চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব
৭২তম পর্বে যা থাকছে:
১। বাওবাব গাছের বিবর্তনের রহস্য উন্মোচন
২। মেরু অনুসন্ধানের ঠাণ্ডা-প্রতিরোধী ই-স্কিন তৈরি করলো চীন
৩। বিজ্ঞানের সাপ্তাহিক টুকরো খবর
বাওবাব গাছের বিবর্তনের রহস্য উন্মোচন
যৌথ এক গবেষণার মাধ্যমে বাওবাব গাছের বিবর্তনের রহস্য উন্মোচন করেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। এতে দেখা গেছে যে পৃথিবীর সকল প্রজাতির বাওবাব গাছের উৎপত্তিস্থল ছিল আফ্রিকার মাদাগাস্কারে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল নেচার জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে।
এই গবেষণা গাছটি সম্পর্কে মানুষের জানার পরিধি আরও বাড়িয়ে দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে আমরা জানা যাবে কিভাবে এই বিশাল গাছগুলো লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মহাদেশের কঠিন পরিবেশ এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে আছে। এছাড়াও, এই গবেষণা বাওবাব গাছকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
চীনা একাডেমি অব সায়েন্সেসের সিনো-আফ্রিকা যৌথ গবেষণা কেন্দ্র এবং আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা এই গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন। মাদাগাস্কারে সংস্কৃতি ও বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বাওবাব গাছের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। দেশটি এই গাছটি 'জঙ্গলের মা' অথবা 'জীবনের গাছ' নামে পরিচিত।
গবেষকরা আটটি প্রজাতির সকল বাওবাব গাছের জিনগত বিশ্লেষণ করে এর বিবর্তনের রহস্য উন্মোচন করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে যে ৬০ মিলিয়ন বছর আগেও মাদাগাস্কারে এই গাছের অস্তিত্ব ছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন মাধ্যমে এটি আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চল এবং অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে বাওবাব গাছের প্রাকৃতিক বিস্তার ব্যাহত হতে পারে এবং এর সংখ্যা আরও কমে আসতে পারে। তবে জিন বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরিবর্তিত পরিবেশে এই গাছগুলোর টিকে থাকার উপায় খুঁজে বের করার ব্যাপারে গবেষকরা আশাবাদী।
বাওবাব গাছের সংখ্যা হ্রাসের পেছনে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা। এর মধ্যে রয়েছে আবাসস্থল ধ্বংস এবং বাদুড় সহ অন্যান্য পরাগায়নকারী প্রাণীর সংখ্যা হ্রাস।
এই গাছের বেশ কিছু প্রজাতিকে আইইউসিএন (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার) দ্বারা অতি বিপন্ন বা 'লাল' তালিকাভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা।
ভবিষ্যতে বাওবাব গাছ সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ এবং এই গাছের অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গবেষকরা গাছের নমুনা সংগ্রহের কাজ আরও বিস্তৃত করতে চান
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
মেরু অনুসন্ধানের ঠাণ্ডা-প্রতিরোধী ই-স্কিন তৈরি করলো চীন
মেরু অভিযানের জন্য একটি নতুন ধরনের ইলেকট্রনিক স্কিন (বৈদ্যুতিক ত্বক) তৈরি করেছেন চীনের থিয়েনচিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। এই স্কিনটি মাইনাস ৭৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো অত্যন্ত ঠাণ্ডা পরিবেশেও কাজ করতে সক্ষম। গবেষকরা আশা করছেন এই উদ্ভাবনটি মেরু অভিযানের ক্ষেত্রে ব্যাপক সুফল বয়ে আনবে।
এই নতুন ইলেকট্রনিক স্কিনটি উচ্চ প্রসারণযোগ্য, স্ব-নিরাময়যোগ্য (ক্ষতিগ্রস্ত হলে নিজেই নিজেকে সারিয়ে তুলতে পারে) এবং সংবেদনশীল। এটি মেরু রোবটগুলোকে তাপমাত্রার অনুভূতি প্রদান করবে, যা রোবটগুলোকে পরিবেশের সঙ্গে আরও ভালভাবে মানিয়ে নিতে এবং অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করতে সহায়তা করবে।
সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে। থিয়েনচিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির গবেষকদল এ গবেষণাটি করেছেন। এর নেতৃত্বে ছিলেন গবেষক চাং লেই ও ইয়াং চিং।
গবেষকরা ২০২০ সালের প্রথম দিকেই প্রথম সংস্করণটি তৈরি করেছিলেন। নতুন সংস্করণটি পূর্ববর্তী সংস্করণের তুলনায় অনেক বেশি উন্নত। এটি মাইনাস ৭৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো তীব্র ঠান্ডায়ও নিখুঁতভাবে কাজ করতে সক্ষম। পাশাপাশি বস্তুর আকৃতি এবং নির্দিষ্ট চিহ্নগুলো সনাক্ত করতেও পারদর্শী। গবেষকরা জানান, নতুন ইলেকট্রনিক স্কিনগুলো মাইনাস ৭৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে অতি শীলত পরিবেশের মধ্যেও একটি রোবটের হাতের তালুতে জড়িয়ে দেওয়া সম্ভব, যা এই স্কিনটি রোবটগুলোকে মেরু পরিবেশে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনায় সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও সহায়ক করে তুলবে।
