বিজ্ঞানবিশ্ব ৭৬তম পর্ব
2024-06-25 00:53:30

চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব ৭৬তম পর্বে যা থাকছে:

 


১। অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম মানুষের বয়স নিয়ন্ত্রণ করে

২। বন্যধানের জিন সনাক্তে নতুন প্লাটফর্ম তৈরি

৩। নতুন সাফল্যের দিগন্তে চীনের ‘কৃত্রিম সূর্য’


অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম মানুষের বয়স নিয়ন্ত্রণ করে

মানুষের দেহের বয়স নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম। এছাড়া বিপাকীয় ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ, সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনযাপনে মাইক্রোবায়োমের প্রভাব রয়েছে বলেও উঠে এসেছে চীনা বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায়। শাংহাই চিয়াও থোং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন রুইচিন হাসপাতাল এবং বিজিআই রিসার্চের গবেষকরা যৌথভাবে এ গবেষণাটি করেছেন।

 

নেচার মেডিসিন জার্নালে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষণাটিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি উঠে এসেছে সেটি হলো- অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম, বিপাকীয় ক্রিয়া এবং বয়সের মধ্যে সম্পর্ক জানা। এই সম্পর্ক বুঝতে পারলে মানুষ সুস্থ ও দীর্ঘজীবন লাভের জন্য বিশেষ পদ্ধতি গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

গাট মাইক্রোবায়োম হলো মানুষের অন্ত্রের ভেতর বসবাসকারী অসংখ্য জীবের সমষ্টি। এই জীবগুলোর মধ্যে রয়েছে- ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ভাইরাস এবং আর্কিয়া।

গবেষকরা ৪০ থেকে ৯৩ বছর বয়সী ১০ হাজার ২০৭ জনের উপর গবেষণা চালিয়েছেন। ২১টি মেটাবলিক প্যারামিটার ব্যবহার করে তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষকরা অংশগ্রহণকারীদেরকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন। এই ভাগগুলোকে বলা হয় ‘মেটাবলিক মাল্টিমোরবিডিটি ক্লাস্টার’, যা বিভিন্ন ধরণের মেটাবলিক সাবফেনোটাইপসের প্রতিনিধিত্ব করে।

 

বিপাকীয়ভাবে সুস্থ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ ক্লাস্টারের তুলনায় স্থূলতা-সম্পর্কিত মিশ্র এবং হাইপারগ্লাইসেমিয়া হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ ক্লাস্টারের ক্ষেত্রে হৃদরোগের ঝুঁকি যথাক্রমে ৭৫ শতাংশ এবং ১১৭ শতাংশ বেশি। তাদের প্রাপ্ত এই ফলাফল অপর এক গবেষণাও পাওয়া গেছে। ৯ হাজার ৬১ জনকে ১০ বছর পর্যবেক্ষণ করার পর ওই গবেষণায় এমন ফলাফল পওয়া গেছে।

এলোমেলোভাবে নির্বাচিত ৪ হাজার ৪৯১ ব্যক্তির মল মেটাজেনমিক ডেটার তথ্য বিশ্লেষণে গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, অন্ত্রের মাইক্রোবের গঠন মেটাবলিক মাল্টিমোরবিডিটি ক্লাস্টার এবং বয়সের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

৬০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে স্থূলতা-সম্পর্কিত মিশ্র এবং হাইপারগ্লাইসেমিয়া ক্লাস্টারের সঙ্গে যুক্ত হৃদরোগের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায় যদি সেই ব্যক্তির অন্ত্রের মাইক্রোবের বয়স বেশি হয়। অন্যদিকে যদি অন্ত্রের মাইক্রোবের বয়স কম হয় তাহলে এই ঝুঁকি কমে যায়। বয়স, লিঙ্গ, জীবনযাপন পদ্ধতি এবং খাদ্যাভ্যাসের মতো বিষয়গুলো এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে না।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মেটাবলিজম ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এর ফলে ওজন বৃদ্ধি, ক্লান্তি, পেশী ক্ষয় এবং বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে পারে। এই গবেষণার ফলাফল থেকে বোঝা যায় অন্ত্রের মাইক্রোবের বয়স হৃদরোগের ঝুঁকি পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হতে পারে।

