উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা- ন্যাটোর সম্প্রতি সমাপ্ত ওয়াশিংটন শীর্ষ সম্মেলনটি জোটের সদস্য রাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের রাজনীতিবিদ এবং পণ্ডিতদের কাছ থেকে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছে। তারা বলছেন যে, জোটটি আরও সংঘাতকামী হয়ে উঠেছে এবং যার ফলে একে আর কোনোভাবে বিশ্বশান্তির অভিভাবক বলা যায় না।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক স্টিফেন ওয়াল্ট ‘ফরেন পলিসি’তে—‘এবার, ন্যাটো সত্যিকার অর্থেই সমস্যায় পড়েছে’, শিরোনামে তার মতামত জানিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন।
ওয়াল্ট লিখেছেন, ন্যাটো এমন একসময় ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপন করছে যখন ইউরোপে কট্টর-ডানপন্থী শক্তির উত্থান ঘটছে, ইউক্রেন সংকট, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি নীতিমালা নিয়ে ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিভাজন দেখা দিয়েছে।
ওয়াল্ট উল্লেখ করেন, “জোটটির পূর্ব দিকে বেপরোয়া সম্প্রসারণ একটি পুরোপুরি ‘মুক্ত ও শান্তিপূর্ণ ইউরোপকে’ বেকায়দায় ফেলবে— এমন ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গেছে।”
অধ্যাপক ওয়াল্ট ন্যাটোর ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন শুধু এটা যে, কত দ্রুত তা হবে, এবং কতখানি হবে।
এরই মধ্যে, ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের অনেক রাজনীতিবিদ এবং পর্যবেক্ষক, জোট গঠনের মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে, নির্দিষ্ট কিছু দেশের প্রতি বৈরিতার প্রদর্শনের বিষয়ে তাদের অসন্তোষ ও বিরোধিতা প্রকাশ করেছেন।
হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন যে, ন্যাটোকে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পরিবর্তে শান্তি অন্বেষণের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। তিনি ওয়াশিংটন থেকে এ পোস্টটি করেন, যেখানে তিনি এ সপ্তাহের শুরুতে শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন।
ওরবান তার অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে বলেছেন, ‘ন্যাটো ৭৫ বছর আগে তার সদস্যদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে, এটি এখন তার মূল লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, ক্রমবর্ধমানভাবে এটি একটি যুদ্ধবাদী-সংগঠনের মতো আচরণ করছে বলে মনে হচ্ছে।”
তিনি বলেন যে, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে ন্যাটোর ক্রমবর্ধমান সক্রিয় ভূমিকায় এই পরিবর্তন প্রদর্শিত হয়েছে। “আমরা বিশ্বাস করি এটি বিপজ্জনক, এমনকি দায়িত্বজ্ঞানহীন, কারণ এটি কোথায় নিয়ে যাবে বা কোথায় গিয়ে এর শেষ হবে আমরা কেউ তা বলতে পারি না।”
স্লোভেনীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উরোস লিপুসেক বলেছেন, ন্যাটো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে। সদস্য এলাকার বাইরে সার্বভৌম দেশগুলোর উপর আক্রমণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবৈধ হস্তক্ষেপে অটল সমর্থন, চুক্তির বিপরীতে গিয়ে রাশিয়ার জন্য হুমকি হয়ে ওঠা ন্যাটোর সম্প্রসারণ- এই সমস্ত কিছুর সাথে এর মূল লক্ষ্যগুলোর কোনও সম্পর্ক নেই। ন্যাটো ক্রমবর্ধমানভাবে একটি আগ্রাসী জোট হিসেবে আবির্ভূত হতে চাইছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে।
ক্রোয়েশিয়ান রাজনৈতিক বিশ্লেষক ম্লাডেন প্লিস কোনো রাখঢাখ না করেই বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নীতিগলো বাস্তবায়নের জন্য ন্যাটোকে ব্যবহার করেছে এবং ন্যাটোর উপর খবরদারি করে। এটি ইউরোপীয় অংশীদারদের জন্য ভাল নয়। ন্যাটো অবশ্যই ওয়াশিংটনের একটি বর্ধিত হাত হবে না এবং আরও বেশি সংখ্যক ইউরোপীয় দেশ এ বিষয়টি নিয়ে সতর্ক বার্তা দিয়েছে।
বড় বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে ম্লাডেন বলেন, “আমেরিকার স্বার্থ হাসিলের জন্য এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ন্যাটোকে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা ইউরোপের স্বার্থের সাথে একেবারেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।”
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের অধ্যাপক ও পরিচালক জেফ্রি শ্যাস বলেছেন, ন্যাটো হল মার্কিন সামরিক-নিরাপত্তা যন্ত্রের একটি ‘প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো’ যা মার্কিন গ্র্যান্ড কৌশল বাস্তবায়নে নিয়োজিত।
শ্যাস আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি বিপথগামী ও বিপজ্জনক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে, যার লক্ষ্য আধিপত্যবাদ এবং চীন ও রাশিয়াসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে সংঘাত জিইয়ে রাখা। ন্যাটো এই বিভ্রান্তিকর এবং বিপজ্জনক পররাষ্ট্রনীতির একটি অংশ মাত্র।”
মাহমুদ হাশিম
সিএমজি বাংলা, বেইজিং।