‘এক অঞ্চল এক পথ উদ্যোগে’র মাধ্যমে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে সহায়তা করছে চীন
2024-07-09 16:31:18

বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর, পায়রা বন্দরের দিকে গাড়ি চালিয়ে গেলে আপনি দূর থেকে কারখানা এলাকায় একটি সুউচ্চ কুলিং টাওয়ার দেখতে পাবেন। এই কারখানার এলাকা হল পায়রা ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ২টি ইউনিটের হাই-সুপারক্রিটিকাল কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র, যা চীন-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে নির্মিত বাংলাদেশের বৃহত্তম বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

বাংলাদেশে কয়লা এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থের অভাব রয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ার কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু দেশে অবকাঠামো পর্যাপ্ত নয় এবং বিদ্যুৎ বিভ্রাট একটি সাধারণ ঘটনা।

২০১৬ সালে, চায়না জেনারেল টেকনোলজি গ্রুপের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান- চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট (গ্রুপ) কোং লিমিটেড এবং বাংলাদেশ নর্থ-ওয়েস্ট ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ কোম্পানির বিনিয়োগ, নির্মাণ ও পরিচালনায় চীন ও বাংলাদেশ যৌথভাবে ‘এক অঞ্চল একপথ উদ্যোগ’-বিআরআই’র আওতায় এই মূল প্রকল্পগুলোর নির্মাণ ও পরিচালনা শুরু হয়।

২০২২ সালে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমের সাথে, বাংলাদেশ সার্বিকভাবে সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ সরবরাহের নতুন যুগে প্রবেশ করেছে।

পায়রা পাওয়ার স্টেশনটি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সরবরাহে একটি বড় মাইলফলক। বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানির চীনা পক্ষের স্থল প্রযুক্তি বিষয়ক জেনারেল ম্যানেজার ওয়াং শিয়াং জি বলেছেন, কেন্দ্রটি প্রতি বছর বাংলাদেশের জন্য ৮৫৮ কোটি কিলোওয়াট স্থিতিশীল ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে। যা বাংলাদেশের মোট বিদ্যুত চাহিদার ১০%।

একই সময়ে, পায়রা পাওয়ার স্টেশন স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রায় ৮ হাজার ৪০০টি কর্মসংস্থান এবং প্রায় ৬ হাজার ৩০০ মানুষের জন্য বৃত্তিমূলক দক্ষতা প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে, যা স্থানীয় এলাকার জন্য একটি সত্যিকারের প্রতিভা প্রশিক্ষণের ভিত্তি হয়ে উঠেছে।

চার বছর ধরে এই প্রকল্পে কাজ করা একজন বাংলাদেশী প্রকৌশলী হক বলেছেন, “প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত, চীনা প্রকৌশলীরা আমাকে ধাপে ধাপে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমি এখানে কাজ করতে পেরে খুব গর্বিত।” সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক অনেকেই আগে চাকরি পাননি, কিন্তু এই পাওয়ার স্টেশন তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে।

হক আরো বলেন, “বিআরআই’র যৌথ নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য অনেক উপকারি হয়েছে। পাওয়ার সেক্টর উপকৃত বিভিন্ন সেক্টরের মধ্যে একটি মাত্র। পায়রা পাওয়ার স্টেশন ছাড়াও, বাংলাদেশে অনেক জায়গা আছে যেগুলো 'বিআরআই'র যৌথ নির্মাণের কারণে বিকশিত হয়েছে।”

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, বাংলাদেশও নতুন শক্তির বিকাশের জন্য কঠোর চেষ্টা করছে। তবে, প্রযুক্তি, অভিজ্ঞতা এবং অর্থের অভাব দেশের শক্তির রূপান্তরকে বাধাগ্রস্ত করেছে এবং বাংলাদেশের ‘ভিশন ২০৪১’ বাস্তবায়নকেও প্রভাবিত করেছে। চীনা অংশীদারদের সম্পৃক্ততায় এ অবস্থার পরিবর্তিত হয়েছে।

২০১৯ সালে, চায়না হুয়াতিয়ান ওভারসিস ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির নিয়ন্ত্রিত হুয়াশিন পাওয়ার কোম্পানির বিনিয়োগে ময়মনসিংহ ফটোভোলটাইক প্রকল্প নির্মাণ শুরু হয়। পরের বছরের শেষ নাগাদ প্রকল্প পরিচালনা শুরু হওয়ার পর, চীন থেকে প্রায় ১.৭ লাখ সৌর প্যানেল ময়মনসিংহ এলাকায় স্থাপিত হয়েছে। এসব প্যানেলের মাধ্যমে সৌর শক্তিকে বিদ্যুতে রূপান্তর করে হাজার হাজার পরিবারকে আলোকিত করা হয়েছে। বর্তমানে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশকে প্রতি বছর ৫০ হাজার টনের বেশি কার্বন নিঃসরণ কমাতে সাহায্য করে।

