হাজার বছর আগের কাগজ থেকে শুরু করে আজকের প্যাসেঞ্জার ড্রোন, কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে চলেছে চীনের শক্তিশালী এসব আবিষ্কারের হাত ধরে। নানা সময়ে দারুণ সব আবিষ্কার করে আধুনিক সভ্যতার ভিত গড়ে দিয়েছে চীন। আর সেই সব আবিষ্কার নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন মেড ইন চায়না।
মেড ইন চায়নার দ্বিতীয় পর্বে সাথে আছি আমি ফয়সল আবদুল্লাহ... আজকের পর্বে থাকছে চীনের আবিষ্কার প্যাসেঞ্জার ড্রোনের কথা।
ড্রোন। দুই দশক আগেও এই ড্রোন শব্দটার সঙ্গে চলে আসতো আরেকটা শব্দ, আর তা হলো হামলা। ড্রোন মানেই যেন এক ভয়ানক যুদ্ধাস্ত্র। বিশেষ করে একটা সময় পশ্চিমাদের ড্রোন হামলার খবর পাওয়া যেত প্রায় প্রতিদিনই। নানা ধরনের আগ্রাসনের অন্যতম অস্ত্র ছিল এই ড্রোন। কিন্তু ড্রোনের সেই ভাবমূর্তি বদলেছে। ড্রোন মানেই এখন ভয়ানক কিছু নয়। ড্রোন এখন উন্নয়নেরও প্রতীক।
এই উড়োযানটিকে মানবকল্যাণে ব্যবহারে নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহন, এমনকি ড্রোন দিয়ে যে সহজে যাত্রী পারাপারও করা যায়, বিশ্ববাসীকে সেই ধারণাও কিন্তু প্রথম দিয়েছে চীন। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় যাত্রীবাহী ড্রোন আপাদমস্তক মেড ইন চায়না।
চীনের অর্থনীতিতে ইদানিং যুক্ত হয়েছে একটি নতুন নাম। যাকে ইংরেজিতে বলা হচ্ছে লো আলটিচিউড ইকনোমি। অর্থাৎ অল্প উচ্চতার আকাশকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে একটি বিশেষ অর্থনীতি। আর এ অর্থনীতির কেন্দ্রে আছে ড্রোন। সম্প্রতি এই খাতে চমক দেখিয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠান ই-হাং। কারণ এ প্রতিষ্ঠানই তৈরি করেছে বিশ্বের প্রথম প্যাসেঞ্জার ড্রোন।
২০১৬ সালের একটি কনজুমার ইলেকট্রনিক শো’তে ইহাং সবাইকে দেখিয়েছিল তাদের ইহাং-১৮৪ মডেলের যাত্রীবাহী ড্রোন। ২০২৩ সালের অক্টোবরে তারা তৈরি করে ইএইচ-২১৬ এস নামের আরেকটি আরও উন্নতমানের যাত্রীবাহী ড্রোন। যা কিনা চীনের সিভিল অ্যাভিয়েশন প্রশাসনের সনদও পেয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্য থিয়ানসিন সিসিটিভিকে বলেছেন, ইএইচ-২১৬এস হলো আকাশ-ট্যাক্সির ভবিষ্যৎ। অর্থাৎ নিকট ভবিষ্যতে মানুষ স্বল্প উচ্চতার আকাশেই ড্রোন ভাড়া নিয়ে উড়ে বেড়াবে।
ইএইচ ২১৬ এর ওজন মাত্র ৪৩০ কেজি। আকাশযান হিসেবে বেশ হালকাই বলা যায় এটাকে।
ওজন কমানোর জন্য প্যাসেঞ্জার ড্রোনটির পেছনের অংশ তৈরি করা হয়েছে কার্বন ফাইবার দিয়ে। যার নকশা পুরোপুরি চীনের তৈরি।
অনুষ্ঠানের এই ফাঁকে জেনে নেওয়া যাক চীনের যাত্রীবাহী ড্রোন নিয়ে কিছু তথ্য
· ব্যস্ত শহরে ৩০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে যেখানে আধা ঘণ্টা লেগে যায়, সেখানে যাত্রীবাহী ড্রোনের লাগবে বড়জোর দশ-বারো মিনিট।
· ইহাংয়ের তৈরি ইএইচ-২১৬ এস ড্রোনটি অপেক্ষাকৃত কম জায়গা নেয়। তবে ড্রোনটার ভেতরে বসলে মনে হবে এটা বেশ বড়সড়। এমনকি চাইলে পা ছড়িয়েও বসতে পারবে যে কেউ।
· ইহাংয়ের ড্রোনগুলো ইতোমধ্যেই ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে মোট ৪২ হাজার সফল ফ্লাইট সম্পন্ন করেছে।
· ড্রোনটির শব্দদূষণ কমানো ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। তবে কারিগরি উন্নয়নের পর গতানুগতিক এয়ারক্রাফটগুলোর তুলনায় এতে শব্দ বেশ কম হয়।
· এ ধরনের আকাশযান বড় বড় ভবনের অগ্নিনির্বাপণেও চমৎকার কাজে আসবে। আবার যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ ধরনের প্যাসেঞ্জার ড্রোনে করে বয়ে নেওয়া যাবে আড়াইশ কেজি পর্যন্ত সরঞ্জাম।
এবার আসা যাক প্যাসেঞ্জার ড্রোনের নিরাপত্তার প্রসঙ্গে
আকাশে ড্রোন ওড়ানো আর সেই ড্রোনে নিজেই উড়ে বেড়ানোর মধ্যে তফাৎ আছে আকাশ-পাতাল। মাঝপথে ব্যাটারি ফুরিয়ে গেলে কী হবে? কোনো যন্ত্রাংশ উল্টোপাল্টা আচরণ করলেই বা কী ঘটবে। এ সবই আগে থেকে ভেবে রেখেছে ই হাং। আর তাই বিশ্বের প্রথম যাত্রীবাহী ড্রোনে আছে একগাদা নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ইহাংয়ের ওয়েবসাইটেই জানা গেল এ ব্যবস্থা সম্পর্কে।
জিপিএস মোডে থাকা ড্রোনটি লো ব্যাটারির সংকেত পাওয়া মাত্রই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিরে আসবে এবং ব্যাটারি কম হলে যাত্রা শুরুর স্থানেই থাকবে এবং ধীরে ধীরে নেমে আসবে। মোটকথা, ব্যাটারির চার্জ কতটুকু বাকি আছে সেটা দেখে সেই অনুযায়ী জিপিএস সিস্টেমের সংকেত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে ড্রোন।
পরিবেশ সংক্রান্ত যেকোন জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে, কমান্ড-এন্ড-কন্ট্রোল সেন্টার ইন-ফ্লাইট ড্রোনে একটি আগাম সতর্ক সংকেত পাঠাবে এবং বাস্তব পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে ব্যবস্থা নিতে পারবে।
কমান্ড-এন্ড-কন্ট্রোল সেন্টারে একটি ভিজ্যুয়ালাইজড প্ল্যাটফর্ম রয়েছে যাতে ব্যাটারির চার্জ, ফ্লাইটের উচ্চতা, গতি, অবস্থান ইত্যাদির রিয়েল-টাইম ডেটা দেখা যাবে। আবার গ্রাউন্ড কন্ট্রোল তথা নিচে থাকা কর্মী ও উড়তে থাকা যাত্রীর মধ্যে রিয়েল-টাইম ভিডিও/অডিও যোগাযোগও করতে পারবে এটি।
তাছাড়া এ ধরনের ড্রোনের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ শুধু যে চালক বা যাত্রীর হাতে থাকবে, তেমন নয়। যাত্রীবাহী ড্রোনে থাকছে গ্রাউন্ড কন্ট্রোল ব্যবস্থা। অর্থাৎ জরুরি পরিস্থিতিতে নিচে থেকেও রিমোট কন্ট্রোলারের সাহায্যে ওড়ানো যাবে প্যাসেঞ্জার ড্রোন।
