চীনের চিয়াংসু প্রদেশে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা সম্ভব হচ্ছে যাদের দানে
2024-07-01 15:00:47

সম্প্রতি চীনের বিভিন্ন প্রদেশে কাওখাও পরীক্ষার ফলাফল ধাপে ধাপে প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় স্কোরও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হবে। তখন, উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়া শিক্ষার্থীদের  বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শুরু হবে। আগের অনুষ্ঠানে আমরা বলেছি যে, চীনে প্রথম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত ৯ বছরের শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। তবে, সিচাং বা সিনচিয়াংসহ কয়েকটি সংখ্যালঘু জাতি-অধ্যুষিত এলাকায় টানা ১২ বছর পর্যন্ত শিক্ষা ফ্রি। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ে আর কোনো বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। তখন থেকে পড়াশোনার বার্ষিক খরচ শিক্ষার্থীর পরিবারকে বহন করতে হয়। যদিও, ২০২০ সালে চীন হত-দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হয়েছে, কিন্তু যাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল, তাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ একটি অতিরিক্তি আর্থিক বোঝা হিসেবেই রয়ে গেছে। এ প্রেক্ষাপটে, চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ছাত্রঋণ ব্যবস্থা চালু করেছে। চীনের চিয়াংসু প্রদেশের ইয়াংসি নাইট পত্রিকা ও সিনো লিমিটেড কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে, ২০১৮ সাল থেকে ‘আলো ছাত্রঋণ কার্যক্রম’ অনলাইনে চালু হয়। যারা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা দিতে চান, তাঁরা এ দাতব্য প্ল্যাটফর্মে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা দিতে পারেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা সংশ্লিষ্ট ছাত্রঋণ প্রকল্প এবং সংশ্লিষ্ট দাতাদের গল্প তুলে ধরবো।

৯৫ বছর বয়সের প্রবীণ স্যু টানা ৩ বছর ধরে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছেন এবং নিজের  সঞ্চিত অর্থ থেকে দান করছেন। চলতি বছর তাঁর দানকৃত অর্থের পরিমাণ ৩০ হাজার ইউয়ানে দাঁড়িয়েছে। আগের দুই বছর তিনি  প্রতিবার ১০ হাজার ইউয়ান করে দান করেছেন। এ সম্পর্কে জনাব স্যু বলেন, ‘মাতৃভূমি আমাকে চাকরি দিয়েছে। অবসর নেওয়ার পর আমি বীমাসুবিধা পাচ্ছি, ভালো পেনশনও পাচ্ছি। এখন আমার শরীরের অবস্থাও মোটামুটি ভালো। বেশি টাকা আমার লাগে না। তাই, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে আমি দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে চাই।’

জনাব স্যু ৩ বছর আগে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি মনে করেন, তার শরীর-স্বাস্থ্য ভালো; তাকে ওষুধের পেছনের বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় না। তিনি মাসে মাসে ভালোই সঞ্চয় করতে পারেন। তিনি কোনো কোনো শার্ট টানা ২০ বছর ধরে ব্যবহার করেছেন। পুরনো হলেও তিনি নতুন কাপড়চোপড় কেনেন না। তিনি বলেন, ‘কাপড়চোপড় পুরনো হলেও পরতে পারি; তাই নতুন কাপড় লাগে না।’

ছোটবেলার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ছোটবেলায় তাঁর পরিবার বেশ দরিদ্র ছিল। তবে, সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ গ্রহণশেষে তিনি সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান। দেশ তাকে অনেককিছু দিয়েছে; তিনিও বিনিময়ে দেশকে কিছু দিতে চান। যুবকালে তিনি সেনাবাহিনীর একজন সৈন্য ছিলেন। চীনা গণমুক্তি ফৌজের সৈন্য হিসেবে, মুক্তিযুদ্ধ আর কোরিয়ান যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তিনি এবং প্রথম শ্রেণীর পুরস্কারও লাভ করেছেন।

