর্তী লক্ষ্য হলো গ্লুকোজ এবং ক্লোরাইড আয়নগুলোর মতো আরও শারীরবৃত্তীয় রাসায়নিকের তথ্য পর্যবেক্ষণ সেন্সর ডিজাইন করা।

গবেষকরা বলছেন, বাজারে জনপ্রিয় ফিটনেস ঘড়িগুলোর তুলনায়, তাদের ডিজাইন করা

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা:  ফয়সল আবদুল্লাহ

মানুষের বিলুপ্ত প্রজাতি ডেনিসোভান

মানুষের একটি বিলুপ্ত প্রজাতি হলো ডেনিসোভান। এরা নিম্ন ও মধ্য প্যালিওলিথিক যুগে এশিয়াজুড়ে বাস করত। ডেনিসোভানরা মূলত হোমো ইরেক্টাস এবং নিয়ান্ডারথালদের চেয়ে আলাদা একটি বিলুপ্ত হোমিনিন প্রজাতি। প্রায় ৪ লাখ বছর আগে এশিয়ায় বিবর্তিত হয় এবং প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়েছিল। সম্প্রতি এক গবেষণায় মানুষের এই প্রজাতির আচরণ এবং তারা কীভাবে বিভিন্ন পরিবেশে টিকে ছিল এসব তথ্য উন্মোচন করেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা।

এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল ‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে। লানচৌ বিশ্ববিদ্যালয়, চীনা একাডেমি অফ সায়েন্সেসের অধীন সিচাং মালভূমি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বিশ্বের আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে এই গবেষণা পরিচালনা করেছে।

সিচাং মালভূমি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ছেন ফাহুর নেতৃত্বে গবেষক দলটি কানসু প্রদেশের সিয়াহ্য কাউন্টির অবস্থিত বাইশিয়া করস্ট গুহা সাইটে পাওয়া একটি নিম্ন চোয়ালের হাড়ের জীবাশ্ম নিয়েও গবেষণা চালিয়েছে। এই জীবাশ্মটি ডেনিসোভানদের বলে নিশ্চিত করা হয়।

গবেষকরা প্রায় ৪৮ হাজার থেকে ৩২ হাজার বছর আগের এক ডেনিসোভানের পাঁজরের হাড় নিয়ে গবেষণা করেছেন। এর মাধ্যমে তারা পূর্ব এশিয়ার মধ্য প্লাইস্টোসিন এবং পরবর্তী প্লাইস্টোসিন যুগের পরিবর্তনশীল পরিবেশে ডেনিসোভানদের খাপ খাওয়ানোর কৌশল সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।

গবেষণাপত্রে বলা হয়, ডেনিসোভানরা হলো বিলুপ্ত এক প্রাচীন মানবগোষ্ঠী। তাদের নামকরণ করা হয় সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহার নামানুসারে, যেখানে প্রথমে তাদের দেখা যায়। গবেষক দলের সদস্য লানচৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাং তোংচু জানান, ডেনিসোভানদের জিনগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে আধুনিক ওশেনিয়া, পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া এবং আমেরিকার জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে।

চাং তোংচুর মতে, নতুন পাঁজরের হাড়ের পাশাপাশি গবেষকরা ২০ টিরও বেশি প্রজাতির প্রাণী শনাক্ত করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছে তৃণভোজী যেমন- বন্য ইয়াক এবং হায়েনা, তুষার চিতা এবং তিব্বতি শিয়াল সেইসঙ্গে মালভূমি খরগোশ এবং মারমোটের মতো ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী।

পূর্বের প্রত্নতাত্ত্বিক খননে ২ হাজার ৫০০টিরও বেশি প্রাণী হাড় উদ্ধার করা হয়েছে। পরবর্তী জীবপ্রত্নতাত্ত্বিক এবং প্রোটিওমিক বিশ্লেষণ গবেষকদের আরও তথ্য পেতে সাহায্য করেছে।

গবেষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে, ডেনিসোভানরা গুহায় প্রাণী সম্পদ প্রক্রিয়াকরণ এবং ভোগে নিযুক্ত ছিল, যার মধ্যে চামড়া ছাড়ানো, টুকরো টুকরো করা এবং মাংস ছাড়ানো অন্যতম। এছাড়া, হাড়গুরো সরঞ্জাম উত্পাদনের জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করতো।

ছেন জানান, গুহায় ডেনিসোভানরা বিভিন্ন প্রাণী সম্পদের সম্পূর্ণ ব্যবহার করেছিল, যা সম্ভবত তাদের কমপক্ষে ১ লাখ বছর ধরে মালভূমিতে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছিল।

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা:  ফয়সল আবদুল্লাহ

নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- ফয়সল আবদুল্লাহ

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী