বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর: বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের এক নতুন অধ্যায় রচিত হবে
2024-07-15 19:32:46

দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বিস্তৃত চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে স্থায়ী সাংস্কৃতিক বিনিময় দীর্ঘস্থায়ী আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বের প্রচারে এই ধরনের মিথস্ক্রিয়াগুলির গুরুত্ব তুলে ধরে। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগ এবং চীন-বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর এই বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করেছে। তবে, এটি স্বীকার করা গুরুত্বপূর্ণ যে, এই বিনিময়গুলি অর্থনৈতিক মিথস্ক্রিয়াকে আরও বড় করার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রভাবশালী।

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে গভীর ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে, যা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। দুই দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৫ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু করে এবং তারপর থেকে তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা দুই দেশকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে। চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে উঠেছে এবং দুই দেশ এখন একটি সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব উপভোগ করছে। দুই দেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, যৌথ উদ্যোগ, সংযোগ প্রকল্প এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়কে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই প্রতিশ্রুতি ২০০৫, ২০১০, ২০১৪ এবং ২০১৬ সাল-সহ বেশ কয়েকটি যৌথ বিবৃতিতে প্রতিফলিত হয়েছে।

বাংলাদেশ চীনা সংস্কৃতিকে খুব সম্মান করে ও প্রশংসা করে এবং কনফুসিয়ানিজম, ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধ, খেলাধুলা, খাদ্য এবং শাস্ত্রীয় সাহিত্যের মতো ঐতিহ্যবাহী উপাদানকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। চীনের আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া জোরদার হওয়ার সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং সমসাময়িক শিল্প সহ চীনের আধুনিক সংস্কৃতিও বাংলাদেশে প্রবল আগ্রহ জাগিয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ চীনের সাথে সাংস্কৃতিক বিনিময় আরও জোরদার করা, পারস্পরিক বোঝাপড়া বৃদ্ধি এবং অভিন্ন উন্নয়নের প্রসার আশা করে।

সাংস্কৃতিক বিনিময় ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে এবং বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চীনের প্রস্তাবিত "বৈশ্বিক সভ্যতা উদ্যোগ" এর প্রতিক্রিয়ায়, এই বিনিময়গুলি চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে পারস্পরিক শিক্ষা ও সহযোগিতা ব্যাপকভাবে উন্নীত করতে পারে।

২০২৩ সালের ১৫ মার্চ, সাধারণ সম্পাদক সি চিন পিং চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এবং বিশ্ব রাজনৈতিক পার্টিগুলির মধ্যে উচ্চ-স্তরের সংলাপে "বিশ্ব সভ্যতা উদ্যোগ" প্রস্তাব করেছিলেন। এটি হল "বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ" এবং "বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ" এরপর নতুন যুগে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চীনের আরেকটি বড় অবদান। উদ্যোগটি প্রস্তাবনার পর থেকে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে।

এবার প্রধানমন্ত্রী হাসিনা’র সফর দুই দেশের জন্য একে অপরের কাছ থেকে শেখার একটি চমত্কার সুযোগ করে দিয়েছে। তাদের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করেছে এবং আরও আন্তঃসংযুক্ত ও সুরেলা বিশ্ব সমাজ গঠনে অবদান রেখেছে।

শিক্ষাখাতে বর্তমানে চীনে প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছে। দু’টি কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট এবং একটি কনফুসিয়াস ক্লাসরুম গত বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৩ হাজার মানুষকে শিক্ষা দিয়েছে। বাংলাদেশ জুড়ে চীনা ভাষা শেখা খুব জনপ্রিয় রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চায়না রিসার্চ সেন্টার দুই দেশের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এবং একাডেমিক সার্কেলের মধ্যে সহযোগিতার জন্য একটি নতুন এবং বৃহত্তর প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে। এই সফরের পর বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা চীনে পড়ার জন্য আরও বেশি বৃত্তি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে চীনা শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের অনন্য শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বোঝার আরও সুযোগ পাবে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, চীন ও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী হয়েছে, এবং আরও বেশি সংখ্যক যৌথ প্রশিক্ষণ কর্মসূচী শুরু হবে।

সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান নিশ্চয়ই আরও বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীতে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য, সঙ্গীত এবং সাহিত্যকর্ম সহ বাংলাদেশের অনন্য শৈল্পিক অভিব্যক্তিগুলি চীনে আরও বেশি প্রদর্শন করা হবে, যা তার অনন্য আকর্ষণে চীনা দর্শকদের আকর্ষণ করবে। একইভাবে, চীনা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যেমন পিকিং অপেরা, ক্যালিগ্রাফি এবং মার্শাল আর্টও বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা লাভ করবে এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কাঠামোকে সমৃদ্ধ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

পর্যটন আরেকটি মূল উপাদান। পর্যটনের প্রচার জোরদার করা, ভিসা পদ্ধতি সহজীকরণ এবং অন্যান্য সহযোগিতামূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে দুই দেশের জনগণের মধ্যে আরও বেশি আদান-প্রদান হবে। ১৫ জুলাই বেইজিং থেকে ঢাকা পর্যন্ত সরাসরি ফ্লাইট চালু করা হবে। দুই দেশের মধ্যে প্রতি সপ্তাহে ৮০টি ফ্লাইট যাতায়াত করবে, যার ধারণক্ষমতা ১৫ হাজারের বেশি। যা কর্মী বিনিময় আরও বৃদ্ধি করবে এবং দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক বিনিয়োগকে উত্সাহিত করবে। টানা দুই বছর ধরে বাংলাদেশের সংস্থা দ্বারা পরিচালিত "চীনের ন্যাশনাল ইমেজ ইন বাংলাদেশ" জনমত জরিপ অনুসারে, ৯০ শতাংশের বেশি উত্তরদাতারা বিশ্বাস করেন, যে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের বর্তমান পরিস্থিতি ভালো, এবং বাংলাদেশের জনগণের চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের মূলে রয়েছে দুই দেশের ক্রমবর্ধমান বন্ধুত্ব। গত বছর আন্তর্জাতিক শিশু দিবসের আগে, প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বাংলাদেশি শিশু আলিফা চীনকে একটি জবাবি চিঠি লিখেছিলেন। তাকে কঠোর পড়াশোনা করতে, তার স্বপ্নগুলি অনুসরণ করতে এবং চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী বন্ধুত্বের উত্তরাধিকারী হতে উত্সাহ দিয়েছিলেন। আলিফা চীনের গল্পটি চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে জনগণের মধ্যে সম্পর্কের প্রতিকৃতি।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক চীন সফর দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে। এই সফর দীর্ঘস্থায়ী সংযোগ গড়ে তুলবে, পারস্পরিক সম্মান বৃদ্ধি করবে এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ভাগাভাগির উপলব্ধি প্রচার করবে। উভয় পক্ষের যৌথ প্রচেষ্টায়, এই নতুন অধ্যায়টি দুই দেশের জনগণের জন্য বাস্তব সুবিধা বয়ে আনবে এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অব্যাহত উন্নয়নের জন্য একটি দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

 

(জিনিয়া/তৌহিদ/ফেই)