মেড ইন চায়না:পর্ব-৭ আকুপাংচার
2024-07-13 16:35:38

মেড ইন চায়না

পর্ব-৭

আকুপাংচার

হাজার বছর আগের কাগজ ও চা থেকে শুরু করে আজকের প্যাসেঞ্জার ড্রোন, কিংবা নতুন জ্বালানির গাড়ি। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে চলেছে চীনের শক্তিশালী আবিষ্কারের হাত ধরে। নানা সময়ে দারুণ সব আবিষ্কার করে আধুনিক সভ্যতার ভিত গড়ে দিয়েছে চীন। আর সেই সব আবিষ্কার নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন মেড ইন চায়না।

মেড ইন চায়নার সপ্তম পর্বে সাথে আছি আমি ফয়সল আবদুল্লাহ... আজকের পর্বে থাকছে চীনের আবিষ্কার আকুপাংচারের কথা।

হাজার বছর আগে থেকেই মানুষ আবিষ্কার করে আসছে নানা ধরনের ওষুধ। মাঝে মাঝে দেখা যায় প্রাচীন কোনো শাস্ত্রের হাত ধরেও আবিষ্কার হচ্ছে আধুনিক কোনো ওষুধ কিংবা চিকিৎসাপদ্ধতি।  মোটকথা, চিকিৎসা শাস্ত্রকে চাইলেই কোনো একটি ছকে ফেলে দেওয়া যাবে না। এর রয়েছে কার্যকরী অনেকগুলো শাখা।

যেমন অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি কিংবা ইউনানি। আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে এমনই এক দারুণ চিকিৎসা পদ্ধতির শিকড় রচনা হয়েছিল চীনে। যার নাম আকুপাংচার।

সময় গড়িয়েছে অনেক। বিশ্বের দরজায় এখন কড়া নাড়ছে শক্তিশালী এআই, কোয়ান্টাম কম্পিউটার এবং বুদ্ধিমান রোবট। তারপরও আকুপাংচারের কদর একটুও কমেনি। বরং চীন থেকে এই আকুপাংচারের কলাকৌশল এখন রীতিমতো রপ্তানি হচ্ছে উন্নত বিশ্বে। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশই আগ্রহের সঙ্গেই জানতে চাচ্ছে কার্যকর এই ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে। আর এই আকুপাংচার কিন্তু শতভাগ মেড ইন চায়না।

 

আগে জেনে নেওয়া যাক আকুপাংচার সম্পর্কে

ঐতিহ্যগত চীনা ওষুধ বা চিকিৎসাপদ্ধতিকে সংক্ষেপে বলা হয টিসিএম। এই টিসিএম তথা ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন হলো রোগ প্রতিরোধ, নির্ণয় এবং চিকিত্সার এমন এক ব্যবস্থা যা  হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন চীনা বিশেষজ্ঞের হাতে বিকশিত হয়েছে।

এই টিসিএম-এর একটি ধারণা হলো আমাদের দেহের অভ্যন্তরে আছে একটি অত্যাবশ্যক শক্তি। যার নাম ছি। শরীরের মোট ১২টি চ্যানেলে এই ছি শক্তি প্রবাহিত হয়। চ্যানেলগুলোর আরেক নাম মেরিডিয়ান। যদি এই ছি ভারসাম্যপূর্ণ হয় তবে ব্যক্তির আধ্যাত্মিক, মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য ঠিক থাকে। কিন্তু যখন এই ছি’তে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, তখন দেখা দিতে পারে নানা রোগ।  এই ছি এর সঙ্গে আবার ইয়িন এবং ইয়াং নামের দুটি পরষ্পর বিপরীতধর্মী শক্তির সম্পর্ক আছে। এ দুটোও আমাদের শরীরে ভারসাম্য তৈরি করে। টিসিএম-এ মূলত ইয়িন ও ইয়াং-এর মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করা হয় এবং ওই শক্তিপ্রবাহের মেরিডিয়ানগুলোর মাধ্যমে শরীরে শক্তির প্রবাহ পুনরুদ্ধার করে। আর এর একটি পদ্ধতি হলো আকুপাংচার। এতে শরীরের বিশেষ বিশেষ প্রেশার পয়েন্টে ঢোকানো হয় জীবাণুমুক্ত বিশেষ ধরনের সূচ। এতে করে উদ্দীপ্ত হয় ওই অঞ্চলের স্নায়ু। আর সেই উদ্দীপনার সংকেতটি পৌঁছে যায় স্নায়ুতন্ত্রের বিশেষ স্থানে। তখনই কমে আসে ব্যথা কিংবা ধীরে ধীরে সেরে যেতে থাকে দীর্ঘমেয়াদি কোনো রোগ।

আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগে চীনা ভাষার জনক খ্যাত সম্রাট হুয়াংথিন আবিষ্কার করেন আকুপাংচার। তিনি মূলত প্রথম আকুপাংচারকে একটি চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি দেন ও এর নানা পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। পরে ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হান রাজবংশের আমলেই আকুপাংচারের তত্ত্ব এবং অনুশীলন পৌঁছায় নতুন এক স্তরে। আর সেই আকুপাংচার ২০ শতক পর্যন্ত অপরিবর্তিতই ছিল।

আকুপাংচারবিদরা বিশ্বাস করেন মানবদেহে ‍দুই হাজারেরও বেশি আকুপাংচার পয়েন্ট রয়েছে। এই পয়েন্টগুলো বিভিন্ন ছি চ্যানেলের মাধ্যমে সংযুক্ত। মেরিডিয়ানগুলোর মধ্যে নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলোতে আকুপাংচার ব্যবহার করা হলে তা ওই ছি শক্তির ব্লক কাটিয়ে শরীরে শক্তির প্রবাহ উন্নত করে।

এতে বোঝা যায়, আকুপাংচার শুধু সাময়িক ব্যথা কমায় না, এটি মূলত রোগ ও উপসর্গের গোড়ায় গিয়ে চিকিৎসা করে।

এরইমধ্যে বেশ কিছু রোগে আকুপাংচারের কার্যকারিতার জোরাল প্রমাণ পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ তালিকায় আছে—

গ্যাসট্রাইটিস, আইবিএস, হেপাটাইটিস, ব্রঙ্কাইটিস, সোরিয়াসিস, সাইনুসাইটিস, ইরিটেবল ব্লাডার, হেমারয়েড, মাদকাসক্তি, নানা ধরনের মানসিক সমস্যা, সংক্রমণ, আর্থ্রাইটিস, ব্যাক পেইন, মাংসপেশির দুর্বলতা, ঘাড়ের ব্যথা, সায়াটিকা, মাইগ্রেন, পারকিনসন ইত্যাদি। এমনকি পক্ষাঘাতের রোগীও সুস্থ হচ্ছে আকুপাংচার চিকিৎসায়।

চীন থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া ব্রাজিলের আকুপাংচার বিশেষজ্ঞ ড. ওরলান্দো গোনসালভেজ একবার সিজিটিএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একটি গল্প বলেছেন। তার গল্পটা ছিল এমন।

“চীনা মেডিসিন আমাকে বরাবরই বিস্মিত করে। একবার এক রোগী এসে জানতে চাইল আকুপাংচার চিকিৎসা নিলে তার শরীরের ব্যথা কমবে কিনা। আমি তাকে বললাম, না, এই ব্যথাটা তোমার সমস্যার সামান্য লক্ষণ মাত্র। পরে তাকে আকুপাংচার চিকিৎসা দেই। দেখা গেল এতে করে তার কিডনিও আগের চেয়ে ভালো মতো কাজ করতে শুরু করেছে। এরপর তার ঘুম ভালো হলো, মানসিক অবসাদ কেটে গেল এবং ব্যথাও দূর হলো।”

২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আকুপাংচারের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের একটি পর্যালোচনা প্রকাশ করে। আকুপাংচার: রিভিউ অব অ্যানালাইসিস অব রিপোর্টস অন কনট্রোলড ক্লিনিকাল ট্রায়াল শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে ২০০টিরও বেশি উপসর্গ ও রোগের ক্ষেত্রে আকুপাংচার চিকিৎসাপদ্ধতির  প্রয়োগকে সমর্থন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথও সম্পূরক চিকিৎসা হিসেবে আকুপাংচারকে থেরাপিউটিক বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে বিবৃতি দিয়েছে।

 

এবার আকুপাংচার নিয়ে জেনে নেওয়া যাক কয়েকটি তথ্য

আকুপাংচার চিকিৎসা পদ্ধতি রোগীর ওপর নির্ভর করে। ১০ জন মানুষের মাথাব্যথা সারাতে দেখা যাবে ১০টি আলাদা প্রেশার পয়েন্টে সূঁচ ফোটাতে হচ্ছে।

এখনকার প্রচলিত আকুপাংচার মেরিডিয়ান সিস্টেমে মানবদেহে প্রায় ৩০০টি আকুপাংচার পয়েন্ট বের করা হয়েছে। প্রতিটি পয়েন্টেরই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কাজ।

আকুপাংচার বিশেষজ্ঞ বা আকুপাংচারিস্ট যারা আছেন, তারা রোগীর প্রাথমিক পরীক্ষার জন্য জিভ দেখেন ও নাড়ির গতি মেপে দেখেন।

কখনও কখনও কোনো রোগের একাধিক লক্ষণ ও জটিলতা দেখা যায়। আকুপাংচারে মূলত একটি রোগের লক্ষণ বিবেচনায় নিয়ে সেটার মূলোৎপাটন করা হয়।

চীনে তো শত শত বছর ধরে চলে আসছে আকুপাংচার। কিন্তু এ চিকিৎসা পশ্চিমের দেশগুলোয় এলো কবে থেকে?

ইউরোপ ও আমেরিকায় আকুপাংচার এসেছে খুব বেশি দিন হয়নি। ১৯৭১ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন চীন সফরে আসেন। সফরসঙ্গী হিসেবে আসেন নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক জেমস রেস্টন। চীনে এসেই জেমসকে জরুরি ভিত্তিতে অ্যাপেনডেক্টমি তথা অ্যাডেনডিসাইটিসের অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের পর ওই ব্যক্তি ভুগছিলেন বেশ ব্যথায়। তখন চীনের ঐতিহ্যবাহী আকুপাংচারের মাধ্যমেই ওই মার্কিন সাংবাদিককে দেওয়া হয়েছিল পোস্ট-অপারেটিভ চিকিৎসা। এতে দ্রুত তার ব্যথা চলে যায়। আর তাতেই মুগ্ধ হয়ে যান ওই সাংবাদিক। দেশে ফিরেই তিনি নেমে পড়েন আকুপাংচারের গুণকীর্তন প্রচারে। নিউইরর্ক টাইমসের প্রথম পাতায় ছাপা হয় আকুপাংচার নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদন পড়ে আগ্রহী হয় আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ। এরপর তারা যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজনকে চীনে পাঠায় এ নিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে।

এখন আমেরিকায় দক্ষ ও সনদপ্রাপ্ত আকুপাংচারবিদরা এ সেবা দিচ্ছেন। এমনকি এ নিয়ে দেশটিতে চালু হয়েছে স্নাতোকত্তর ডিগ্রি।

যারা কখনও এ চিকিৎসা নেননি, তাদের অনেকের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে, আকুপাংচার চিকিৎসায় শরীরের নানা পয়েন্টে ‍সূচ ফোটানো হয়। এতে তো রোগীর সূচ ফোটানোর ব্যথাতেই কাতর হয়ে পড়ার কথা। তারা আশ্বস্ত হতে পারেন এ কারণে যে, এখনকার আকুপাংচারে যে সূঁচ ব্যবহার করা হয় তা এতই সূক্ষ্ম যে, রোগী কোনো ব্যথা তো দূরে থাক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিছু টেরই পান না। কেউ কেউ বড়জোর একটুখানি অস্বস্তিকর অনুভূতি পেতে পারেন।

দিনে দিনে চীনের আকুপাংচার চলে গেছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। ১৯৮৪ সালে ব্রাজিলে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ইনস্টিটিউট অব আকুপাংচার রিও ডি জেনেইরো। ৪০ বছরে সেখানে প্রশিক্ষণ পেয়ে তৈরি হয়েছেন দেড় লাখেরও বেশি আকুপাংচারিস্ট। আর এখনতো বছরে গড়ে তৈরি হচ্ছেন ৩০ হাজার নতুন আকুপাংচার বিশেষজ্ঞ।  দেশটির সরকারি তথ্য বলছে এ পর্যন্ত দেশটিতে এ চিকিৎসা নিয়ে প্রায় এক লাখ মানুষ সুস্থ হয়েছেন।

২০১৯ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বের ১৮৩ টি দেশে এখন আকুপাংচার চিকিৎসা ব্যবহৃত হচ্ছে।

গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ

সার্বিক তত্ত্বাবধান: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী