এক শ বছর আগে, ভারতীয় কবি ও সাহিত্যিক এবং ‘বিশ্বকবি’ নামে পরিচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রথমবারের মতো চীন সফর করেন। চীন ও ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ইতিহাসের সেই বিস্ময়কর পর্বটি আজও মানুষ স্মরণ করে।
১৯২৪ সালের ১২ থেকে ৩০ এপ্রিল, লিয়াং ছি ছাও, ছাই ইউয়ান ফেই এবং চীনের অন্যান্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের আমন্ত্রণে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে একটি ভারতীয় প্রতিনিধিদল হাংচৌ, নানচিং, বেইজিংসহ বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন। যাওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন, এই সফরের রাজনীতি বা ব্যবসায়ের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। ভারত ও চীনের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়কে পুনরুজ্জীবিত করাই ছিল সফরের লক্ষ্য।
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, ভারত একটি ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। আফিম যুদ্ধের পর, চীন ধীরে ধীরে একটি আধা-ঔপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক দেশ হয়ে যায় এবং পশ্চিমা ঔপনিবেশিকতা চীন-ভারত সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
"বলা যায় যে, চীন ও ভারতের মধ্যে আধুনিক কালে সাংস্কৃতিক বিনিময় শুরু হয়েছিল ১৯২৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চীন সফরের মাধ্যমে," চিয়াং চিং খুই, চীন সোসাইটি অফ সাউথ এশিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেজের সভাপতি এবং সিংহুয়া ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড এশিয়া স্টাডিজের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট সাংবাদিককে এ কথা বলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতে ফিরে যাওয়ার পর, চীন ও ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, দুটি দেশ পর্যায়ক্রমে "চীন-ইন্ডিয়া সোসাইটি" প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৩৭ সালে বিশ্বভারতীতে চীনাভবনও প্রতিষ্ঠিত হয়।
"আজ একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মহান দিন," রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চীনাভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছিলেন। তিনি বলেন, "ভারতীয় জনগণের পক্ষে, আমি একটি প্রাচীন শপথের কথা বলতে পারি, যা অতীতের গর্ভে হারিয়ে গেছে: সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বকে সুসংহত করা হবে।" চীনাভবন প্রতিষ্ঠার পর, অনেক চীনা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব- ছি পাই শি, সুই পেই হং, সুই চি মো, প্রমুখ এখানে আসেন।
"চীনা ও ভারতীয় শিক্ষাবিদদের অধ্যয়ন, চীনা ও ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে যোগাযোগ, চীনা ও ভারতীয় অনুভূতির মধ্যে সমন্বয়সাধন, চীনা ও ভারতীয় জাতিকে একত্রিত করা, বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, এবং বিশ্বে সম্প্রীতি প্রচার করা” ছিল চীনাভবন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য। পরবর্তীতে চীনাভবন হয়ে ওঠে ভারতে চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি জানা প্রতিভা সৃষ্টির কারখানা। ২০১৪ সালে, চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, চীনাভবনকে ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও বন্ধুত্বের পাঁচ নীতি’ পুরস্কারে ভূষিত করেন।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার মধ্যে ভয়ানক সংঘাতের যুগে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্প্রীতি ও সংলাপের জন্য কাজ করেছিলেন। তিনি চীনে এসে প্রাচ্য সভ্যতার পক্ষে কথা বলতে চেয়েছিলেন।