জনাব স্যু বেশ স্নেহময় প্রবীণ। প্রতিবছর তিনি শুধু দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা করেন তা নয়, বরং আশেপাশের লোকদের সাহায্যেও এগিয়ে আসেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনী গ্রামে বসবাস করতো। তখন কৃষকরা নিজেরা না-খেয়ে সৈন্যদের খাইয়েছে, খাদ্যশস্য সরবরাহ করেছে। ক্যাম্প না-থাকলে গ্রামবাসীদের বাড়িতে থাকতাম আমরা। তাঁরা নিজের বাড়িঘরে আমাদের জায়গা দিতেন। তাই, গ্রামবাসীদের প্রতি আমার অনেক ভালোবাসা রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, চীনের শহরায়নের প্রক্রিয়ায় গ্রামীণ শ্রমিকদের অনেক অবদান রয়েছে। তাদের প্রচেষ্টায় শহরের আবর্জনা দূর হয়, নতুন বাসভবন নির্মিত হয়। তাই যখন আশেপাশে এমন গ্রামীণ শ্রমিকের অসুস্থতার খবর শোনেন, তিনি তার সাহায্যার্থে এগিয়ে যান।

জনাব স্যুর বয়স ৯৫ বছর। তবে, এখনও তার শারীরিক অবস্থা বেশ ভালো; তিনি স্বাস্থ্যবান ও প্রাণবন্ত। তিনি দ্রুত হাঁটাহাটি করতে পারেন। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীতে নিয়মিত শরীরচর্চার অভ্যাস গড়ে ওঠে তার। অবসরকালেও তিনি অনেক ভোরবেলায় জেগে ওঠেন এবং প্রতিদিন ৮ ঘন্টার মতো ঘুমান। দিনের বেলায় হাঁটাহাটিও তাঁর নিত্যদিনের অভ্যাস। তার স্ত্রীর শরীরও মোটামুটি ভালো। তাঁরা একে অপরের যত্ন নেন। অবসরগ্রহণের পর প্রবীণদের বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি রান্নার কোর্স করেছেন। এখন ভালো রান্না করতে পারেন।

সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। সেখানে তিনি ছিলেন একজন কর্মকর্তা। কিন্তু, তিনি প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে অফিসে আসতেন। এই সেদিনও তিনি সাইকেল চালাতেন। কিন্তু, পরিবারের সদস্যরা তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে একসময় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং তাকে সাইকেল চালানো বন্ধ করতে হয়। জনাব স্যুর দৃষ্টিতে নিয়মিত শরীরচর্চা করলে, মন ফুরফুরে থাকে, জীবন আনন্দময় হয়, এবং দীর্ঘায়ু লাভ করা যায়।

যারা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ছাত্রঋণ পেয়েছেন, তাদের শুভকামনা করে তিনি বলেন, ‘যদিও আমি তাদের পড়াশোনার সহায়তায় টাকা দিয়েছি, তবে পত্রিকায় আমার নিজের নাম প্রকাশ করতে চাই না।’ শিক্ষার্থীরা শরীরের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার পাশাপাশি, ভালো করে পড়াশোনা করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। শিক্ষার্থীদের বাবা-মারও বাচ্চদের জন্য ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করা জরুরি বলে তিনি মনে করেন। কারণ, বাবা-মায়ের আচরণ আসলে তাদের কথার চেয়ে আরো বেশি কার্যকর।

জনাব ল্যু সি রং সড়ক ও সেতুর প্রকৌশলী, যিনি চলতি বছর অবসর নিয়েছেন। এবার তিনি আলো ছাত্রঋণ প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করে মোট ২০ হাজার ইউয়ান দান করেছেন। বস্তুত, ২০১১ সাল থেকে তিনি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা দিয়ে আসছেন। তিনি ইয়াংসি নাইট পত্রিকা থেকে সংশ্লিষ্ট দরিদ্র শিক্ষার্থীদের খোঁজ-খবর নেন এবং প্রথম বছর ৫০০০ ইউয়ান, দ্বিতীয় বছর ১০ হাজার ইউয়ান দান করেন। পরে, তিনি কয়েকজন দরিদ্র শিক্ষার্থীর সাথে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেন, তাদের পড়াশোনায় নির্দিষ্ট আর্থিক সহায়তা দেন। টানা কয়েক বছর ধরে ২ লাখেরও বেশি ইউয়ান দান করেছেন তিনি। ২০২২ সালে তাঁর সহায়তায় কয়েকজন শিক্ষার্থী স্নাতক হয়। তখন থেকে তিনি বার্ষিক ২০ হাজার ইউয়ান দিয়ে নতুন দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা দিচ্ছেন।

ল্যু বলেন, ‘চীনের বৈদেশিক উন্মুক্তকরণ ও সংস্কার নীতির কারণে আমার আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালো। দরিদ্র পরিবারের বাচ্চাদের দেখে মনে কষ্ট পাই। তাদের কিছু সহায়তা দেওয়া আমার জন্য খুশির ব্যাপার।’ ল্যুর স্ত্রী একজন কিন্টারগার্ডেন শিক্ষক। তিনি বেশ স্নেহময় ও নরম মানুষ। যখন টেলিভিশনে দরিদ্র পরিবারের বাচ্চাদের দেখেন, তখন তাদের আর্থিক সহায়তা দিতে চান।

