চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব
৭৩তম পর্বে যা থাকছে:
১। ধানের বিবর্তনের রহস্য উন্মোচন
২। রাসায়নিক পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে পলিথিন বর্জ্য থেকে তেল উৎপাদন
ধানের বিবর্তনের রহস্য উন্মোচন
সম্প্রতি ধানের ধারাবাহিক বিবর্তনের রহস্য উন্মোচন করেছেন চীনা বিজ্ঞানীদের একটি দল। গত ১ লাখ বছরেরও বেশি সময় ধরে ধানগাছ কীভাবে বন্য থেকে মানুষের নিয়মিত খাদ্য ও চাষযোগ্য হয়ে উঠলো তা উঠেছে এসেছে তাদের এ গবেষণায়।
এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল সায়েন্স জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের এ গবেষণায় কেবল মানব সমাজের অগ্রগতি এবং কৃষি সভ্যতার উৎপত্তি সম্পর্কেই আলোকপাত করা হয়েছে এমন নয়, পাশাপাশি চীনই হলোর ধানের জন্মস্থান এই বিষয়ে জোরালো প্রমাণও উপস্থাপন করা হয়েছে।
কীভাবে মানুষ প্রথমে বন্য ধান চাষ শুরু করেছিল এবং একে বন্য থেকে চাষযোগ্য একটি ফসলে পরিণত করলো এ গবেষণার মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরে বিষ্মিত হয়েছেন বিভিন্ন একাডেমিক ক্ষেত্রের গবেষকরা।
১৯৭০ এর দশক থেকে ইয়াংজি নদীর মধ্য ও নিম্ন উপত্যকা অঞ্চল বিশেষ করে হেমুতু ও সাংশানের মতো স্থানগুলোতে পাওয়া ধানের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো প্রমাণ করে এই অঞ্চল থেকেই ধান চাষের শুরু হয়েছিল।
চীনের বিজ্ঞান একাডেমির ইনস্টিটিউট অফ জিওলজি অ্যান্ড জিওফিজিক্সের অধ্যাপক লু হউইউয়ান এ গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। গবেষণা দলটি ধান গাছের ফাইটোলিথের উপর একটি পদ্ধতিগত গবেষণা পরিচালনা করে এসব তথ্য জানতে পেরেছেন। ফাইটোলিথ হলো উদ্ভিদের কোষের প্রাচীরের মধ্যে তৈরি সিলিকার ক্ষুদ্র, অজৈব কণা, যা উদ্ভিদের ক্ষয়ের পরেও টিকে থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, আধুনিক ধানের বুলিফর্ম ফাইটোলিথের তুলনায় বন্য ধানের বুলিফর্ম ফাইটোলিথে মাছের আঁশের মতো খাঁজের সংখ্যা বেশি থাকে। এর মাধ্যমে বন্য ধানকে আধুনিক ধান থেকে পৃথক করা যায়। এই মানদণ্ড ব্যবহার করে গবেষকরা পূর্ব চীনের চেচিয়াং প্রদেশের সাংশান এবং হ্যহুয়াশানের প্রত্নতাত্ত্বিক এবং প্রাকৃতিক অনুসন্ধান করেছেন।
ইয়াংজি নদী নিম্ন অববাহিকায় প্রায় ১ লক্ষ বছর আগে থেকেই বন্য ধানের অস্তিত্ব ছিল, যা পরবর্তীতে ধানের ব্যবহার ও চাষের পথিকৃৎ হিসেবে কাজ করেছে।
আনুমানিক ২৪ হাজার বছর আগে, শেষ বরফ যুগের সূচনালগ্নে মানুষের পূর্বপুরুষরা প্রচণ্ড ঠাণ্ডার ফলে সৃষ্ট খাদ্যের অভাব মোকাবিলায় বন্য ধান সংগ্রহ ও খাবার হিসেবে গ্রহণ করা শুরু করে।
এছাড়া প্রায় ১৩ হাজার বছর আগে, মানুষ ধান চাষের পদ্ধতি রপ্ত ও চাষের অনুশীলন করে। আনুমানিক ১১ হাজার বছর আগে চাষের ধানের মধ্যে ফাইটোলিথ দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে, যা ধানকে মানুষের প্রধান খাদ্য হয়ে উঠতে সহায়তা করে।
গবেষণা পত্রের লেখক এবং ইনস্টিটিউট অফ জিওলজি অ্যান্ড জিওফিজিক্সের অধ্যাপক চাং চিয়ানপিং জানান, তাদের গবেষণার মাধ্যমে উঠে এসেছে যে, পূর্ব এশিয়ায় ধান চাষের সূচনা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় গম চাষের সূচনা একই সঙ্গে হয়েছিল। এটি মানবসমাজের উন্নয়নের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন এবং বিশ্বব্যাপী কৃষির উৎপত্তি সম্পর্কে বোঝাপড়াকে ব্যাপকভাবে গভীর করে।
এই উদ্ভাবনী আবিষ্কার থেকে মানুষ-ধানের সহবিবর্তন, মানুষের সামাজিক বিকাশ, কৃষি সভ্যতার উৎপত্তি এবং সাংশানের সংস্কৃতির গুরুত্ব বোঝা যায়।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
রাসায়নিক পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে পলিথিন বর্জ্য থেকে তেল উৎপাদন