১৮৮১ সালে, ২০ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চীনা জনগণের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ব্রিটিশ আফিম ব্যবসার বিরুদ্ধে নিবন্ধ লিখেছিলেন। ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের একজন গুরু চি শিয়ান লিন বলেন, চীন ও ভারতের হাজার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক বিনিময় ও পারস্পরিক শিক্ষার ইতিহাস রয়েছে, যা একে অপরের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। আধুনিক কাল থেকে উভয় দেশের জনগণ পশ্চিমা উপনিবেশবাদের শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। "একে অপরের ভাগ্য সম্পর্কে আমাদের উদ্বেগ সম্পূর্ণরূপে বোধগম্য”, তিনি বলেন।
সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বক্তৃতায়, রবীঠাকুর তরুণদের কাছে আবেদন করেছিলেন এইভাবে: "মানবসভ্যতা একটি মহান পরিপূর্ণতার জন্য অপেক্ষা করছে; তার আত্মার শুদ্ধতা ও সুন্দর অভিব্যক্তির জন্য অপেক্ষা করছে। এটি আপনাদের দায়িত্ব, এবং এ ব্যাপারে আপনাদের উচিত যথাসাধ্য চেষ্টা করে ইতিবাচক অবদান রাখা।"
অধ্যাপক চিয়াং চিং খুই বলেন, রবীন্দ্রনাথ যখন চীন সফর করেছিলেন, তখন বিশ্বসভ্যতা ভারসাম্যহীন ছিল ও পশ্চিমা সভ্যতা প্রাচ্যের সভ্যতাকে পিষে ফেলছিল। পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, সম্পদ লুঠ করা ও প্রাচ্যের সভ্যতার সামনে পশ্চিমা সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, চীনা সভ্যতা ও ভারতীয় সভ্যতার মধ্যে মিল রয়েছে এবং তারা ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং বিশ্ব সভ্যতায় শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে। "তিনি জোর গলায় বলেছিলেন, চীনা যুবকদের দায়িত্ববোধ আছে এবং ভবিষ্যতে পশ্চিমা সভ্যতার সামনে দাঁড়ানোর জন্য প্রাচ্যের সভ্যতা তাদের ওপর নির্ভর করবে।"
চীন ও ভারত একে অপরের প্রতিবেশী এবং বিশ্বের দুটি বৃহত্তম উন্নয়নশীল দেশ ও উদীয়মান বাজার। দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্কের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিছু পর্যবেক্ষক উল্লেখ করেছেন যে, একে অপরের দৃষ্টিতে, চীন ও ভারতের চিত্রটির বেশিরভাগই পশ্চিমা আখ্যান দ্বারা তৈরি এবং আলোচনা প্রায়শই বাস্তব রাজনৈতিক ও সংকীর্ণ স্বার্থের ওপর ফোকাস করে। দু’দেশের মধ্যে ব্যাপক সংলাপ ও সংযোগ তাই জরুরি।
চিয়াং চিং খুই বিশ্বাস করেন, চীন ও ভারতের জনগণের মধ্যে এখনও পারস্পরিক সমঝোতার ক্ষেত্রে ‘বিশাল তফাত’ রয়েছে। "বিশ্ব সভ্যতা বৈচিত্র্যময়, এবং উভয় পক্ষেরই একে অপরকে সম্মান করা উচিত, একে অপরকে সমান হিসাবে বিবেচনা করা উচিত, একে অপরকে সহনশীলতার সাথে দেখা উচিত এবং উভয় পক্ষের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যগুলোকে সঠিকভাবে হ্যান্ডেল করা উচিত।"
ভারতের বিশ্বভারতীর চীনাভবনের অধ্যক্ষ অধ্যাপক অভিজাত ব্যানার্জী বলেন, ভারত ও চীনের মানুষ একে অপরের সম্পর্কে কৌতূহলী, তবে কখনও কখনও তৃতীয় দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর মাধ্যমে তথ্য পাওয়া সহজে ভুল বোঝাবুঝির কারণ হতে পারে। "ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে এবং বোঝাপড়া বাড়ানোর জন্য, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সরাসরি যোগাযোগ বাড়ানো।"
"আজ, আমি দেখতে পাচ্ছি যে, চীনে অনেক লোক এখনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তাভাবনা অধ্যয়ন করছেন এবং তার কবিতা আবৃত্তি করছেন," অধ্যাপক অভিজাত ব্যানার্জী বলেন। শত বছর আগেকার সেই সফরটি আমরা এখনও স্মরণ করছি, কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দু’দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন সৃষ্টি করেছিলেন এবং দুই দেশের মানুষকে কাছাকাছি আনতে পেরেছিলেন। (স্বর্ণা/আলিম)