স্থানীয় কৃষক ফজলার বলেন, “এটা চমত্কার যে আমাদের এখানে একটি ফটোভোলটাইক পাওয়ার স্টেশন আছে। এর আগে এ অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহ খুব সীমিত ছিল এবং প্রায় বিভ্রাট ঘটতো। এখন ফটোভোলটাইক পাওয়ার স্টেশন থাকার কারণে বিদ্যুত সরবরাহ স্থিতিশীল হয়েছে।”

ফজলার বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র শুধুমাত্র স্থানীয় এলাকায় বিদ্যুৎ নিয়ে আসে না, এটি নগরায়নের মাত্রাও উন্নত করে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে, লোকেরা আশেপাশের এলাকায় কৃষিকাজ ও ব্যবসা করতে শুরু করে। একটি সাধারণ ছোট গ্রামকে একটি শহরে পরিণত করে। স্থানীয় মানুষের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং জীবন আরও সুবিধাজনক হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের একটি শহর কক্সবাজারে, বাংলাদেশের প্রথম কেন্দ্রীভূত বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পের ২২টি বায়ু টারবাইন বাতাসে ঘুরছে।

এই প্রকল্পটিতে চায়না স্টেট পাওয়ার ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশনের উলিং ইলেকট্রিক পাওয়ার কোং লিমিটেড বিনিয়োগ করেছে এবং চীনের পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশনের চায়না ছেংতু সার্ভে ডিজাইন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট কোং লিমিটেড এর প্রধান ঠিকাদার। ২০২৩ সালের অক্টোবরে এটি চালু হওয়ার পর থেকে, প্রকল্পটি প্রায় ৮০ মিলিয়ন কিলোওয়াট/ঘন্টা ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ উত্পাদন করেছে। এটি প্রতি বছর ১৪৫ মিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘন্টা সবুজ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে এবং ১ লাখ পরিবারের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে পারে। এটি ৪৪ হাজার ৬০০ টন কয়লা ব্যবহার কমিয়েছে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন এক লাখ টনের বেশি কমিয়ে দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রকল্পের একজন বাংলাদেশি প্রকৌশলী আলম বলেন, বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতিটি উইন্ড টারবাইন সর্বাধুনিক চীনা প্রযুক্তি গ্রহণ করে এবং প্রতি সেকেন্ডে ৫.২ মিটার পর্যন্ত বাতাসের গতি সহজেই মোকাবেলা করতে পারে। অধিকন্তু, টাওয়ার এবং টারবাইনের বর্তমান স্থাপনা নিশ্চিত করে যে, স্থানীয় কৃষকদের কৃষিকাজ এবং লবণ চাষীদের লবণ শুকানোর ক্ষেত্রে এতে কোনো প্রভাব পড়বে না।

উলিং ইলেকট্রিক পাওয়ার বাংলাদেশ শাখার মহাব্যবস্থাপক হেই চাও বলেন, “এই প্রথমবারের মতো চীনা উদ্যোগ বিনিয়োগকারী হিসাবে বাংলাদেশে বায়ু শক্তি চালু করেছে, যা বাংলাদেশে নতুন শক্তির বিকাশের জন্য একটি মাইলফলক।” প্রকল্প নির্মাণ প্রক্রিয়ায় কোম্পানিটি চীনা পরিকল্পনা, চীনা মানদণ্ড, চীনা সরঞ্জাম এবং চীনা প্রযুক্তি প্রবর্তন করেছে, স্থানীয়ভাবে স্বীকৃত হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের জন্য বায়ুশক্তি ক্ষেত্রে ব্যবহারিক প্রতিভার প্রথম ব্যাচকে প্রশিক্ষিত করেছে।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব রহমান প্রকল্পের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বলেন, “এটি আমাদের দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুত কেন্দ্র যা পরিচ্ছন্ন এবং আরও টেকসই জ্বালানি সরবরাহের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।”

পাওয়ার স্টেশন নির্মাণের পাশাপাশি, চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে সাবস্টেশন ও ট্রান্সমিশন লাইনের নির্মাণ, সম্প্রসারণ, আপগ্রেডিং এবং সংস্কারের মতো প্রকল্পও হাতে নিয়েছে, কার্যকরভাবে বাংলাদেশের পাওয়ার গ্রিডকে উন্নত করা এবং এটিকে স্থিতিশীল অপারেশন এবং ট্রান্সমিশন লস কমানোর লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে।

 (স্বর্ণা/হাশিম)