চলতি বছর তাঁরা একসাথে ইউয়ুননান প্রদেশ ভ্রমণ করেছেন। তখন স্থানীয় পশুপালকের এক বাচ্চার সাথে পরিচয় হয় তাদের। ছেলেটির কাপড় বেশ পুরনো ছিল। তাঁরা ছেলের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুবিধার্থে তাকে ৮৮০০ ইউয়ান দান করার  সিদ্ধান্ত নেন। জনাব ল্যুর দৃষ্টিতে যথাযথভাবে দরিদ্র পরিবারের বাচ্চাদের সহায়তা দেওয়া বেশ তাত্পর্যপূর্ণ ব্যাপার। ১৯৮৩ সালে তিনি নানচিং শহরে পড়াশোনা করেছেন, তখন মাসিক খরচ ৩০ ইউয়ান ছিল। তার বাবা একজন কাঠমিস্ত্রী ছিলেন। মাসিক আয় ছিল মাত্র ২০ ইউয়ানেরও কিছু বেশি। তার পরিবারে আরও ৫ জন ভাই-বোন ছিল। তারা বাসায় কিছু টাকা পাঠাতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় ল্যু খেয়াল করতেন যে, ক্লাসের অন্য সহপাঠীদের কাপড়চোপড় বেশ দামি। তিনি বাবাকে চিঠি লিখে ৪০ ইউয়ানের একটি স্কি কাপড় কেনার আগ্রহ দেখান। জনাব ল্যু এ অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বলেন, ‘বাবা আমার চিঠির জবাব দিলেন এবং সাথে ৮০ ইউয়ান পাঠালেন। চিঠিতে বাবা লেখেন, ‘আমাদের পরিবারের একমাত্র শুকরটি জবাই করে তা ১২০ ইউয়ানে বিক্রি করা হয়েছে। ৮০ ইউয়ান তোমার পড়াশোনার খরচ। বাকি ৪০ ইউয়ান দিয়ে তুমি স্কি কাপড় কিনতে পারো’।” চিঠি পড়ে জনাব ল্যুর চোখে পানি এলো। ঘটনাটি তাঁর মনে গভীর দাগ কাটে। তখন থেকে তিনি আর বাবা-মায়ের কাছে টাকা চাননি এবং নিজেই বাবা হওয়ার পর কন্যাকে বলেন, যদিও পরিবারে আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালো, তবে অযথা অর্থ ব্যয় করা চলবে না।

জনাব ল্যু আশা করেন, দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা স্নাতক হওয়ার পর সাহসের সাথে বিশ্বের সামনে দাঁড়াবে। এটা জরুরি। তাদের চরিত্রগঠনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হলে মন ছোট করার কিছু নেই। স্নাতক হওয়ার পর যদি ভালো চাকরি পাওয়া যায়, তখন অযথা অর্থ ব্যয় করাও ঠিক না।

জনাব ল্যুর আশেপাশে আরও অনেক বন্ধু তাঁর মতো দান করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, দরিদ্র বাচ্চাদের সহায়তা করতে পারলে মনে বেশ আনন্দ পাওয়া যায়। এটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাত্পর্যপূর্ণ ব্যাপার।

সিনো আলো ছাত্রঋণের জন্য আবেদন করতে চাইলে শিক্ষার্থী সরাসরি নিজেই করতে পারেন। প্রতি বছরের অগাস্ট মাসে সংশ্লিষ্ট ছাত্রঋণ বিতরণ করা হয়। প্রত্যেকের জন্য ৫০০০ ইউয়ান। চলতি বছর চিয়াংসু প্রদেশের ছাত্রছাত্রীরা যদি তাদের কাওখাও পরীক্ষার স্কোর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পূর্বশর্ত পূরণ করতে পারে এবং তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল থাকে, তবে তাঁরা ছাত্রঋণের জন্য আবেদন করতে পারবে। অনাথ, পরিবারে বাবা-মা গুরুতর রোগে আক্রান্ত, বা প্রতিবন্ধীরাও সংশ্লিষ্ট ছাত্রঋণের জন্য আবেদন করতে পারে।

(সুবর্ণা/আলিম/রুবি)