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা:  ফয়সল আবদুল্লাহ


বন্যধানের জিন সনাক্তে নতুন প্লাটফর্ম তৈরি


বন্যধানের জার্মপ্লাজম থেকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জিন আবিষ্কার, ব্যবহার এবং উদ্ভাবনের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন চীনা গবেষকরা। প্ল্যাটফর্মটি ধানের জাত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ জিন খুঁজে বের করতে সহায়তা করবে। চীনের কৃষি বিজ্ঞান একাডেমি এসব তথ্য জানিয়েছে।


জার্মপ্লাজম হলো জীবের বংশগত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে এমন জিনগত বৈশিষ্ট্যের সমষ্টি।

 


পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ অ্যাডভান্সড এগ্রিকালচারাল সায়েন্সেস এবং চীনের কৃষি বিজ্ঞান একাডেমির গবেষকরা যৌথভাবে এ গবেষণাটি পরিচালনা করেছে। গবেষণাটি নেচার কমিউনিকেশন জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে।


বর্তমানে চাষের ধানের জাতগুলো বন্যধান থেকেই উদ্ভূত। এসব বন্যধানের জিনগত বৈচিত্র্য অনেক বেশি, যা ধানের গুনমান উন্নত করার পাশাপাশি বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্রে খুবই মূল্যবান। অর্থাৎ বন্যধানের জিনগত বৈচিত্র্য ধানের ফলন বৃদ্ধি, রোগ ও পোকামাকড় দমন এবং খাদ্যের গুণমান উন্নত করার মতো কাজে লাগতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত এসব বন্যধানের জিনোমের পুরোপুরি ম্যাপ তৈরি করা হয়নি।


এ গবেষণায় চীনা গবেষকরা চীনের বন্যধান হিসেবে ব্যাপক পরিচিত ওয়াই৪৭৬ জাত নিয়ে গবেষণা করেছেন। এই ধানের বিভিন্ন রোগ-বালাই প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অনেক বেশি। গবেষকরা প্রথমবারের মতো ওয়াই৪৭৬ ধানের জিনোম মানচিত্র আঁকতে সক্ষম হয়েছেন। এটি করতে তারা হ্যাপ্লোটাইপ-সমাধান করা গ্যাপলেস ক্রোমোজোম haplotype-resolved gapless chromosome genome জিনোম কৌশল ব্যবহার করেছেন। এই গবেষণা ধানের আরও উন্নত জাত উদ্ভাবনে সাহায্য করবে।


গবেষণা দলটির গবেষক ইয়াং চিংওয়েন জানান, এই প্ল্যাটফর্মটি বন্যধানে কার্যকরী জিনোমিক্স গবেষণাকে ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি ধানের জিনগত সম্পদ ব্যবহার করে জাতগুলোর উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।


গবেষকরা ওয়াই৪৭৬ জাতের বন্যধানকে জিন দেওয়া পিতামাতা এবং চাষ করা ধানকে জিন নেওয়া জাত হিসেবে ব্যবহার করে ক্রোমোজোম সেগমেন্ট সাবস্টিটিউশন লাইন এর দুটি সেট তৈরি করেছেন। এছাড়া তারা একটি পদ্ধতি তৈরি করেছেন যা বন্যধানের মধ্যে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জিনগুলো দ্রুত এবং সহজে খুঁজে বের করতে পারে।


এই গবেষণাটি খাদ্য নিরাপত্তা এবং টেকসই কৃষির জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা গবেষকদের। ধান বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য। বন্যধানের জিন থেকে উদ্ভূত নতুন জাতগুলো ধানের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং কৃষকদের জীবিকা উন্নত করতেও ভূমিকা রাখবে।


|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা:  ফয়সল আবদুল্লাহ


নতুন সাফল্যের দিগন্তে চীনের ‘কৃত্রিম সূর্য’

চীনের নতুন প্রজন্মের ‘কৃত্রিম সূর্য’ প্রকল্প ‘হুয়ানলিউ-৩ (এইচএল-৩)’। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে আরও একধাপ এগিয়ে গেলো। এবারে নিউক্লিয়ার ফিউশন নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। বিশ্বে প্রথমবারের মতো বিশেষ ধরনের অ্যাডভান্সড ম্যাগনেটিক ফিল্ড স্ট্রাকচার আবিষ্কার এবং তৈরির ফলে এটি সম্ভব হয়েছে। দেশটির বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা সংস্থা চায়না ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার কর্পোরেশন (সিএনএনসি) এসব তথ্য জানিয়েছে।

এইচএল-৩ প্রকল্পটি সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে বাস্তবায়ন করছে চীন। এটি নিউক্লিয়ার ফিউশন নিয়ন্ত্রণের একটি বৃহৎ গবেষণা। প্রকল্পটিকে ‘কৃত্রিম সূর্য’ বলা হয় কারণ সূর্যের ভেতরে যেভাবে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রিত নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন হয় ঠিক একই নীতির ভিত্তিতে কৃত্রিম এ সূর্যের মধ্যে শক্তি উৎপন্ন হবে।

 

২০২৩ সালের শেষের দিকে এইচএল-৩ প্রকল্পে যৌথ গবেষণার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এরপর বিশ্বে প্রথমবারের মতো কোনও গবেষণা কার্যক্রমে ফ্রান্সের বিকল্প শক্তি ও পারমাণবিক শক্তি কমিশন (CEA) এবং জাপানের কিওটো বিশ্ববিদ্যালয়সহ ১৭টি খ্যাতনামা গবেষণা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণ করে।

দেশগুলো আশা করছে সৌরশক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিপুল পরিমাণ পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব হবে। বিজ্ঞানী ও গবেষকরা মূলত নিউক্লিয়ার ফিউশন ব্যবহার করে এই কাজটি করছেন।

এই প্রক্রিয়ায় পারমাণবিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে বেশ কিছু হালকা নিউক্লিয়াসকে একত্রিত করে একটি অপেক্ষাকৃত ভারী নিউক্লিয়াস তৈরি হয়। এছাড়াও, এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর শক্তির সৃষ্টি হয়। ওই বিজ্ঞানীরা মূলত সূর্যের নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ার অনুকরণ করছেন। সূর্য এবং অন্যান্য নক্ষত্র এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের শক্তি তৈরি করে। 

এই গবেষণায় বিশেষ ধরনের অ্যাডভান্সড ম্যাগনেটিক ফিল্ড স্ট্রাকচারটি বিশ্বে প্রথমবারের মতো আবিষ্কৃত এবং তৈরি করা হয়েছে।

চায়না ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার কর্পোরেশনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় পদার্থবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের গবেষক লি পো জানান, তারা যে বিশেষ ধরনের অ্যাডভান্সড ম্যাগনেটিক ফিল্ড স্ট্রাকচারটি তৈরি করেছে, তা আরও কার্যকরভাবে তাপ ছড়িয়ে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ফিউশন রিঅ্যাকশনের সময় উৎপন্ন উচ্চ-শক্তি সম্পন্ন কণাগুলোকে বিশেষ 'লেন' দিয়ে নিষ্কাশন করতে হয়। আগে কেবল দুটি লেন ছিল। নতুন ম্যাগনেটিক ফিল্ড স্ট্রাকচারটিতে 'চারটি লেন' রয়েছে, যা কণাগুলোকে 'জ্যাম' ছাড়াই দ্রুত এবং মসৃণভাবে চলাচলের সুযোগ করে দেয়।

 

নিয়ন্ত্রিত নিউক্লিয়ার ফিউশন একধরণের উন্নত প্রযুক্তি, যার সুবিধা হল প্রচুর মাত্রার জ্বালানী সম্পদ ও পরিবেশবান্ধব হওয়া। এটি জ্বালানি সমস্যা মোকাবিলায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি বলে বিবেচিত হয়।

চীনের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ নিউক্লিয়ার ফিউশন থেকে প্রাপ্ত শক্তি আমাদের কাজে লাগানো সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

যদিও এখনও এই তাপমাত্রা বা শক্তিকে কীভাবে মওজুদ করা যায়, তা এখনো অধরা বিজ্ঞানীদের কাছে। তাদের আরও দাবী পৃথিবীতে যে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তির চাহিদা রয়েছে, তা মেটাতেই এই গবেষণা। কারণ গবেষণাগারে যে বিপুল পরিমাণ তাপমাত্রা তৈরি হয়েছে, তার সাহায্যে ১০ মিলিয়ন ওয়াট বিদ্যুৎশক্তি পাওয়া যেতে পারে। 

 

পারমাণবিক ফিউশন শক্তির বিকাশ যে শুধুমাত্র চীনের কৌশলগত শক্তির চাহিদার সমাধান করবে তা-ই নয়, ভবিষ্যতে চীনসহ পুরো পৃথিবীর জ্বালানি ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা:  ফয়সল আবদুল্লাহ

নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।



প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার


অডিও সম্পাদনা- নাসরুল্লাহ রাসু


স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- ফয়সল আবদুল্লাহ

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী