বিশ্বে বেহালার প্রধান উত্পাদনকেন্দ্র চীনের হুয়াং ছিও
2024-06-27 15:21:25


জুন ২৭: চীনের চিয়াংসু প্রদেশের থাইশিং শহরের হুয়াং ছিও থানা ‘শাওপিং বা তিলের পিঠা’র কারণে বিখ্যাত। তবে, এই থানাটি নীরবে সঙ্গীতের সাথেও যুক্ত হয়। থানায় প্রায় প্রত্যেক লোক বেহালা বাজাতে পারেন এবং সেখানে সবচেয়ে জনপ্রিয় উপহার হলো বেহালা। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা একসঙ্গে চিয়াংসু প্রদেশের থাইশিং শহরের হুয়াং ছিও থানায় প্রবেশ করবো।

 

আজ হুয়াং ছিও বিশ্বের বেহালা উত্পাদনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এখানে ২০০টিরও বেশি বেহালা উত্পাদন ও সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান এবং ৩০ হাজারেরও বেশি কর্মচারী রয়েছে। প্রতিবছর ৭ লাখেরও বেশি বেহালা তৈরি হয় এখানে, যা চীনে উত্পাদিত মোট বেহালার ৭০ শতাংশ এবং বিশ্বে উত্পাদিত মোট বেহালার ৪০ শতাংশ। হুয়াং ছিও চীনে ‘বেহালার হোমটাউন’ নামে পরিচিত।

 

হুয়াং ছিও থানায় উত্পাদিত বেহালা বিদেশে রফতানি হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে সঙ্গীত অনুরাগীদের কাছে হুয়াং ছিও পরিচিতি লাভ করেছে। মস্কোতে বাদ্যযন্ত্রের দোকানের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ড্যানিয়ের গাবদ্রাশিমভ হুয়াং ছিওয়ের উত্পাদিত বেহালার খুব প্রশংসা করলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দোকানে চীনের চিয়াং সু হুয়াং ছিও থেকে বেহালা আসে। দাম বেশি নয়, অথচ সূক্ষ্মভাবে তৈরি। সেগুলোর মান উঁচু এবং টোনও খুব ভালো। টিউনিং পিনগুলো মাঝারিভাবে টাইট, তাই নতুনরাও সহজেই বাজাতে পারে।’

 

গাবদ্রাশিমভ আরও বলেন, ‘হুয়াং ছিওতে উত্পাদিত বেহালার প্রতিটি সেটে একটি কেস, একটি নম, ও রোসিন থাকে, যা সবই প্লাস পয়েন্ট। তাই এই বেহালা গ্রাহকদের কাছে সমাদৃত হচ্ছে।’

 

পশ্চিমা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতিনিধিত্বকারী যন্ত্র হিসেবে বেহালা কীভাবে পূর্ব চীনের এই ছোট্ট থানায় শিকড় গেড়েছে? গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে, বেইজিং ও শাংহাইসহ নানান স্থানে বেহালা তৈরির কারখানা গজিয়ে উঠতে থাকে। যারা শাংহাইয়ে বেহালা তৈরি করতেন, তাঁরাই যন্ত্রাংশের কারখানা স্থাপন করতে তাদের জন্মস্থান বা হুয়াং ছিও থানায় ফিরে আসেন। লি শু তাদের মধ্যে একজন। ৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে, হুয়াং ছিওয়ের প্রথম বেহালা তার হাতে তৈরি হয়েছিল। পরে লি শু ফেংলিং মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট গ্রুপ গড়ে তোলেন, যেটি এই এলাকার বৃহত্তম বেহালা তৈরির কারখানা।

 

লি শু বলেন, ‘আমাদের উত্পাদিত বেহালা যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, রাশিয়াসহ প্রায় ৯০টি দেশ ও অঞ্চলে রফতানি করা হয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগদানের পর থেকে, চীনের নির্মাণশিল্প দ্রুত গতিতে উন্নত হতে থাকে। চীনের সস্তা অথচ উন্নত মানের পণ্য দ্রুতই আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের স্থান করে নেয়। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি হুয়াং ছিওয়ের বেহালাকেও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলেছে। আমরা গবেষণা ও উদ্ভাবনের দিকে নজর দেই এবং নিজস্ব ব্র্যান্ড গড়ে তুলি। ধীরে ধীরে মধ্যম ও উচ্চশ্রেণীর বেহালা উত্পাদিত হতে থাকে এখানে।’

 

লি শু আরও বলেন, ‘একটি বেহালার শব্দ ভালো করতে এবং এর শুকিয়ে যাওয়া ও ফাটল রোধ করতে, কাঠকে ৫০ বছর ধরে বাতাসে শুকাতে হয়। এর ফলে এর মধ্যে থাকা জল, রজন ও অন্যান্য পদার্থ কমে যায়।’

 

হুয়াং ছিও-র বাসিন্দা সুই সিও ফোং একজন স্থানীয় সিনিয়র বেহালা প্রস্তুতকারক। তার মতে, উচ্চ মানের গবেষণার কারণেই হুয়াং ছিওয়ের বেহালা প্রায়শই আন্তর্জাতিক বাদ্যযন্ত্র প্রদর্শনীর বুথগুলোর শোভা বাড়াতে পারে। সুই সিও ফোং বলেন, ‘একটি বেহালা তৈরি করতে প্রায় ২০০টি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। উপকরণ নির্বাচন থেকে শুরু হয়। তারপর, প্রতিটি বেহালার বোর্ড হাত দিয়ে কাটা হয়, বেহালার মধ্যে গর্তও সৃষ্টি করা হয় হাতে ড্রিল করে। বেহালার কারুকার্যের দিক থেকে চিন্তা করলে, হাতে তৈরি ও মেশিনে তৈরি বেহালার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। বেহালার বোর্ডের কনফিগারেশন, হেডস্টকের উত্পাদন, স্পিকার এবং সাউন্ডবোর্ডের সামঞ্জস্য এবং টোন সবই ভিন্ন।’

 

সুই সিও ফোং বলেন, “আমাদের তৈরি বেহালা বিদেশী গ্রাহকের হাতে পৌঁছানোর পর তিনি যখন তা বাজাতে শুরু করবেন, তখন তার প্রথম প্রতিক্রিয়া হবে: ‘এটি এতো ভালো যে কল্পনার বাইরে’।”

 

সুই সিও ফোং নিজের জন্মস্থানে বেহালা তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন, স্থানীয় বেহালা তৈরির কোম্পানিগুলোর জন্য প্রযুক্তিগত নির্দেশিকা প্রদান করছেন, এবং শত শত বেহালা প্রস্তুতকারককে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ও দিচ্ছেন।

 

বাদ্যযন্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগিতা-ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য, স্থানীয় সরকার প্রযুক্তি, প্রতিভা ও ব্র্যান্ড তৈরির ক্ষেত্রে সমর্থনের মাত্রা বাড়িয়েছে। নিয়মিতভাবে দেশীয় ও বিদেশী বাণিজ্য মেলা এবং এক্সপোতে অংশগ্রহণের জন্য স্থানীয় বাদ্যযন্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংগঠিত করা হয়। পাশাপাশি, বাদ্যযন্ত্র বিক্রির চ্যানেল বিস্তৃত করা হচ্ছে এবং একই সাথে জোরালোভাবে সঙ্গীতশিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে, যাতে বেহালা শুধুমাত্র মানুষের ‘মানিব্যাগ’ সমৃদ্ধ না করে, বরং তাদের আধ্যাত্মিক জীবনকেও সমৃদ্ধ করতে পারে।

 

হুয়াং ছিও থানা স্থানীয় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাদ্যযন্ত্র শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। স্থানীয় বেহালার শিক্ষক ছিয়েন হুই বলেন, “প্রাথমিক স্কুলে প্রথম শ্রেণী থেকে শিক্ষার্থীরা বেহালা শিখতে শুরু করে। জন্মগ্রহণের পর এখানকার অনেক শিশুর প্রথম খেলনা হয় বেহালা। তাঁরা সংগীত শেখার প্রক্রিয়ায় নিজেদের শখ তৈরি করে এবং নিজস্ব অনুভূতি গড়ে তোলে। অনেক শিক্ষার্থী পরবর্তীতে পেশাদার সঙ্গীতের পথে যাত্রা শুরু করে এবং দেশে-বিদেশে সুপরিচিত সঙ্গীত বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে।”

 

হুয়াং ছিওয়ের গভীর সঙ্গীত পরিবেশ বিপুলসংখ্যক দেশী- বিদেশী সংগীতশিল্পী, অর্কেস্ট্রা এবং সংগীতপ্রেমীকে আকৃষ্ট করেছে ও করছে। ২০২৩ সালে, হুয়াং ছিও থানাকে চীনে আন্তর্জাতিক বাদ্যযন্ত্র পারফরম্যান্স দিবসের স্থায়ী হোস্ট ভেন্যু হিসেবে মনোনীত করা হয়। (লিলি/আলিম/স্বর্ণা)