পলিথিন দূষণ মোকাবেলায় চমৎকার সমাধান খুঁজে বের করেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। পরিবেশের উপর এর বিরূপ প্রভাব নিয়ন্ত্রণে কেমিকেল রিসাইক্লিং বা রাসায়নিক পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে পলিথিন বর্জ্যকে মূল্যবান কাঁচামালে রূপান্তর করে পুনরায় নতুন পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা হবে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
ম্যাক্রোইকনমিক রিসার্চ একাডেমি এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে রাসায়নিক পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে প্লাস্টিকের বর্জ্য থেকে যে তেল উৎপাদন হবে তা চীনের বৃহত্তম তেল উৎপাদন ক্ষেত্রের চেয়ে দ্বিগুণ।
পলিথিনের বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের দুটি প্রধান পদ্ধতির মধ্যে একটি হলো রাসায়নিক পুনর্ব্যবহার। এ পদ্ধতিতে পলিমার চেইনগুলোকে ভেঙে তেলের মতো প্রয়োজনীয় পণ্য তৈরি করা হয়। আরেকটি পদ্ধতি হলো মেকানিক্যাল পুনর্ব্যবহার, যেখানে পুনর্ব্যবহারের জন্য নতুন প্লাস্টিক পণ্য তৈরি করতে বর্জ্য পলিথিনগুলোকে গুঁড়া করা হয়।
একাডেমির গবেষক চাং তেইউয়ান জানান, প্লাস্টিকের বোতল এবং শক্ত প্লাস্টিকের প্যাকেজিং পুনর্ব্যবহারের একটি ভালো পদ্ধতি হলো মেকানিক্যাল পুনর্ব্যবহার। যদিও চীনে উৎপাদিত পলিথিনের প্রায় ৪৬ শতাংশই নমনীয় প্লাস্টিক। আর নমনীয় প্লাস্টিক প্যাকেজিং এবং প্লাস্টিকের ফিল্ম পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি অর্থনৈতিকভাবে বা প্রযুক্তিগতভাবে লাভজনক নয়। বর্তমানে এই ধরনের বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য পোড়ানো এবং ল্যান্ডফিলে ফেলাই হলো প্রধান পদ্ধতি।
চীনের জাতীয় সম্পদ পুনর্ব্যবহার সংস্থার অধিভুক্ত প্লাস্টিক রিসাইক্লিং অ্যাসোসিয়েশনের পরিসংখ্যান উল্লেখ করে ম্যাক্রোইকনমিক রিসার্চ একাডেমির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, গত বছরে চীনজুড়ে প্রায় ৬ কোটি ২০ লাখ মেট্রিক টন পলিথিনের বর্জ্য তৈরি হয়েছিল, যার মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৯ লাখ টন পুনর্ব্যবহার করা হয়। যদিও অন্যান্য দেশ এবং অঞ্চলের মতো চীনকেও পুনর্ব্যবহারের হার আরও বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
সংস্থাটি আরও বলছে, গত বছর চীনে প্রায় ৪ কোটি ৩০ লাখ টন প্লাস্টিকের বর্জ্য পোড়ানো হয়েছিল বা ল্যান্ডফিল্ডে ফেলা হয়েছিল। ২০৩৫ সালের মধ্যে চীনের প্লাস্টিকের উৎপাদন বছরে ১৫ কোটি ৫০ লাখ টনে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিপুল এই বর্জ্য বৃহৎ পরিসরে কেমিক্যাল রিসাইক্লিং করা হয়, তাহলে দেশটি প্লাস্টিকের বর্জ্য এবং কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে এবং তেল উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাবে।
২০৩৫ সালে যদি চীনের প্লাস্টিকের বর্জ্যের ৩০ শতাংশ কেমিক্যাল পদ্ধতিতে পুনর্ব্যবহার করা হয়, তাহলে দেশটি বছরে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ টন প্লাস্টিকের বর্জ্য কমাতে সক্ষম হবে। বর্জ্য জ্বালানোর তুলনায় কেমিক্যাল রিসাইক্লিং করলে ২ কোটি ২৩ লাখ টন কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ কম হবে এবং পাশাপাশি ১০৮ মিলিয়ন টন তেল বেঁচে যাবে।
প্লাস্টিক বর্জ্যের রাসায়নিক পুনর্ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য কয়েকটি প্রস্তাবের তালিকা করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। এর মধ্যে প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, সেইসঙ্গে প্লাস্টিক দূষণ ব্যবস্থাপনার জন্য দেশটির নীতি ও বিধিবিধান ব্যবস্থার ক্ষেত্রে রাসায়নিক পুনর্ব্যবহারকে দেশের গভর্ন্যান্স ব্যবস্থার মূল অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।
প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার
অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল
স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- ফয়সল আবদুল্লাহ
সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী