হাজার বছর আগের কাগজ থেকে শুরু করে আজকের প্যাসেঞ্জার ড্রোন, কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন কিংবা নতুন জ্বালানির গাড়ি। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে চলেছে চীনের শক্তিশালী আবিষ্কারের হাত ধরে। নানা সময়ে দারুণ সব আবিষ্কার করে আধুনিক সভ্যতার ভিত গড়ে দিয়েছে চীন। আর সেই সব আবিষ্কার নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন মেড ইন চায়না।
মেড ইন চায়নার ষষ্ঠ পর্বে সাথে আছি আমি ফয়সল আবদুল্লাহ... আজকের পর্বে থাকছে চীনের আবিষ্কার কাগুজে মুদ্রার কথা।
কিছু পেতে হলে তো কিছু দিতেই হবে। শুরু থেকেই এ নিয়মে চলছে মানুষের জীবন। আর এই দেওয়া-নেওয়ার হাত ধরেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে শুরু করে সভ্যতা। চালু হয় বিনিময় প্রথা।
আদিকালে বিনিময় হতো জিনিসপত্র। গরুর বদলে ছাগল নাও, কিংবা হাঁসের বদলে মুরগি। তাতেও ঠিক জমে উঠছিল না লেনদেন। এরপর চালু হয় দামি দামি ধাতু যেমন স্বর্ণ, রূপা বা তামার তৈরি মুদ্রা। বিনিময় ব্যবস্থা সহজ হলো অনেকটা। তবু থেকে গেল কিছু সমস্যা। দেখা গেল কমদামি কোনো একটা বস্তুর সঙ্গে স্বর্ণ বা রৌপ্য মুদ্রার বিনিময় করা যেমন কঠিন, আবার ব্যবসায়ীরাও মুদ্রা দিয়ে পকেট বোঝাই করে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে পারছেন না সহজে।
এ সমস্যা দূর করতেই আজ থেকে প্রায় ১৪শ বছর আগে চীনে থাং রাজবংশের আমলে চালু হয় কাগুজে নোট। পরে ওই মুদ্রা ছড়িয়ে যায় গোটা বিশ্বে। যে কাগুজে নোটের হাত ধরে ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে বিশ্ব অর্থনীতির চালচিত্র, আর সেই কাগজের নোটটি কিন্তু পুরোপুরি মেড ইন চায়না।
ঠিক কী করে বা কেন এলো কাগুজে মুদ্রা?
চলে যাই সুপ্রাচীন আমলে। ধরুন আপনার কাছে আছে ৫০ গ্রাম স্বর্ণ। এখন আপনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা রাজদরবারে সেই স্বর্ণ জমা রেখে ৫০টি আলাদা কাগজে লিখিয়ে নিলেন যে, আপনি চাওয়া মাত্র এমন একটি কাগজের বিনিময়ে ১ গ্রাম স্বর্ণ আপনি ফেরত পাবেন। সেই কাগজগুলোয় দেওয়া হলো রাজকীয় সিলমোহর। অর্থাৎ কাগজটি যে-ই দেখাবে সে-ই পাবে স্বর্ণগুলো। তারমানে, রাতারাতি একটি কাগজের মূল্য হয়ে গেল ১ গ্রাম স্বর্ণের সমান। এতে কিন্তু স্বর্ণটা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নিরাপদেই থাকল আবার আপনিও রইলেন নিশ্চিন্তে। এবার আপনি একটি বা দুটি বা দশটি কাগজের বিনিময়ে কেনাকাটা করতে পারবেন। আর এভাবেই থাং রাজবংশের সময় ব্যবসায়ীদের হাতে হাতে জনপ্রিয় হয়ে গেল রাজকীয় সিলমোহরযুক্ত কাগুজে নোট।
তবে চীনে গোটা রাষ্ট্রজুড়ে কাগুজে মুদ্রার প্রচলন হয় সং রাজবংশের আমলে। সেটাও আজ থেকে হাজার বছর আগের কথা। ওই সময় প্রথম বাজারে ছাড়া হয় আনুষ্ঠানিক ব্যাংক নোট যার নাম দেওয়া হয় চিয়াওচি। একপর্যায়ে ধাতব বা দামি বস্তুর পরিবর্তে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ছাপানো শুরু হয় মুদ্রা। আর সেটাকেই ছড়িয়ে দেওয়া হয় বাজারে।
এরপর ক্ষমতার পালাবদল হলেও হারিয়ে যায়নি কাগুজে মুদ্রা। ইউয়ান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা কুবলাই খান এসে আরেক ধরনের কাগুজে মুদ্রার প্রচলন করেন, যার নাম রাখা হয় চিয়াওছাও। শুরুর দিকে কাগুজে মুদ্রাগুলোর সময় ও ব্যবহারের সীমারেখা বেঁধে দেওয়া থাকলেও পরে মেয়াদের বিষয়টি তুলে নেওয়া হয়।
চীন থেকেই একটা সময় কাগুজে মুদ্রা আসে ইউরোপে। কিন্তু সেটার জন্য ইউরোপকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ৬০০ বছর। কিন্তু এত দেরি হওয়ার কারণটা কী?
ত্রয়োদশ শতকে চীনে আসেন ইতালির ভ্রমণচারী ও বিশ্বখ্যাত ভূ-পর্যটক মার্কো পোলো। তিনি এসে দেখেন শাসক কুবলাই খান নিজের কোষাগার থেকে বাজারে ছড়াচ্ছে কাগুজে মুদ্রা নামের একটি বস্তু। লোকজন সেটাকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে এবং যত্ন করে আগলে রাখছে। কাগজের টাকার অদ্ভুত এই রাজ্যে এসে মার্কো পোলো বেশ অবাক হলেও দ্রুত তিনি বুঝতে পারেন, এর গুরুত্ব। বিষয়টা দেখে মার্কো পোলো যখন সবাই তার অভিজ্ঞতার কথা জানালেন, তখন কিন্তু কেউ সাদরে নেয়নি বিষয়টাকে। উল্টো পোলোকে বিকারগ্রস্তও বলেছিলেন কেউ কেউ। যে কারণে পশ্চিমা বিশ্বে কাগজের মুদ্রা আসতে লেগেছিল আরও ৬০০ বছর।
চীনে কাগুজে নোট তৈরি হতো কী করে? সেই গল্পটা শোনা যাক এবার।
কুবলাই খানের আমলে মালবেরি গাছের নরম ও খানিকটা ভেজা কাঠ ছিল কাগজের নোট তৈরির মূল কাঁচামাল। গাছের বাকল ও কাণ্ডের মাঝখানে পাওয়া যায় ওই নরম কাঠ। তারপর এই কাঠের সাথে আঠা মিশিয়ে দেওয়া হয় প্রচণ্ড চাপ। এতে তৈরি হয় বিশেষ ধরনের কাগজ। ওটা হতো কালো রঙের। বেশ সাবধানে তৈরি করতে হতো সেটা। এরপর ওই কাগজ চলে যেত রাজ কোষাগারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার দরবারে। নোটে মালিকের নাম এবং মূল্যমান সহ লেখা হতো আরও কিছু দরকারি তথ্য। এরপর তা চলে যেত সম্রাট কুবলাই খানের হাতে। সম্রাট নিজের হাতে নোটে সিল দিয়ে দিতেন। আর তাতেই নোটটি হয়ে যেত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য মূল্যবান একটি বিনিময় মাধ্যম। ওই সময় চীনে এ ধরনের সরকারি নোট ছাড়া কোনো প্রকার বাণিজ্যিক লেনদেনের কথা কেউ চিন্তাও করতে পারত না।
অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে চলুন শুনি ব্যাংক নোট তথা কাগুজে মুদ্রার কিছু অজানা তথ্য
জালনোট সনাক্তকরণের পদ্ধতি আবিষ্কার করে চীনারা। শুরুর দিকে চীনের কাগুজে নোটের মধ্যে থাকতো বিশেষ গোপনীয় কিছু চিহ্ন। সং রাজবংশের আমলে তৈরি চিয়াচি নামের নোটে থাকতো জটিল ধরনের কিছু চিত্রকর্ম। ওই সময়কার একটি নোটে ছিল একটি ব্যস্ত বাজারের ছবি। আর এমন জটিল নোট জাল করা ছিল না সহজ কাজ। আবার জালনোট যারা বানাতো, তাদের জন্য ছিল কঠোর শাস্তির ব্যবস্থাও।
এখন একেক দেশের কাগজের নোটে থাকে একেক রকম নকশা। এর মধ্যে কিছু নোটে থাকে রাষ্ট্রের জনক বা কিছু নোটে থাকে ওই দেশের প্রতিনিধিত্বকারী কোনো প্রাণীর ছবি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় পাখির ছবি। আর এখন ৪১ টি দেশের ব্যাংক নোটে ব্যবহার করা হয়েছে ঈগলের ছবি।
যত উন্নতমানের কাগজেই ছাপা হোক না কেন, ব্যাংকনোটেরও আছে মেয়াদ। আর নির্দিষ্ট মেয়াদে সেই নোট বাতিল করে ছাপতে হয় নতুন নোট। আর তাই প্রতিবছর সারা বিশ্বে নষ্ট করা হয় ১৭ হাজার কোটি নোট। যা আবার নতুন করে ছাপতেও হয়।
ইউরোপের প্রথম ব্যাংক নোট ছাপা হয় সুইডেনে। ১৬৬১ সালে ওই নোটটি ইসু করে স্টকহোম বাংকো। অন্যদিকে, ১৬৯৪ সালে ইউরোপের প্রথম স্থায়ী ব্যাংকনোট চালু করে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড। তবে ওই নোট ইসু করার উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে তহবিল সংগ্রহ করা। আর আমেরিকায় প্রথম ব্যাংক নোট ছাপানো শুরু হয় ১৮৬২ সালে।
সুপ্রিয় শ্রোতা আজকের মেড ইন চায়না ছিল এ পর্যন্তই। আগামী পর্বে আবার আসবো চীনের সাড়া জাগানো আরেকটি আবিষ্কারের গল্প নিয়ে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।
গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ
সার্বিক তত্ত্বাবধান: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী