জাপানি গাড়ির কোম্পানির তথ্য-জালিয়াতি; মাথা নত করে আস্থা ফেরানো কঠিন: সিএমজি সম্পাদকীয়
2024-06-07 13:11:50

জুন ৭: বৃহস্পতিবার ভোরে জাপানি টিভি স্টেশনগুলোয় একটি দৃশ্য দেখা যায়। জাপানের কিছু কর্মী উদ্বিগ্ন চেহারায় সুজুকি মোটর করপোরেশনের সদর দফতরে ছুটে আসেন। কারণ কয়েকদিন আগেই সুজুকিসহ পাঁচটি জাপানি গাড়ি কোম্পানি প্রকাশ করেছে গাড়ির নিরাপত্তা পরীক্ষার সময় তারা মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করেছে। আর এরপর থেকেই সর্বস্তরে ব্যাপক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

জাপানের প্রধান মন্ত্রিপরিষদ সচিব ইয়োশিমাসা স্বীকার করেছেন, ঘটনাটি কেবল জাপানের অটোমোবাইল সার্টিফিকেশন সিস্টেমের ভিতকেই নাড়িয়ে দেয়নি, বরং জাপানের অটোমোবাইল শিল্পের বিশ্বাসযোগ্যতারও ক্ষতি করেছে। কিছু বিশ্লেষক উল্লেখ করেছেন, অটোমোবাইল শিল্প জাপানের উৎপাদন শিল্পের একটি স্তম্ভ। তাই এ ধরনের জালিয়াতির প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।

গত বছরের এপ্রিলে একটি ‘রহস্যময়’ চিঠিতে দাইহাতসু মোটর করপোরেশনের এক কর্মী জাপানের পরিবহন বিভাগকে তার কোম্পানির মিথ্যা তথ্য বানানোর প্রমাণ দাখিল করেছিলেন। গত বছরের ডিসেম্বরে জাপান সরকারের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দাইহাতসু মোটর করপোরেশনের মিথ্যা তথ্য বানানোর ইতিহাস ৮০’র দশকের শেষের দিকে শুরু হয়, যখন কিনা ‘মেড ইন জাপানের’ স্বর্ণযুগ ছিল। অর্থাৎ দাইহাতসু মোটরের জালিয়াতি চলছে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

চলতি বছরের মে’র শেষ দিকে জাপানের পরিবহন বিভাগের জরিপে দেখা যায়, দাইহাতসু মোটরের এ কাজটাকে বলা যায় ‘হিমশৈলের অগ্রভাগ’। টয়োটা মোটর করপোরেশন, হোন্ডা মোটর, মাজদা মোটর কোপরেশন, ইয়ামাহা মোটরস এবং সুজুকি মোটরসহ জাপানের ৫টি প্রধান গাড়ি প্রতিষ্ঠানের মোট ৩৮টি মডেলের গাড়ি এ নকল তথ্যের সঙ্গে জড়িত। এগুলোর ৬টি মডেল এখনও বাজারে বিক্রি হচ্ছে। প্রতারণা উন্মোচিত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট জাপানি গাড়ি প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক ক্ষমাও চেয়েছে।

তবে অনেক জাপানি মনে করেন, অটোমোবাইল কোম্পানিগুলোয় প্রায়ই কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে থাকে এবং শুধু মাথা নত করে ক্ষমা চেয়ে বাজারের আস্থা পুনরুদ্ধার করা কঠিন।

‘মেড ইন জাপান’ কি এখনও বিশ্বাসযোগ্য? জাপানের ‘মাইনিচি শিম্বুন’ পত্রিকা ৫ জুন এক রিপোর্টে প্রশ্নটি করেছিল। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয়, প্রায় প্রতি বছরই জাপানি অটোমোবাইল শিল্পে মারাত্মক জালিয়াতি কেলেঙ্কারিগুলো উন্মোচিত হয়েছে এবং কারণগুলোও প্রায় একই রকম। গবেষণা এবং উন্নয়নের সময় কমানো এবং স্বল্পমেয়াদি স্বার্থ অনুসন্ধানের জন্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তাদের কর্মীদের ওপর অযৌক্তিক কিছু কাজ চাপিয়ে দেয় এবং ফ্রন্ট লাইনের কর্মীরাও ঝুঁকি নিয়ে নকল তথ্য বানাতে বাধ্য হন।

তা ছাড়া, বৈদ্যুতিক গাড়ির দ্রুত বিকাশের সঙ্গে ফসিল জ্বালানির যানবাহনের ক্ষেত্রে জাপানি গাড়ি কোম্পানিগুলোর বাজার-সুবিধাটিও ক্রমে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

আসলে জাপানি কোম্পানিগুলোর এই জালিয়াতি এবং নিয়ম লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো রাতারাতি ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা নয়। বিগত কয়েক দশকে, জাপানের উৎপাদন শিল্প উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করলেও এর ফলে কিছু কোম্পানির সচেতনতার অভাব রয়েছে। তারা একটি স্থিতাবস্থাতেই সন্তুষ্ট। প্রয়োজনীয় উদ্ভাবন ও সংস্কার করতে অনিচ্ছুক। এই আত্মতুষ্টির মনোভাব কোম্পানিগুলোকে নতুন প্রযুক্তি এবং নতুন বাজারের প্রতি সাড়া দিতে ধীরগতির বানিয়ে ফেলে। ফলে দ্রুত পরিবর্তনশীল বাজার পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে যায়।

তা ছাড়া, জাপানি তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃপক্ষের স্ট্যান্ডার্ড সেটিং, তত্ত্বাবধান এবং পরিদর্শন এবং শাস্তির ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে।

জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশের কারণে, অনেক জাপানি কোম্পানির কিছু মডেলের উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে এবং গাড়ি কোম্পানি এবং সাপ্লাই চেইন কোম্পানি উভয়ই বড় অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়বে। বর্তমানে, জাপানের অটো শিল্পের উৎপাদনের পরিমাণ সামগ্রিক উৎপাদন শিল্পের প্রায় ২০ শতাংশ। বিশ্লেষকরা মনে করেন, স্তম্ভ জাতীয় শিল্প হিসেবে জাপানের অটো শিল্প যদি মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়, তবে এটি জাপানের জিডিপিও কমিয়ে দিতে পারে।

জাপান সরকার এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই দায়বদ্ধতা বাড়াতে হবে। নিজেদের ভেতর আনতে হবে সর্বাত্মক সংস্কার। তাদের উচিত হবে অন্যদের এবং নিজেদের ক্ষতি করা বন্ধ করা—এমনটাই মনে করে সিএমজি সম্পাদকীয়।

 

লিলি/ফয়সল/স্বর্ণা