গবেষক ইয়াং জানান, চীনের মেরু অঞ্চলের গবেষণা এবং অন্যান্য গবেষণায় এই স্কিনটি ব্যাপক প্রয়োগ নিয়ে আশাবাদী তারা।
এছাড়া নতুন ধরনের ইলেকট্রনিক স্কিনটির নিজেক সারিয়ে তোলার মতো ফাংশন রয়েছে। এমনকি চরম শীতল পরিবেশে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এটি নিজেই নিজেকে সারিয়ে তুলতে সক্ষম। গবেষকদের এমন উদ্ভাবন মেরু অঞ্চলের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, বরফ এবং হিমবাহ পর্যবেক্ষণ সহায়তা করবে। পাশাপাশি এটি নেভিগেশন ও অবস্থান নির্ধারণ এবং মেরু অঞ্চল থেকে প্রয়োজনীয় ডেটা সংগ্রহ এবং গবেষণা কেন্দ্রে পাঠানোর মতো কাজেও সহায়
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
বিজ্ঞানের সাপ্তাহিক টুকরো খবর:
১। ৪০তম অ্যান্টার্কটিক অভিযানের সময় ড্রোন দিয়ে সংগ্রহ করা উল্কাপিণ্ডের নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন চীনা বিজ্ঞানীরা। এবার আরও গবেষণার জন্য ওই উল্কা চীনে নিয়ে এসেছেন তারা।
অ্যান্টার্কটিকায় প্রচুর উল্কাপিণ্ড রয়েছে। চীনা গবেষণা দলটি আগের গবেষণায় ১২ হাজার ৬৬৫টি উল্কাপিণ্ড সংগ্রহ করেছিল। যার বেশিরভাগই সংগ্রহ করা হয়েছিল চোংশান স্টেশন থেকে প্রায় সাড়ে চারশ কিলোমিটার দূরের গ্রোভ পর্বতমালা থেকে।
গবেষকদের মতে, সাম্প্রতিক অভিযানের সময় উল্কাপিণ্ডের সন্ধানে ড্রোনের ব্যবহারের ফলে এ ধরনের গবেষণায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি যেমন কমেছে, তেমনি গ্রোভ পর্বতমালার অঞ্চলে বড় এলাকায় জরিপও করা গেছে।
২। বিশ্বের প্রথমবারের মতো দুর্লভ সরীসৃপ ক্রোকোডাইল লিজার্ড নিয়ে গবেষণার জন্য চীনে একটি গবেষণা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবসে, দক্ষিণ চীনের কুয়াংসি চুয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে খোলা হয় এ গবেষণা কেন্দ্র।
প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বর্গমিটার এলাকাজুড়ে স্থাপন করা হয় কুয়াংসি তাইকুইশান শিনিসরস ক্রোকোডিলারাস নামের এই গবেষণা কেন্দ্রটি। আগ্রহীরা এখানে এসে এই বিরল প্রজাতির প্রাণী সম্পর্কে জানতে পারবেন। আবার গবেষকরাও নিজেদের মতো করতে পারবেন গবেষণা।
ক্রোকোডাইল লিজার্ড চীনের প্রথম শ্রেণির সুরক্ষিত প্রাণী হিসেবে শ্রেণিভুক্ত। এটি অত্যন্ত বিপন্ন। ধারণা করা হয় বিশ্বব্যাপী এখন মাত্র এক হাজার ৪০০টি ক্রোকোডাইল লিজার্ড আছে, যার মধ্যে ৫০০টি আছে তাকুইশান রিজার্ভে। কৃত্রিমভাবে প্রজনন করা ক্রোকোডাইল লিজার্ডও রয়েছে এখানে।
৩। বিশ্বব্যাপী মহাকাশ আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং সতর্কতার জন্য মানসম্মত ডেটা সরবরাহ করতে চীন প্রথমবারের মতো নিজেদের তৈরি উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সির রাডার নেটওয়ার্ক থেকে বৈজ্ঞানিক শনাক্তকরণের ফলাফল প্রকাশ করেছে।
সম্প্রতি বেইজিংয়ে শুরু হওয়া একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালায় এ রাডার ডেটা প্রকাশ করেছে চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সের অধীনে থাকা ন্যাশনাল স্পেস সায়েন্স সেন্টার।
২০২৩ সালের অক্টোবরে চীনের মেরিডিয়ান প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের অংশ হিসেবে, ভূমিতে স্থাপিত স্টেশনগুলোর সমন্বয়ে একটি আয়নমণ্ডল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ক তৈরি করে সংস্থাটি।
স্পেস সায়েন্স সেন্টার জানিয়েছে, চীন উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সির রাডার প্রযুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নতুন অগ্রগতি করেছে এবং এই ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আরও গভীর করবে।
এশিয়ার ওপর থাকা বায়ুমণ্ডলের আয়নোস্ফিয়ার অঞ্চলের মাঝারি ও উচ্চপর্যায়ে কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা থাকলে তা শনাক্ত করতে পারবে এ রাডার নেটওয়ার্ক। দক্ষিণ থেকে উত্তরের চার হাজার কিলোমিটার ও পূর্ব থেকে পশ্চিমে ১২ হাজার কিলোমিটারজুড়ে বায়ুমণ্ডলের অবস্থাও বোঝা যাবে।
|| প্রতিবেদন: ফয়সল আবদুল্লাহ
|| সম্পাদনা: শুভ আনোয়ার
নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।
প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার
অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল
স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- ফয়সল আবদুল্লাহ
সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী