আরও বেশি সংখ্যক চীনা তরুণ-তরুণী নির্ভয়ে ক্যারিয়ার গড়ার পথে তাদের স্বপ্নের পেছনে ছুটছে। তাদের মধ্যে ২৮ বছর বয়সী ওয়াং রুই, তিনি চীনের সিছুয়ান প্রদেশের সানসিংতুই প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ স্থানে কাজ করেন। তিনি হলেন চীনের সিছুয়ান প্রদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণাগারের একজন তরুণ বিশেষজ্ঞ। হয়তো অনেকের কাছে প্রত্নতত্ত্বিক কাজ অনেক বিরক্তিকর, তবে কেন এই তরুণ মেয়ে এ কাজে যোগ দিতে দ্বিধা করেন নি? আজকে তাঁর গল্প আপনাদের জানাচ্ছি।
তার স্বপ্নের সূচনার কথা স্মরণ করে ওয়াং রুই বলেছিলেন "ছোটবেলা থেকেই, ইতিহাসের প্রতি আমার যথেষ্ঠ অনুরাগ ছিল। কেন্দ্রীয় টেলিভিশন সিসিটিভির বিজ্ঞান ও শিক্ষা চ্যানেলে তথ্যচিত্র দেখার সময়, আমি কল্পনা করেছিলাম যে, প্রত্নতাত্ত্বিকের কাজটি এরকম হতে পারে: সকালে, সূর্যালোক ও কুয়াশার কোলে, একদল লোক মাঠে কিছু কাজ শুরু করে, যা খুবই আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছিল।"
সানসিংতুই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের খননকাজ এক সময় বন্ধ ছিল। ২০২০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর এ কাজ পুনরায় শুরু হয়েছিল। ওয়াং-সহ ১৯৯০ দশকে জন্মগ্রহণকারী যুবকদের একটি দল এ প্রচেষ্টার সাথে জড়িত ছিল।
মূলত ১৯২০ এর দশকের শেষ দিকে আবিষ্কৃত সানসিংতুই ধ্বংসাবশেষকে ২০ শতাব্দীতে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের মধ্যে একটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সিছুয়ান প্রদেশের রাজধানী ছেংতুং শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে কুয়াংহান শহরে অবস্থিত, ১২ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে ধ্বংসাবশেষকে প্রাচীনকালের শু রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ বলে মনে করা হতো, যা প্রায় ৩০০০ থেকে ৪৫০০ বছর আগের।
ওয়াং রুই বলেন, "এটি একটি অন্ধ বাক্স খোলার মতো। এখানে, ক্ষেতে রেপসিড ফুল ফোটে, ধান ফলে, আপাতদৃষ্টিতে সবই একই রকম। তবুও, পৃষ্ঠের মাটি থেকে খোসা ছাড়ালে, কেউ সং রাজবংশের (৯৬০-১১২৭) অবশিষ্টাংশ উন্মোচন করতে পারে, হান রাজবংশ (খ্রিস্টপূর্ব ২০২- খ্রিস্টাব্দ ২২০), বা এমনকি সাং এবং চৌ রাজবংশের (খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০- খ্রিস্টপূর্ব ২৫৬) অথবা নিওলিথিক যুগের মাটির নীচে সমাহিত নিদর্শনগুলো ভিন্ন, যা বেশ আকর্ষণীয়। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছিলেন যে তিনি তার যৌবনে প্রত্নতত্ত্ব অধ্যয়ন করতে চেয়েছিলেন।”
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বেইজিংয়ে চীনের শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য এবং ক্রীড়া খাতের বিশেষজ্ঞ এবং প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে একটি আলোচনা সভায় সি চিন পিং বলেন যে, তিনি তার যৌবনে প্রত্নতত্ত্ব অধ্যয়ন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু সুযোগ পাননি।
প্রত্নতাত্ত্বিক কাজের উচ্চ ব্যয় এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে সি চিন পিং এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। চীনা সভ্যতার উত্স অধ্যয়নের গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে সি প্রত্নতত্ত্বে প্রচেষ্টা বাড়ানোর আহ্বান জানান।
সি’র দৃষ্টিতে প্রত্নতাত্ত্বিক কাজ শুধুমাত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উদ্যোগই নয়, এর ব্যাপক সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যও রয়েছে।
তিনি একবার বলেছিলেন যে, চীনা সাংস্কৃতিক আস্থা তার সমৃদ্ধ ইতিহাস থেকে প্রত্নতত্ত্বের সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব বহন করে।
২০২৩ সালের ২৬ জুলাই, সি ছুয়ান প্রদেশের দ্য ইয়াং শহরে সানসিংতুই জাদুঘরের নতুন ভবন পরিদর্শন করেন সি চিন পিং। তিনি সেখানকার সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলোর প্রতি গভীর আগ্রহ দেখান। প্রদর্শনীর মধ্যে ওয়াং রুই এবং তার সহকর্মীরা সানসিংতুই ধ্বংসাবশেষের ৪নং বলিদান গর্ত থেকে আহরণ করা জিনিসপত্র আছে।
পরিদর্শনকালে সি চিন পিং-এর মন্তব্য ওয়াং-এর মতো তরুণ প্রত্নতাত্ত্বিকদের ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।
ওয়াং বলেন, "সাধারণ সম্পাদক সি বলেছিলেন যে, সানসিংতুইতে প্রত্নতাত্ত্বিক অর্জনগুলো বিশ্বে সুপরিচিত এবং আমাদের ফলপ্রসূ প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন। আমরা সবাই মনে করি যে, সাধারণ সম্পাদক প্রত্নতাত্ত্বিক প্রচেষ্টার প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। আমি অনুভব করি যে, আমি যা করি তা অন্যরা দেখে, এবং তা দেশে গুরুত্ব পাচ্ছে।"
ওয়াং বলেন যে, সানসিংতুই জাদুঘরে সি’র সফর নিজেকেসহ তরুণদের ক্যারিয়ারের পছন্দকে প্রভাবিত করেছে।
ওয়াং বলেন, "এর অবশ্যই কিছু প্রভাব রয়েছে। দেশ আমাদের কাজে যত বেশি মনোযোগ দেয়, ততই একাজ করায় আমাদের সিদ্ধান্ত আরো যৌক্তিক মনে হয়।"
সানসিংতুই-এর জনপ্রিয়তা চীনা সংস্কৃতির উদ্ভব সম্পর্কে জনসাধারণের আগ্রহের জন্ম দিয়েছে, তরুণদের মধ্যে প্রত্নতত্ত্বের প্রতি নতুন করে আবেগ জাগিয়েছে। ওয়াং-এর মতো তরুণ প্রত্নতাত্ত্বিকরা সত্যিই পরিবর্তনগুলো অনুভব করেছেন।
২০২১ সালে, চীনে প্রত্নতাত্ত্বিকদের তীব্র ঘাটতির বিষয়ে একটি নিবন্ধ সি’র দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এটি পড়ার পরে, প্রত্নতাত্ত্বিক কর্মশক্তি সক্রিয়ভাবে সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন সি চিন পিং। তিনি সমস্যাটি সমাধান করার জন্য একটি নির্দেশনা দেন। আরও তরুণদের এই কাজে জড়িত করতে এবং অংশগ্রহণ করতে উত্সাহিত করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন সি চিন পিং।
ওয়াং রুই বলেন, "যেহেতু দেশটি এ বিষয়ে আরও মনোযোগ দিতে শুরু করেছে, প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মী নিয়োগ সম্প্রসারণ করেছে, তরুণদের আরও চাকরির সুযোগ করে দিয়েছে। তরুণরা বিভিন্ন সহায়ক নীতি খুঁজে পেয়েছে, যার মধ্যে মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম রয়েছে, সিনিয়র প্রত্নতাত্ত্বিকরা ছোটদের গাইড ও সমর্থন করেছেন।"
ওয়াং রুই তার কাজ নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, "এটা বেশ ভালো, আগের চেয়ে অনেক ভালো। আমি শুনেছি যে আগের প্রজন্মের প্রত্নতাত্ত্বিকদের বেতন বেশ কম ছিল, এবং কাজেরও খুব চাপ ছিল। তারা সাধারণত তাদের পরিবারের ভাল যত্ন নিতে পারতেন না। যদিও আমাদের কাজের চাহিদা অনেক বেশি, অন্তত নিজেদের টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট বেতনের অভাব হয় না।”
২০১৮ সালের ৪ মার্চ, একটি সম্মেলনে সি চিন পিং বলেন, "আমরা বিশ্বাস করি যে, আমরা বর্তমানে চীনা জাতির মহান পুনরুত্থানের খুব কাছাকাছি সময়ে আছি। আমাদের আত্মবিশ্বাস চীনের চিন্তাধারা থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যা আমাদের সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক চেতনার সঙ্গে জড়িত। আমাদের নিজস্ব ভাণ্ডার অবমূল্যায়ন করা ঠিক নয়।"
প্রত্নতাত্ত্বিক শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার ক্রমাগত উন্নতি, উচ্চ-স্তরের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রতিভা প্রশিক্ষণের বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের জন্য জাতীয় বৃত্তিমূলক দক্ষতার মান প্রণয়ন পর্যন্ত, সি চিন পিং-এর নির্দেশনায়, চীনের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রতিভা প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী ও সম্পূর্ণ হয়ে উঠছে। আরো বেশি তরুণ প্রত্নতাত্ত্বিকরা এ কাজে যোগ দিচ্ছেন।
ওয়াং বলেন, "১৯৯০ দশকে জন্মগ্রহণকারী তরুণরা উল্লেখযোগ্য সামাজিক পরিবর্তনের সময়ে বাস করছে। আমার শৈশব থেকেই এমন পরিবর্তন শুরু হয়েছে। এটি এমন একটি যুগ হতে পারে যা অতীত এবং ভবিষ্যতের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। আমাদের তরুণরা বয়স্ক প্রজন্মের কাছ থেকে বৈশিষ্ট্যগুলো উত্তরাধিকার সূত্রে পায়, তরুণ প্রজন্মের বৈশিষ্ট থাকাকালীন আমরা রক্ষণশীল এবং উদ্যমী উভয় মান বজায় রাখব, আমি আশা করি যে, আমি এখন যা করছি তা ধরে রাখব। "
(শুয়েই/তৌহিদ)