ওড়ার আগেই নির্ধারিত ফ্লাইট রুটে জরিপ চালাবে ইহাং এবং ব্যবহারকারীদের জন্য বিভিন্ন সম্ভাব্য পরিকল্পনার সেট তৈরি করে রাখবে।
মসৃণ যোগাযোগ নিশ্চিত করতে এ ধরনের ড্রোনে থাকছে সার্বক্ষণিক 4G/5G হাই-স্পিড ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক।
আবার চীনের তৈরি এ ধরনের প্যাসেঞ্জার ড্রোনে আছে ফেইল-সেইফ নিরাপত্তা ব্যবস্থা তথা সুরক্ষা পরিকল্পনা। এর সিস্টেম আকাশে অন্য উড়োযানের গতিবিধি দেখতে পারে। তা ছাড়া, নিজের সব যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা জানতে পারে সেটাও।
ইতোমধ্যে ইহাংয়ের যাত্রীবাহী ড্রোনগুলোকে যেতে হয়েছে শত শত পরীক্ষার ভেতর। পরীক্ষার লম্বা তালিকায় আছে, স্ট্যাটিক টেস্ট, লোড গ্রাউন্ড টেস্ট, লোড ফ্লাইট টেস্ট, স্থায়িত্ব, প্রতিকূল পরিবেশ, নির্ভরযোগ্যতা পরীক্ষা, পরিবেশগত পরীক্ষা ইত্যাদি
উচ্চ/নিম্ন তাপমাত্রা, উচ্চ আর্দ্রতা, টাইফুন, বৃষ্টিপাত এসব পরিস্থিতিতেও উতরে গেছে ইহাংয়ের ড্রোন। পেয়েছে AS9100D ইন্টারন্যাশনাল এরোস্পেস এবং এভিয়েশন কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম স্ট্যান্ডার্ডের প্রশংসাপত্র।
এবার জানা যাক ইহাংয়ের প্যাসেঞ্জার ড্রোনের কিছু কারিগরি তথ্য
· ইহাং ২১৬ এস মডেলের যাত্রীবাহী ড্রোনটিতে আছে দুটি আসন এবং ১৬টি প্রপেলারযুক্ত কোঅ্যাক্সিয়াল ডাবল-বেইলড ডিজাইন।
· ড্রোনটি ২০১৮ সালের জুলাইয়ের মধ্যে প্রায় এক হাজার পরীক্ষামূলক মনুষ্যবাহী ফ্লাইট সম্পন্ন করেছে।
· ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৩০ কিলোমিটার বেড়ে উড়তে পারবে ইহাং ২১৬ এস।
· ড্রোনটি ২৫ মিনিটে ৩০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে পারছে।
· ড্রোনটির ব্যাটারি সম্পূর্ণ চার্জ হতে সময় নেবে মাত্র দুই ঘণ্টা।
শেষ করছি চীনের প্যাসেঞ্জার ড্রোনের ব্যবসাপাতির তথ্য জানিয়ে
স্বল্প উচ্চতার আকাশে এ ধরনের যানকে ঘিরে কুয়াংচৌতে এখন এক ধরনের সরবরাহ চেইন শিল্প গড়ে উঠেছে। গতবছরের শেষে যে বাজারের বিস্তৃতি ছিল প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ইউয়ান।
২০৩০ সালের মধ্যে চীনে যাত্রীবাহী প্যাসেঞ্জারের বাজার দাঁড়াবে ২ ট্রিলিয়ন ইউয়ানে।
অচিরেই দেখা যাবে, চীনের দেখানো স্বল্প উচ্চতার এই আকাশ অর্থনীতির হাত ধরেই বদলে যাবে গোটা বিশ্বের মানুষের জীবন, যোগাযোগ ও নগর ব্যবস্থাপনার চালচিত্র।
সুপ্রিয় শ্রোতা আজকের মেড ইন চায়না ছিল এ পর্যন্তই। আগামী পর্বে আবার আসবো চীনের সাড়া জাগানো আরেকটি আবিষ্কারের গল্প নিয়ে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।
গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ
সার্বিক তত্ত্বাবধান: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী