মেড ইন চায়না বিষয়: কাগজ
2024-06-01 19:41:05

কাগজ থেকে শুরু করে কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন, চা থেকে শুরু করে প্যাসেঞ্জার ড্রোন এবং কম্পাস থেকে শুরু করে ডিজিটাল অর্থনীতি; সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে চলেছে চীনের শক্তিশালী হাত ধরে। নানা সময়ে দারুণ সব আবিষ্কার করে আধুনিক সভ্যতার ভিত গড়ে দিয়েছে চীন। আর সেই সব আবিষ্কার নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন মেড ইন চায়না। সাথে আছি আমি ফয়সল আবদুল্লাহ... আজকের পর্বে থাকছে চীনের আবিষ্কার কাগজের কথা।

প্রতি বছর বিশ্বে ছাপা হচ্ছে জ্ঞান বিজ্ঞান, গল্প-উপন্যাসসহ কোটি কোটি পাঠ্যবই। বিশ্বজুড়ে জ্ঞানের ধারক এই বইগুলো কিন্তু টিকে আছে একটি বস্তুর ওপর ভর করে। আর সেটা হলো কাগজ। কাগজে প্রতিদিন ছাপা হচ্ছে কোটি কোটি সংবাদপত্র, নানা ধরনের নথি এবং গবেষণাপত্র। আবার বিভিন্ন উৎসবে ঘরবাড়ি, পথঘাট সাজাতেও চাই কাগজ। মোটকথা কাগজ ছাড়া আমরা একটি দিনও কল্পনা করতে পারি না। একটু ভাবলেই মনে হবে, মানবসভ্যতার এগিয়ে যাওয়ার পেছনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে এই কাগজ।

এবার বলুন তো কারা প্রথম বানাল সেই কাগজ? ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, এই কাগজ কিন্তু মেড ইন চায়না।

চীনের যে চারটি আবিষ্কারকে সভ্যতা বদলে দেওয়ার হাতিয়ার বলা হয়, কাগজ তার মধ্যে একটি। আজ থেকে দুই হাজার বছর আগে চীনের হান সাম্রাজ্যের আমলে প্রথম কাগজ তৈরি করেন রাজ্য বিচারসভার এক কর্মকর্তা ছাই লুন।

এর আগে গাছের পাতা, প্যাপিরাস ও এ জাতীয় জিনিসপত্রে টুকটাক লেখার চল থাকলেও ছাই লুনের ফর্মুলাই মূলত ছড়িয়ে দিল কাগজের জনপ্রিয়তা। এটাকে করেছে আরও সহজলভ্য। ছাই প্রথম দিকে কাগজের মণ্ড তৈরিতে ব্যবহার করতে শুরু করেন তুঁতগাছ। সেটার সঙ্গে মেশান বাঁশ ও নানা ধরনের ভেষজ। এ উপকরণগুলোকে ছাই লুন প্রথমে থেঁতলে নিতেন। তারপর পানি মিশিয়ে নাড়তেন কাঠের দণ্ড দিয়ে। পরে সেদ্ধ করতেই সেটা থেকে তৈরি হতো মণ্ড। অতিরিক্ত পানিটা ঝরিয়ে দিতেই পাওয়া যায় কাগজ।

তুঁতের বাকল থেকে তৈরি কাগজ টিকে থাকতে পারে হাজার বছর। আর তাই সেই হান আমলে তৈরি তুঁতগাছের কাগজ কিন্তু এখনও টিকে আছে।

চীনে আছে চায়না হান পেপার রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার। সেন্টারটির পরিচালক কং বিন জানালেন, আগের যুগের কাগজ তৈরির প্রক্রিয়াটি মোটেও সহজ ছিল না। কঠোর পরিশ্রম বললেও কম হয়ে যাবে। প্রায় ৭০টি ধাপ পেরিয়ে তৈরি করতে হতো এক একটি হান পেপার।

অনুষ্ঠানের এই ফাঁকে আমরা জানবো কাগজ নিয়ে মজার কিছু তথ্য

কাগজ যে শুধু গাছ দিয়েই তৈরি হবে তা নয়। চীনের ছাই লুন প্রথম যে কাগজ তৈরি করেছিলেন সেটা তৈরিতে তি নি পুরনো কাপড়ও ব্যবহার করেছিলেন। এমনকি এখনও কিছু কাগজ তৈরি হয় কাপড় থেকে। বিশেষ করে কাগজের ব্যাংকনোট কিন্তু ছাপা হয় তুলার ফাইবার থেকে। যা সাধারণ কাগজের চেয়ে বেশি টেকসই।

অষ্টম শতকের দিকে চীনের কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে বাদবাকি বিশ্বে। আগে এ পদ্ধতি শিখে নেয় ইসলামিক দেশগুলো। ১১ শতকের দিকে চীনের কাছ থেকে কাগজ বানানো শেখে ইউরোপ।

১৩ শতকের দিকে চীনের দেখানো ফর্মুলায় পেপার মিল তৈরি হয় স্পেনে। ১৯ শতকের দিকে কাঠের মণ্ড দিয়ে কাগজ বানানো শুরু করে ইউরোপের কিছু দেশ।

 এবার আসা যাক চীনের বিখ্যাত রাইস পেপারের প্রসঙ্গে।

দেড় হাজার বছর আগে এক নতুন ধরনের কাগজ নিয়ে আসেন চীনের বিজ্ঞানীরা। ওই কাগজের নাম সুয়ান কাগজ। এর আরেক নাম রাইস পেপার। চীনের প্রাচীন অনেক নথি ও শিল্পকর্মে এ কাগজের ব্যবহার দেখা গেছে। পূর্ব চীনের আনহুই প্রদেশের সুয়ানছেং শহরে প্রথম তৈরি হয় এ কাগজ। এখনও এ কাগজের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে অঞ্জলটি। ২০১২ সাল জুনে এই সুয়ান পেপারকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো।

সুয়ান কাগজকে রাইস পেপার ডাকা হলেও এ কাগজে মূলত ধানের সরাসরি ব্যবহার হয় না। অন্যান্য গাছের বাকলের পাশাপাশি এ কাগজের মণ্ড তৈরিতে কিছুটা ধানগাছের খড় ব্যবহার করা হয়। সুয়ান কাগজ তৈরিতে দুই বছরের পুরনো গাছের কাণ্ড থেকে বাকল সংগ্রহ করা হয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার ও ঐতিহ্যবাহী প্রক্রিয়ার অনুসরণ।

 

শুরুর দিকে চীনে যে কাগজ শুধু লেখার কাজেই ব্যবহৃত হতো তা নয়। ৬০০ থেকে ৯০০ সালের দিকে থাং সাম্রাজ্যের সময় চীনে চা পাতা সংরক্ষণে ব্যবহৃত হতো কাগজ। কাগজে মুড়ে রাখা হতো চা। এতে চায়ের স্বাদ থাকত অটুট। পরবর্তীতে সেটা থেকেই কিন্তু আসে টি-ব্যাগের ধারণা।

নানা ধরনের প্যাকেজিংয়েও ব্যবহৃত হতো কাগজ। বিশেষ করে দ্বিতীয় শতকের দিকে চীনে ব্রোঞ্জের তৈরি আয়নার কদর বাড়ে বেশ। ওই আয়না মোড়ানো হতো কাগজ দিয়ে। আবার প্রাচীন চীনে কীটনাশক জাতীয় বিষাক্ত উপাদান মুড়িয়ে রাখতে কাগজের ব্যবহার ছিল, যখন কিনা ইউরোপের লোকজন কাগজ চোখেই দেখেনি।

তৃতীয় শতক থেকে কাগজে লেখার চল শুরু হয় চীনে। আর মজার ব্যাপার হলো, ৮৭৫ সালে বাকি বিশ্ব যখন কাগজ হাতে ধরে দেখেনি, চীনারা তখন টয়লেট পেপারও ব্যবহার করতো। 

কাগজের উৎপাদন ও বাণিজ্যেও কিন্তু চীন এখন বিশ্বসেরা। ২০২২ সালের এক হিসাবে দেখা গেছে ওই বছর চীনে কাগজের পালপ ও কাগজ তৈরি হয়েছে ২৮ কোটি টন। এর মধ্যে চীনেই ব্যবহৃত হয়েছে ২৩ কোটি টন। আর চীনে কাগজের ব্যবহার এতটা বৃদ্ধির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে চীনের উৎসব। কারণ দেশটির প্রায় সব উৎসবেই চাই নানা রঙের, নানা আকারের কাগজ। কাগজ কেটে শিল্পকর্ম তৈরি করাটাও চীনের ঐতিহ্য। যেকোনো উৎসবে ঘর সাজাতেও চীনে ব্যবহার করা হয় কাগজ। কদিন আগে শেষ হওয়া বসন্ত উৎসবের শেষ দিনের লণ্ঠন উৎসবেও লাখ লাখ লণ্ঠন বানানো হয়েছিল কাগজ দিয়েই।

এই ফাঁকে বলে রাখা যায়, কাগজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখন চীনের হার্ডবোর্ডের উৎপাদন এবং আমদানিও বাড়ছে। আবার রিসাইকেল করার জন্য বাতিল ও ব্যবহৃত কাগজের আমদানিও বাড়িয়েছে চীন।

২০২২ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৭০ হাজার টন। কাগজের কাঁচামাল পালপ আমদানি কিংবা কাগজ সংক্রান্ত শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও চীন নানা সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে ব্যবসায়ীদের।

তবে কাগজ রপ্তানিতেও চীন সেরা। ২০২২ সালে চীন থেকে পাল্প, কাগজ এবং কাগজ পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৩১ লাখ টন। যা থেকে আয় হয়েছিল ৩২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, আধুনিক নানা ধরনের ডিসপ্লে প্রযুক্তির যুগেও চীনের হাত ধরে কাগজ টিকে থাকবে আরও বহুকাল।